বিদ্যাসাগরের সমাজমুক্তির স্বপ্ন সফল করার অঙ্গীকারই হোক
তাঁর দ্বিশত জন্মবর্ষে দেশবাসীর প্রকৃত শ্রদ্ধাজ্ঞাপন
বিদ্যাসাগরের দ্বিশত জন্মবর্ষ পূর্ণ হল। ভারতীয় নবজাগরণের পথিকৃৎ বিদ্যাসাগর শুধু এ রাজ্য নয় সারা দেশেই অনুপ্রেরণার এক বিরল দৃষ্টান্ত। তাঁর জীবনসংগ্রামের গভীর চর্চা এবং সেখান থেকে যুগোপযোগী শিক্ষা নিয়ে বর্তমান এই পচে যাওয়া সমাজের পরিবর্তনের জন্য, কোটি কোটি শোষিত-বঞ্চিত-নিপীড়িত মানুষের মুক্তির জন্য প্রচেষ্টা চালানো আজ বিদ্যাসাগর অনুরাগী প্রতিটি দেশবাসীর দায়িত্ব ও কর্তব্য।
এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মার্কসবাদী দার্শনিক, সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষ মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সর্বোন্নত উপলব্ধি ভিত্তিতে বিদ্যাসাগর চরিত্রের যে অসাধারণ মূল্যায়ন উপস্থিত করেছেন তার ভিত্তিতে যদি আমরা বিদ্যাসাগরের জীবন চর্চা করি তবেই তাঁর বুকের ব্যথাকে আমরা সত্যিই উপলব্ধি করতে পারব এবং সেই অনুযায়ী সামাজিক দায়িত্ব পালনে আমাদের ভূমিকা পালন করতে পারব।
গণদাবীর পাতায় সেই চেষ্টার অঙ্গ হিসাবে আমরা গত বছর থেকে ধারাবাহিকভাবে বিদ্যাসাগরের জীবনসংগ্রামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি সহজ সরল ভাষায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এই উদ্যোগ হাজার হাজার পাঠকের দ্বারা যেমন বিপুলভাবে সমাদৃত হয়েছে তেমনই এই কাজটা করতে গিয়ে আমরাও নতুন করে অনেক কিছু শিখেছি, পুরনো উপলব্ধি আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। বাস্তবে, বিদ্যাসাগরের গোটা জীবনসংগ্রামটাই এমন যে, আন্তরিকভাবে তার সংস্পর্শে কেউ এলে, উদ্বুদ্ধ তিনি হবেনই। বিবেক তার জাগ্রত হবেই। কিন্তু শুধু উদ্বুদ্ধ হওয়াই তো যথেষ্ট নয়। বিদ্যাসাগর যে আধুনিক সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যে আধুনিক উন্নত মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, যে স্বপ্ন আজও অপূরিত। তা পূরণ করার জন্য আমাদের প্রচেষ্টা যদি সঠিক পথে না হয় তবে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন সফল হবে না। তাই, একদিকে চাই বিদ্যাসাগরের জীবন-সংগ্রামের গভীর চর্চা, অন্য দিকে একই সঙ্গে চাই বর্তমান সমাজের উপর নেমে আসা শাসক শ্রেণির প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রাম।
বিদ্যাসাগর তাঁর সমকালে যে সমাজ দেখেছিলেন তা ছিল অশিক্ষা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, অন্ধতা, আর কুসংস্কারে ভরা। জাত-পাত-বর্ণের নামে নিচের তলার মানুষের উপর চলত অমর্যাদাকর আচরণ ও অকথ্য অত্যাচার। মানুষ হিসাবে নারীর কোনও মর্যাদা ছিল না। পুরুষতন্ত্রের নিগড়ে নারীর জীবন নিষ্পিষ্ট হত। সমাজের এই রকম একটা ভয়ঙ্কর অবস্থাকে বদলানার কঠিন পণ নিয়ে লড়াই শুরু করেছিলেন বিদ্যাসাগর। আজ তাঁর জন্মের দ্বিশত বর্ষের শেষে এসে তাঁর এই লড়াই থেকে যে অন্যতম প্রধান শিক্ষাটা আমাদের গ্রহণ করা দরকার তা হল, প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যেও কী ভাবে আপন লক্ষে্য অবিচল থাকতে হয়। তথাকথিত নাম যশ ইত্যাদির মোহ থেকে কী ভাবে মুক্ত থাকতে হয়। কী ভাবে মিথ্যা মর্যাদাবোধের গণ্ডি ছাড়িয়ে যথার্থ মর্যাদাবোধের স্তরে নিজেকে উন্নীত করতে হয়।
বিদ্যাসাগর বর্ণভেদপ্রথার বিরুদ্ধে বই লেখেননি। অনায়াসে মিশে গেছেন তথাকথিত নিম্নবর্ণ, নিম্নশ্রেণির মানুষের সঙ্গে। হয়ে উঠেছেন তাঁদের একান্ত আপনার জন। ব্রাহ্মণ্যবাদের দাপটের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে অন্যদের জন্য শিক্ষার দ্বার খুলে দিয়েছেন। এখনকার তথাকথিত স্মার্ট যুগে কত জন শিক্ষিত মানুষ বিদ্যাসাগরের মতো জাতপাত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে আপন ভাবতে পারে?
বিদ্যাসাগর একটা সময়ে অর্থ উপার্জন করেছেন প্রচুর। তার প্রায় সমস্তই তিনি ব্যয় করেছেন জনসাধারণের জন্য স্কুল নির্মাণে ও পরিচালনায়, গ্রামে গ্রামে স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে তোলায়, বিজ্ঞান চর্চা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায়। তিনি দীর্ঘ কাল কলকাতায় ছিলেন কিন্তু নিজের থাকার জন্য একটা বাড়ি পর্যন্ত করেননি। জীবনের শেষ দিকে এসে বইপত্র রাখার জন্য (প্রায় ৫০ হাজার বই ছিল তাঁর সংগ্রহে) বাদুড়বাগানের বাড়িটি করেছিলেন। পরে সেখানেই তিনি থাকতেন।
বিদ্যাসাগর ব্যক্তিগত সম্পর্ক অপেক্ষা ব্যক্তির গুণের ভিত্তিতে দেখার শিক্ষা রেখে গেছেন। পিতামাতাকে শ্রদ্ধা করতেন তাঁদের কোমল এবং উন্নত হৃদয়বৃত্তির জন্যই। কখনও অন্যথা দেখলে স্পষ্টভাষায় তাঁদেরও সমালোচনা করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি তিনি। আমরা প্রায়শই আপনজনের দোষ আড়াল করার চেষ্টা করি। যোগ্যতা এবং গুণাবলি না থাকলেও অন্যায়ভাবে আপনজনদের সুযোগসুবিধা দিই। বিদ্যাসাগরের চরিত্রে এসব হীন দুর্বলতার লেশমাত্র ছিল না।
বিদ্যাসাগরের চরিত্র সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যে দুটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছেন, ‘অজেয় পৌরুষ’, ‘অক্ষয় মনুষ্যত্ব’– এই দুটি বৈশিষ্ট্য অর্জনের সংগ্রাম ছাড়া আজও যথার্থ মানুষ হওয়া সম্ভব নয়। আজ সমাজের উপর, সাধারণ শ্রমজীবী জনতার জীবন-জীবিকার উপর ‘নয়া শিক্ষানীতি’র নামে, ‘কৃষি সংস্কার বিল’-এর নামে, ‘শ্রম আইন সংস্কার’-এর নামে যে ভয়াবহ আক্রমণ ভারতের শাসকশ্রেণি নামিয়ে আনছে, তার বিরুদ্ধে সত্যিকারের একটা লড়াই সংগঠিত করতে হলে বিদ্যাসাগরের চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্য অর্জনের চেষ্টা আমাদের করতেই হবে। নিপীড়িত-শোষিত মানুষের জন্য গভীর ভালবাসা এবং সেই ভালবাসার ভিত্তিতেই তাদের জন্য সর্বস্ব পণ করে লড়াই করতে পারার তেজ ও সাহস অর্জন আমাদের প্রত্যেককে করতেই হবে।
বিদ্যাসাগরকে উপলক্ষ করে নানা গোষ্ঠীর নানা আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান দ্রুতই শেষ হয়ে যাবে। তারা বিদ্যাসাগরের জীবন-সংগ্রামের মূল ভিত্তি যে পার্থিব মানবতাবাদী আদর্শ, তার চর্চা করবে না শুধু নয়, তাঁকে শুধুমাত্র দয়ারসাগর, করুণাসাগর কিংবা শিক্ষা সংস্কারক হিসাবেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাইবে। নয় তো বিদ্যাসাগরকে নিছক পাথরের মূর্তি বানিয়ে রেখে দেবে। আর কিছু লোক তাঁর মহান সংগ্রামকে খাটো করার চেষ্টায় তাঁর কাজকর্মের অপব্যাখ্যা করবে। বিদ্যাসাগরের চিন্তার প্রভাব একসময় সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে যাঁরা আধুনিক চিন্তাভাবনা নিয়ে সমাজগঠনে এগিয়ে এসেছিলেন তাঁরা সেই সেই রাজ্যের ‘বিদ্যাসাগর’ নামে পরিচিত হয়েছিলেন। বাস্তবে তাঁরা অধিকাংশেই বিদ্যাসাগরের চিন্তা এবং সংগ্রামের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। বিদ্যাসাগরের নানা লেখা তাঁরা নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করে প্রচার করেছিলেন। এসব ঘটে ছিল বিদ্যাসাগরের জীবনকালেই। কিন্তু ধীরে ধীরে বিদ্যাসাগরকে জনমন থেকে মুছে ফেলার পরিকল্পিত চেষ্টা হয়েছে। যে বিদ্যাসাগর ভারতে আধুনিক শিক্ষা প্রচলনের পথ তৈরি করলেন, তার জন্য সর্বস্ব দিলেন তাঁকে ‘ভারতের শিক্ষাবিদ’ নামক কোনও তালিকায় খুঁজে পাওয়া যায় না। এমনকি ‘আধুনিক ভারতের নির্মাতা’ শীর্ষক বইপত্রেও বিদ্যাসাগর অনুপস্থিত। এটা কি এমনি এমনি হচ্ছে? একদমই তেমনটা নয়। এটা হচ্ছে কারণ, বিদ্যাসাগর রামমোহনের শুরু করা নবজাগরণ আন্দোলনে গুণগত পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন। এ দেশে আধ্যাত্মবাদ মুক্ত মানবতাবাদী ভাবনাকে সমাজের গভীরে প্রোথিত করার জন্য ধর্মীয় চিন্তাপদ্ধতি সম্পূর্ণ বাতিল করতে চেয়েছিলেন। ধর্মের সীমাবদ্ধতাকে তুলে ধরেছিলেন, ধর্মীয় শাস্তে্রর অসারতা তুলে ধরেছিলেন। সেই যুগে সাংখ্য ও বেদান্তকে ভ্রান্ত দর্শন বলে ঘোষণা করার অসীম সাহস দেখিয়েছিলেন। মার্কসবাদী দার্শনিক শিবদাস ঘোষ তাঁকে বলেছেন একজন ‘খাঁটি হিউম্যানিস্ট’। আজকের ভণ্ড গণতন্ত্রীদের, তাই বিদ্যাসাগরকে এত ভয়। স্বাধীন ভারতের সব সরকারই তাঁর চরিত্রকে আড়াল করার চেষ্টা করেছে, আজও করে চলেছে।
আজ আধুনিক শিক্ষাকে ধ্বংস করে পুরাণ-গল্পকথাকে, জীর্ণ লোকাচারকে সিলেবাসে ঢোকানোর চেষ্টা পুরোমাত্রায় চলছে। জনমনে অন্ধতা-কুসংস্কার আরও বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা চলছে। চেষ্টা চলছে ইতিহাসের চাকাকে পিছনে দিকে ঘোরানোর। এই সব অপচেষ্টাকে আদর্শগত ভাবে অনেকখানি প্রতিরোধ করা সম্ভব বিদ্যাসাগরের জীবন-সংগ্রামের সক্রিয় চর্চার দ্বারা। তাই, দ্বিশত জন্মবর্ষের এই প্রয়াশই শেষ নয়, বিদ্যাসাগরের চর্চা যেন সমাজ জুড়ে অব্যাহত থাকে। তাঁর অপূরিত স্বপ্ন যেন দেশবাসীর অন্তরে, আমাদের বিবেকে সদা জাগ্রত থাকে। তাঁকে নিয়ে আরও চর্চা চলুক, তাঁর জীবনের অনালোচিত আরও নতুন নতুন দিক সামনে আসুক। কিন্তু নিছক আলোচনা আর মাল্যদানের মধ্যে যেন তাঁকে আমরা আবদ্ধ না রাখি। তাঁর চরিত্রের মর্মবস্তুকে আজকের সর্বোন্নত চিন্তার আলোকে প্রতিনিয়ত পরিশুদ্ধ করে আমরা সমাজমুক্তির সংগ্রাম কঠিনতর পরিস্থিতিতেও জারি রাখব, এই হোক এই বিশেষ সময়ের অঙ্গীকার।