বিদ্যুৎকে পরিষেবার বদলে পণ্য হিসাবে দেখায় পূর্বতন বিজেপি সরকারের বিদ্যুৎ আইন-২০০৩। এর ফলেই বিদ্যুৎ মাশুল লাগামহীন। কিন্তু এতেও সন্তুষ্ট নয় একচেটিয়া মালিকের দল। তাদের মুনাফা আরও বৃদ্ধির সুযোগ দিতে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার এনেছে বিদ্যুৎ আইন (সংশোধনী) বিল ২০২১। যার মূল কথা যৌথ তালিকাভুক্ত বিষয় বিদ্যুৎকে রাজ্যের হাত থেকে কেড়ে নেওয়া। অন্য দিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে শুরু করে পরিবহণ ও বণ্টন সমস্তটা একচেটিয়া কর্পোরেট মালিকদের হাতে তুলে দেওয়া।
সমস্তটা কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হাইকোর্টের সমতুল্য ‘ইলেকট্রিসিটি কনট্রাক্ট এনফোর্সমেন্ট অথরিটি’ (ইসিইএ) নামে নতুন সংস্থা তৈরি হচ্ছে। তারা বিদ্যুতের ক্রয়, বিক্রয় ও সঞ্চালন, এমনকি পরিষেবা সংক্রান্ত সাধারণ অভিযোগ নিরসনের একচ্ছত্র অধিকারী হবে। রাজ্য সরকার ও রাজ্য বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কমিশন, ‘ওমবাডসম্যান’ এর মাধ্যমে অন্যায়ের প্রতিকারে গ্রাহকদের যতটুকু সুযোগ ছিল, সেটি পুরোপুরি বন্ধ হবে। এই ইসিইএ-তে ন্যায় বিচার না পেলে গ্রাহকদের যে কোনও সমস্যা নিয়ে একেবারে সুপ্রিম কোর্টে যেতে হবে। যা সাধারণ গ্রাহকের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। ফলে বিদ্যুৎক্ষেত্রে নানা প্রকার জুলুম বাড়লেও ন্যায়বিচার পাওয়ার ন্যায্যঅধিকার বাস্তবে গ্রাহকদের থাকবে না।
বিদ্যুৎ বিল ২০২১-এ সমস্ত তথাকথিত ‘পারস্পরিক ভর্তুকি’ (ক্রস সাবসিডি) তুলে দিয়ে সকলের মাশুল সমান করা হবে বলা হয়েছে। ফলে যাদের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছাতে পরিকাঠামো তৈরির ৯০ শতাংশ ব্যয় হয়, সেই বৃহৎ শিল্পপতিদের মাশুল কমবে, আর গৃহস্থ, ক্ষুদ্র শিল্প, ক্ষুদ্র ব্যবসা ও কৃষি গ্রাহকদের মাশুল ব্যাপক বাড়বে। বলা হয়েছে, যদি কোনও সরকার বিদ্যুৎ গ্রাহকদের কিছু ভর্তুকি দিতে চায় তবে তা সরাসরি গ্রাহকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে দিতে হবে। অর্থাৎ আগে বিশাল অঙ্কের পুরো বিল মেটাতে হবে, তারপর ভর্তুকির প্রশ্ন। বুঝতে অসুবিধা হয় না, রান্নার গ্যাসের কায়দাতে অচিরেই এই ভর্তুকি বিলুপ্তও হবে! যে রাজ্যগুলিতে কৃষি-বিদ্যুতে কিছুটা অন্তত ভর্তুকি আছে, এই আইন গৃহীত হলে তা বন্ধ হবে। ফলে কৃষিতে বিদ্যুতের দাম বাড়বে। বাড়বে ফসলের উৎপাদন খরচ। চাষি জড়াবে ঋণের জালে, সর্বস্তরের মানুষজড়াবে মূল্যবৃদ্ধির ফাঁসে।
কী আছে বিলে
|
রাজ্যে রাজ্যে বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানিগুলি বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে নতুন করে ফ্র্যাঞ্চাইজি নিয়োগ করবে, যাদের লাইসেন্স দরকার হবে না। ফলে নতুন একটা পক্ষকে সন্তুষ্ট করতে আরও এক দফা বিদ্যুতের মাশুল বাড়বে। তাছাড়া, লাইসেন্সবিহীন ফ্র্যাঞ্চাইজির মাধ্যমে বণ্টনজনিত সমস্যা (বিদ্যুৎ বিল, মিটার, লাইন মেরামত, ট্রান্সফরমার মেরামত ও পাল্টানো, নতুন লাইন নেওয়া, নিরাপত্তা ইত্যাদি) সমাধানে গ্রাহকদের হয়রানি ও অর্থ ব্যয় প্রবল ভাবে বৃদ্ধি পাবে। এই বিলটি সংসদে পাশ করানোয় বাধা আসার ফলে সরকার কৌশলে প্রতারণার ছদ্মবেশে প্রয়োগ শুরু করেছে। তৈরি করেছে স্ট্যান্ডার্ড বিডিং ডকুমেন্ট যার মূল লক্ষ্য ১) ব্যক্তি শিল্পপতিদের কাছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিদ্যুৎ পরিষেবা সংক্রান্ত সব সম্পদ বিক্রি করা। ২) বণ্টন কোম্পানির জমি-বাড়ি সামান্য ভাড়ায় ব্যক্তি মালিকদের দিয়ে দেওয়া। ৩) সমস্ত সরকারি বিদ্যুৎ কর্মচারীদের প্রাইভেট কোম্পানির কর্মচারীতে পরিণত করা। ইতিমধ্যেই বিদ্যুৎ সেক্টরে টাটা, এসার, আদানি, গোয়েঙ্কা, টোরেন্ট কোম্পানি আছেই। এখন চেষ্টা হচ্ছে নিলাম ডেকে পুরো বিদ্যুৎ বণ্টন ব্যবস্থাকে মাত্র কয়েকজন একচেটিয়া কর্পোরেটের কাছে হস্তান্তর করা।
ইতিমধ্যে পুদুচেরি, জম্মু ও চণ্ডীগড়ের মতো কেন্দ্র-শাসিত অঞ্চলে সমগ্র বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন, বন্টন ব্যবস্থাকে কর্পোরেটের কাছে বিক্রি করার নোটিস জারি হয়েছে। উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার পূর্বাঞ্চল বিদ্যুৎ বণ্টন নিগমকে বেসরকারি করার সিদ্ধান্ত নিলে তার বিরুদ্ধে সারা দেশের বিদ্যুৎক্ষেত্রের সমস্ত কর্মচারী সংগঠন ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল। অ্যাবেকা সেই আন্দোলনকে পূর্ণ সমর্থন জানায়। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের চাপে উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকারকে এই জনবিরোধী সিদ্ধান্তস্থগিত রাখতে বাধ্য হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে ইতিমধ্যেই মিটার রিডিং, বিল তৈরি, বিল বণ্টন, মেরামতি, নতুন কানেকশন দেওয়া সহ বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালনের বহু বিষয় কন্ট্রাক্টরদের হাতে দেওয়া হয়েছে।
অ্যাবেকার প্রতিবাদ উপেক্ষা করে পশ্চিমবঙ্গে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন ও ব্যবহারের বিষয়ে নতুন রেগুলেশনে বলা হয়েছে। সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করতে ও ব্যবহার করতে হলে লাইসেন্স নিতে হবে। তার শর্ত হচ্ছে উৎপাদিত সৌর বিদ্যুৎ পুরোটাই পূর্ব নির্ধারিত দামে ন্যাশানাল গ্রিডে বিক্রি করতে হবে। তারপর সেই বিদ্যুৎ ‘নেট মিটারিং’ ব্যবস্থার মাধ্যমে বিদ্যুৎ বণ্টন কোম্পানির নির্ধারিত দামে কিনে নিতে হবে।
চালু করা হয়েছে প্রিপেড মোবাইলের মতো প্রিপেড মিটার। যার টাকার ব্যালেন্স শেষ হয়ে গেলে নিজে থেকেই বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এই ব্যবস্থা চালু হলে মিটার রিডিংয়ের দরকার হবে না। ফলে ছাঁটাই হবেন বহু শ্রমিক। অবলুপ্ত হবে বহু পদ। মিটার সংক্রান্ত সমস্যাগুলি নিয়ে গ্রাহক হয়রানি চূড়ান্ত হবে। এই বিদ্যুৎ বিল চালু হলে কৃষকরা চরম বিপদে পড়বে। বহু রাজ্যে কৃষিতে বিদ্যুতের লাইন, সাবস্টেশন, ফিডার অন্যান্য স্তরের গ্রাহকদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক করে দেওয়া শুরু হয়েছে। বলা হচ্ছে, এর ফলে কৃষকদের পুরো ভোল্টেজে অবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পেতে সুবিধা হবে। কিন্তু এর আসল উদ্দেশ্য হল যখন শিল্পপতিরা বিদ্যুৎ কম নেবে, সেই অব্যবহৃত বাড়তি বিদ্যুৎ রাত ১০টা থেকে সকাল ৬ টা পর্যন্ত চাষিদের দেওয়া হবে। সারাদিন তাঁরা বিদ্যুৎ থেকে বঞ্চিত থাকবেন। রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে মাঠে সেচ দিতে গিয়ে তাঁরা অসুস্থ হবেন, সাপের কামড়ে মরবেন। আর তাঁদের মৃত্যুর বিনিময়ে একচেটিয়া বিদ্যুৎ ব্যবসায়ীদের মুনাফা বৃদ্ধি পাবে। অদূর ভবিষ্যতে প্রান্তিক, ক্ষুদ্র, মাঝারি চাষি ক্রমবর্ধমান খরচ সামাল দিতে না পেরে জমি থেকে উৎখাত হবে। আর বিশাল বিশাল জোতে এই কর্পোরেট মালিকরা আলাদা ফিডারের সর্বক্ষণের বিদ্যুৎ ব্যবহার করে খাদ্যশস্য সহ সমস্ত ফসলের একচেটিয়া উৎপাদকে পরিণত হবে।
এইভাবে শহর-গ্রামের বিপুল সংখ্যক মানুষ বিদ্যুৎ কিনতে অক্ষম হয়ে পড়লে সেই বাড়তি বিদ্যুৎ যাতে বিদেশে বিক্রি করতে পারা যায় তার জন্য ‘ক্রস বর্ডার ট্রেড’ নামে একটি ধারা এই সংশোধনী বিলে আনা হয়েছে। অর্থাৎ দেশের কয়লা ব্যবহার করে দেশেরই শ্রমিক যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে, তা দেশের সীমানা পেরিয়ে বাড়তি মুনাফা লুটতে বিদেশে যাবে দেশের মানুষকে বিদ্যুৎহীনতার অন্ধকারে রেখেই। এই হল সর্বনাশা বিদ্যুৎ বিল-২০২১ এর কিছু ভয়ঙ্কর দিক। এই বিল বাতিল করার জন্য সংযুক্ত কিসান মোর্চা দীর্ঘ ১০ মাসের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২৭ সেপ্টেম্বর ভারত বনধের ডাক দিয়েছে। এই বনধকে সর্বাত্মক সফল করা সর্বস্তরের বিদ্যুৎ গ্রাহকের কর্তব্য।