এই বিলে বিদ্যুৎকে মুনাফার পণ্য করা হয়েছে। বিদ্যুৎ আইন ১৯৪৮-এ বিদ্যুৎ ছিল একটা পরিষেবা। যার অর্থ হল জনগণের সুবিধার্থে দাম যতদূর কম রাখা যায় দেখতে হবে এবং এখান থেকে কোনও মুনাফা করা যাবে না। ২০০৩ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে পূর্বতন বিজেপি সরকার এই আইন পাল্টে দিয়ে বিদ্যুৎকে মুনাফা লোটার ক্ষেত্রে পরিণত করে। বিদ্যুতের বিল যে মারাত্মক বেড়ে যাচ্ছে, তার কারণ এখানেই। যে কমিটি এই বিদ্যুৎ আইন ২০০৩ তৈরি করেছিলেন তার সদস্য ছিলেন সিপিএম সাংসদ বাসুদেব আচারিয়া এবং নেতৃত্বে কংগ্রেসের সাংসদ সন্তোষ মোহন দেব। ফলে বিদ্যুতের দামবৃদ্ধির এই কৌশলে বিজেপি সহ এই সব দলের ভূমিকা কোনও অংশেই কম নয়।
ব্যাপক মুনাফা লুটতেই সেই সময় সরকারি বিদ্যুৎ পর্ষদ ভেঙে দিয়ে (১) উৎপাদন, (২) পরিবহণ, (৩) বন্টন– এই তিনটি কোম্পানি গঠন করা হয় এবং প্রতি ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১৬ শতাংশ নিশ্চিত মুনাফার ব্যবস্থা করা হয়। বাজপেয়ীর উত্তরসূরী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এসে এই তিনটি কোম্পানির সাথে ‘ফ্র্যাঞ্চাইজি’ নামে লাইসেন্সবিহীন আরেকটি নতুন মুনাফা লোটার সংস্থা গঠন করে। চারটি সংস্থা যদি ১৬ শতাংশ হারে মুনাফা রেখে দাম নির্ধারণ করে তাহলে গ্রাহককে কত বেশি বিল দিতে হবে, একবার অঙ্কটা কষে দেখুন।
অঙ্কটা এই রকম : উৎপাদন কোম্পানি ১০০ টাকার বিদ্যুৎ বেচবে ১১৬ টাকায়। ১৬ শতাংশ লাভ রেখে পরিবহণ কোম্পানি বেচবে ১৩৪ টাকায়। একই ভাবে ১৬ শতাংশ লাভ রেখে বন্টন কোম্পানি বেচবে ১৫৫ টাকায়। ফ্র্যাঞ্চাইজি বেচবে ১৮০ টাকায়। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে দাম বাড়ল ৮০ শতাংশ। কলকাতা মেট্রোতে স্টেজ ভেঙে বেশি স্টেজ করে যেমন ভাবে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে, সেই একই কায়দায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। গ্রাহকের উপর চাপছে মারাত্মক বিলের বোঝা।
দ্বিতীয়ত, এখনও পর্যন্ত বিদ্যুৎ আইনে বিভিন্ন ধরনের গ্রাহকের জন্য বিভিন্ন হারে দাম নির্ধারণের ব্যবস্থা আছে। কেবল তাই নয়, একই ক্যাটেগরির (গৃহস্থ, ব্যবসায়ী, শিল্প) গ্রাহকদের কম-বেশি ভোল্টেজের বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য, বিভিন্ন রকম রেট আছে। তা ছাড়া, ভৌগোলিক পরিবেশের পার্থক্য অনুসারে রেট আলাদা হয়। রেট আলাদা হয় বিদ্যুৎ ব্যবহারের উদ্দেশ্য বিচারেও। এই সংশোধনী বিলের মধ্য দিয়ে এইসব তুলে দিয়ে বলা হচ্ছে সকলকে একই হারে দাম দিতে হবে। অর্থাৎ ঝুপড়ির বাসিন্দা যার ঠিকমতো খাবার জোটে না, আর রিলায়েন্সের মুকেশ আম্বানি, যার ঘন্টায় সম্পদ বৃদ্ধি ৯০ কোটি টাকা– উভয়কে একই হারে বিদ্যুতের দাম দিতে হবে। বিদ্যুৎ আইন (সংশোধনী) বিল-২০২০-তে সকলের জন্য এক হারে বিদ্যুৎ বিল অর্থাৎ এক দেশ এক রেট নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। এক দেশ এক রেট হলে সম্পদও এই রীতিতে পুনর্বিন্যস্ত হোক। কিন্তু সরকার সেটা করবে না। কারণ এটা পুঁজিপতিদের স্বার্থবিরোধী। এক দেশ এক রেট এই চমকপ্রদ স্লোগানের আড়ালে সাধারণ মধ্যবিত্ত, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বিদ্যুৎ বিল বেশি দিতে বাধ্য করার ব্যবস্থা হচ্ছে।
কেন সকলকে এক হারে বিদ্যুৎ মাশুল দিতে হবে? একটা স্কুল-কলেজ, যে দেশের জন্য দক্ষ জনসম্পদ তৈরি করে, একজন কৃষক, যে দেশের মানুষের জন্য খাদ্য উৎপাদন করে, কেন তার বিদ্যুৎ মাশুল কোটি কোটি টাকার পাহাড়ের উপর শুয়ে থাকা পুঁজিপতিদের মতো হবে? কোনও রাজ্য সরকার বিদ্যুতে নির্দিষ্ট কোনও গ্রাহককে ভর্তুকি দিতে চাইলে তার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে দিতে হবে। যার পরিণাম বর্তমানে রান্নার গ্যাসে ভর্তুকি দেওয়ার মতো হবে। দিল্লিতে, সারা দেশে যে লক্ষ লক্ষ কৃষক এই বিদ্যুৎ বিলের বিরোধিতা করছেন, তার কারণ এই জায়গায়।
তৃতীয়ত, এই বিদ্যুৎ বিল যে দেশের মধ্যে প্রবল ক্ষোভের সৃষ্টি করবে, তা বুঝতে পেরে সরকার আইনি সুযোগ থেকেও মানুষকে বঞ্চিত করার ব্যবস্থা করেছে। ইলেকট্রিসিটি কন্ট্র্যাক্ট এনফোর্সমেন্ট অথরিটি (ইসিইএ) নামে একটি সংস্থা গঠন করেছে, যার ক্ষমতা হাইকোর্টের সমতুল্য। এর কাছেই যেতে হবে বিদ্যুৎ সংক্রান্ত বিবাদে। এর রায় কী হবে সহজেই অনুমেয়। এই অথরিটির রায়ের বিরুদ্ধে কিছু বলার থাকলে বলতে হবে সুপ্রিম কোর্টে। কতজন সাধারণ মানুষের সে ক্ষমতা আছে?
চতুর্থত, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও রাজ্য যৌথ তালিকায় রয়েছে। বিদ্যুৎ বিল-২০২০-তে রাজ্যের প্রায় সমস্ত ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে একচ্ছত্র কেন্দ্রীয় আধিপত্য কায়েমের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
পঞ্চমত, বিদ্যুৎ বিল-২০২০-তে ক্রস-বর্ডার ট্রেড নামে একটা প্রস্তাব করা হয়েছে। এই প্রস্তাব কার্যকর হলে দেশের প্রয়োজন না মিটিয়েও বিদেশে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে পারবে বিদ্যুৎ বন্টন কোম্পানিগুলি। এইসব দিক বিবেচনায় বিদ্যুৎ বিল-২০২০ অত্যন্ত জনবিরোধী এবং এর বিরুদ্ধে কৃষকদের পাশাপাশি শহরের মধ্যবিত্ত মানুষকেও প্রতিবাদে এগিয়ে আসতে হবে। না হলে এই দানবীয় বিল আটকানো যাবে না। বিদ্যুতের পাহাড়প্রমাণ বিলে পকেট হবে ফাঁকা। ঘরে নেমে আসবে অন্ধকার। শুরু থেকেই বিদ্যুৎ গ্রাহকদের সংগঠন অ্যাবেকা রাজ্য ও কেন্দ্র সরকারের জন বিরোধী বিদ্যুৎ নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে আসছে।