মহান ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আকাঙক্ষা হৃদয়ে বহন করে, এ দেশের মাটিতে যথার্থভাবে ধর্মনিরপেক্ষ-বৈজ্ঞানিক-গণতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লড়াইকে আরও শক্তিশালী আরও সংহত করতে, সাত দিন ব্যাপী (১-৭ ফেব্রুয়ারি) ‘অঙ্গীকার যাত্রা’য় সামিল হল এ রাজ্যের হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী। এ কম বড় কথা নয়। এ খুব সহজ ব্যাপার নয়। যুগে যুগে ছাত্র-যুবকরাই যুগনির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে ঠিকই। কিন্তু বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে, চতুর্দিকে যখন আত্মসর্বস্বতার নিত্যনব উস্কানি, নিছক ব্যক্তিগত কেরিয়ারের প্রবল হাতছানি, তখন বিদ্যাসাগরের মতো মনীষীদের স্বপ্ন পূরণ করার মন এবং মনন যে পাল্টা শক্তি সঞ্চয় করছে– এ অত্যন্ত বিরল প্রাপ্তি। তাই, বিদ্যাসাগরের দ্বিশত জন্মবর্ষ উপলক্ষ্যে এ দেশের একমাত্র বিপ্লবী ছাত্র সংগঠন অল ইন্ডিয়া ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশন-এর আহ্বানে এই ‘অঙ্গীকার যাত্রা’ গোটা রাজ্যের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে মুগ্ধ, বিস্মিত করছে। তাদের মনে যোগাচ্ছে আশা-ভরসা, প্রবল উদ্দীপনা। বর্তমান সময়ে সারা দেশে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বাতাবরণ সৃষ্টিকারী এবং ধর্মের নামে বিভাজনকারী এনআরসি-এনপিআর-সিএএ ইত্যাদির মতো ষড়যন্ত্রমূলক সরকারি নীতিকে প্রতিহত করতে, শিক্ষার ন্যূনতম অধিকারটুকুও সাধারণের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া এবং নারী সমাজের উপর ঘটে চলা চূড়ান্ত লাঞ্ছনা-অবমাননার বিরুদ্ধে প্রায় ১০০০ কিলোমিটার পথ পরিক্রমণ করছে এই ‘অঙ্গীকার যাত্রা’। এই পথেও তারা অগণিত অজানা-অচেনা ছাত্র-যুবকের হৃদয়ে সৃষ্টিশীলভাবে রোপণ করছে বিদ্যাসাগরের অপূরিত স্বপ্নের বীজ। দারিদ্রপীড়িত উত্তরবঙ্গের চা-বাগানের ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে দক্ষিণবঙ্গের সুন্দরবনের অভাব-অনটনে চলা মৎস্যজীবী পরিবারের ছাত্রছাত্রী-সহ হাজার হাজার তরুণ প্রাণের সৃজনশীল অংশগ্রহণে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও মনুষ্যত্ব রক্ষার এই ‘অঙ্গীকার যাত্রা’কে মানুষ দেখছে অন্ধকারের মাঝে আশার উজ্জ্বল আলোক হিসাবে। তারা বলছে, অশিক্ষা-অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করে এরাই আনবে রাঙা প্রভাত।
‘অঙ্গীকার যাত্রা’র পরিকল্পনা হয়েছে বিস্তৃত ক্ষেত্র জুড়ে। উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ি থেকে, ঝাড়খণ্ডের কর্মাটাঁড় থেকে এবং মেদিনীপুরের বীরসিংহ থেকে– তিনটি মহামিছিল। গন্তব্য কলকাতার কলেজ স্কোয়ারে বিদ্যাসাগর মূর্তির পাদদেশ। ১ ফ্রেব্রুয়ারি শিলিগুড়িতে উদ্বোধন উপলক্ষে এক বিশাল ছাত্র সমাবেশ সংঘটিত হয়। এই সমাবেশ থেকে এআইডিএসও-র সাধারণ সম্পাদক সৌরভ ঘোষ ‘অঙ্গীকার যাত্রা’র সূচনা করেন। শিলিগুড়ি শহরের এয়ারভিউ মোড় থেকে শুরু হয়ে ইসলামপুর, রায়গঞ্জ, বহরমপুর, কৃষ্ণনগর, সোদপুর, বারাসত হয়ে কলকাতা। বীরসিংহ থেকে যে মহামিছিল তা খড়ার, আরামবাগ, হাওড়া হয়ে কলকাতা। কর্মাটাঁড় থেকে মহামিছিলটি আসানসোল, বর্ধমান, হুগলি, হাওড়া হয়ে কলকাতা– প্রাথমিক পরিকল্পনা এই।
কারও কারও মনের কোণায় একটু-আধটু কিন্তু-কিন্তু যে একেবারেই ছিল না, তা নয়। এত বড় কর্মসূচি– কীভাবে হবে, অমুক ক্ষেত্রে অমুকটা হলে তখন কী হবে? এসব কোথাও কোথাও একটু তো ছিলই। তবে, সে সব যেন হাওয়ার মতো মিলিয়ে গেল পথে নামার পর। নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে তারা আবিষ্কার করল এক নতুন জগৎ। সংশয়ী দ্বিধাগ্রস্ত মনের জড়তা কাটিয়ে প্রাণচাঞ্চল্য জাগিয়ে দিল শত শত আলো। ‘অঙ্গীকার যাত্রা’ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য বহু মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এলেন। বীরসিংহ ভগবতী স্কুলের স্টাফ রুমে প্রধান শিক্ষক, যিনি ‘অঙ্গীকার যাত্রা’র অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি তিনি সহ, অন্যান্য সদস্যদের এবং এআইডিএসও সংগঠকদের উপস্থিতিতে মিটিং করেন। ৪ ফেব্রুয়ারি স্কুলের সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যাসাগরের চিন্তার জীবন্ত অনুশীলনে সামিল করার জন্য তিনি উদ্যোগ করেছিলেন। অভ্যর্থনা সমিতির আহ্বানে বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে ক্যুইজ, বিজ্ঞান মডেল এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় স্কুলের ভিতরে। বীরসিংহ থেকে পশ্চিম মেদিনীপুর-খড়ার পৌরসভা অতিক্রম করে অঙ্গীকার যাত্রা এগিয়েছে। খড়ার গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা (তাঁর মেয়ে গুরুতর অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও) স্বেচ্ছায় উদ্যোগ নিয়ে সমস্ত ছাত্রীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।
খড়ার পৌরসভার বিশিষ্ট জনপ্রতিনিধি বিনামূল্যে ছাত্রদের থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। খড়ারের তিনটি ক্লাব রাতে ছাত্রদের খাওয়ার ব্যবস্থাও করে দিয়েছে। কার্যত জনসাধারণই কর্মসূচি সফল করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে খড়ার থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে লক্ষ্মীনারায়ণপুরের কাছে খাসবাড়ে ২৫০ জনের খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন এলাকার একজন শুভানুধ্যায়ী। তিনি ছাত্রদের কর্মসূচির বিবরণ শুনে বলেন, ‘ তোমরা তো আমাদের বাড়ির সন্তানদের ভালর জন্য এত কষ্ট করছ। আমরা একটু সাহায্য করতে পারব না!’ বীরসিংহ থেকে খড়ার হয়ে আরামবাগ পর্যন্ত সংগঠনের তেমন যোগাযোগ ছিল না। কর্মসূচির আবেগঘন আবেদনে সাড়া দিয়ে সেখান থেকেই প্রায় তিনশো ছাত্রছাত্রী ‘অঙ্গীকার যাত্রা’র প্রস্তুতিতে স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে সামিল হয়েছে। বীরসিংহ সংলগ্ন এলাকায় বেশ কিছুদিন ধরে, এআইডিএসও-র কর্মী-সংগঠকরা প্রচারের কাজে নিযুক্ত ছিলেন। তাঁদের থাকার অসুবিধা হচ্ছে শুনে, বীরসিংহের একটি ক্লাব, যা গরিব আদিবাসী সম্প্রদায়ের জনসাধারণের দ্বারা পরিচালিত, তাঁরা কয়েকজন সংগঠকের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন। তাঁরা গভীর অনুভূতির সাথে বলেছেন, ‘আমরা তো টাকাপয়সা তেমন দিতে পারব না! আর সব কিছু দিয়ে আপনাদের সাহায্য করব। যখনই অসুবিধা হবে, এখানে চলে আসবেন।’
শুধু বীরসিংহ নয়, সারা রাজ্য জুড়ে, অসংখ্য মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করেছে এই ‘অঙ্গীকার যাত্রা’। রাজ্যের সর্বত্র, হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী এই কর্মসূচি সফল করতে স্বেচ্ছাসেবক হয়েছেন। সারা রাজ্যে গড়ে উঠেছে অসংখ্য কমিটি। এরই সাথে গঠিত হয়েছে ‘সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী ছাত্র সংগ্রাম কমিটি’ও। মালদার গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসে-ক্লাসে প্রচার করার সময় ছাত্রছাত্রীরা ব্যাপকভাবে সমর্থন জানানোর পাশাপাশি অনুষ্ঠানের খরচ বাবদ নিজেরা দায়িত্ব নিয়ে অর্থ সংগ্রহ করে দিয়েছে। মালদার জনৈক ব্যবসায়ী কর্মসূচির বিবরণ শুনে, দু’শো জন অংশগ্রহণকারীর জন্য টিফিনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। কলকাতার বরানগরের বাসিন্দা এক বয়স্কা ভদ্রমহিলা কর্মসূচির আবেদনে সাড়া দিয়ে অঙ্গীকার যাত্রীদের জন্য একশো ডিম কিনে দিয়েছেন। দার্জিলিং জেলার নকশালবাড়ির একজন শিক্ষক ওই এলাকা থেকে যেসব ছাত্রছাত্রী ‘অঙ্গীকার যাত্রা’য় অংশগ্রহণ করেছে, তাদের সমস্ত খরচ বহন করার পাশাপাশি গাড়ির ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন। উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুরে পাঞ্জিপাড়াতে অটো প্রচার করছিল এআইডিএসও-র কর্মী-সমর্থকরা। বহু মানুষ অঙ্গীকার যাত্রার বক্তব্য শুনে প্রচারপত্র সংগ্রহ করে স্বেচ্ছায় অর্থ সাহায্যে এগিয়ে আসেন। ওখানকার এক চায়ের দোকানে ছাত্রছাত্রীরা প্রচারের পর চা খায়। কিন্তু দোকানদার কিছুতেই পয়সা নেননি। তিনি বলেছেন, ‘তোমরা কোথায় পাবে!’ ইসলামপুরে প্রচারের সময়, এক বয়স্ক মহিলা এগিয়ে এসে বলেন, ‘আমি তো ভিক্ষা করে চলি, তোমাদের এরকম একটা বড় কাজে ১০ টাকা সাহায্য দিলাম।’ কলকাতার রাসবিহারীতেও ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিনামূল্যে বাসের ব্যবস্থা করে দেন একটি বাসরুটের ইউনিয়ন।
এই ব্যাপক জনসমর্থনের উষ্ণতা হৃদয়ে ধারণ করে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী ৭ ফেব্রুয়ারি পৌঁছবে কলকাতায়। তারা মিলিত হবে বিদ্যাসাগরের প্রধান কর্মস্থল কলেজ স্কোয়ারে। বিদ্যাসাগর মূর্তির পাদদেশে ছাত্রসমাবেশে প্রধান বক্তা হিসাবে উপস্থিত থাকবেন, এ দেশের সংগ্রামী বামপন্থী আন্দোলনের বিশিষ্ট জননেতা এবং এসইউসিআই (কমিউনিস্ট) দলের সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ। উপস্থিত থাকবেন সংগঠনের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব। বিস্তৃত যাত্রাপথের নানা জায়গায় ছাত্র-ঐক্য রূপে যে শত শত মশাল প্রজ্জ্বলিত হয়েছে, সে আগুন-আলোকে ভিত্তি করে ঘরে ঘরে মানুষ হওয়ার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়বে। বিদ্যাসাগরের স্বপ্ন সফল হবেই।’