ভারতীয় নবজাগরণের পথিকৃৎ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ১২৮তম মৃত্যুদিবস আগামী ২৯ জুলাই৷ এদেশে ধর্মীয় কূপমণ্ডুকতা ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে যে বলিষ্ঠ সংগ্রাম অষ্টাদশ শতকে রাজা রামমোহন রায় শুরু করেছিলেন, সেটা ছিল নবজাগরণের ঊষাকাল৷ তিনি বলেছিলেন, ধর্ম পুস্তকে কোনও কথা লেখা থাকলেই তা অভ্রান্ত হয়ে যায় না৷ যুক্তি ও বিচারের মানদণ্ডে ফেলে তাকে গ্রহণ বা বর্জন করতে হয়৷
এই ধারাতে এদেশের নবজাগরণের আন্দোলন পূর্ণতা পেয়েছিল বিদ্যাসাগরের মধ্য দিয়ে৷ তিনি ছিলেন আমাদের দেশে পার্থিব মানবতাবাদী ধারার শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধি, যিনি আজ থেকে প্রায় পৌনে দুশো বছর আগে দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘‘কতকগুলি বিশেষ কারণে সংস্কৃত কলেজে বেদান্ত ও সাংখ্য আমাদের পড়াতেই হচ্ছে৷ কিন্তু সাংখ্য ও বেদান্ত যে ভ্রান্ত দর্শন, তা নিয়ে আজ আর কোনও বিরোধ নেই৷’’
তৎকালীন তমসাচ্ছন্ন সমাজ পরিবেশে দাঁড়িয়ে সামাজিক অন্যায়–বিচারের বিরুদ্ধে, আধুনিক শিক্ষার প্রসারে এবং নারীর মর্যাদা ও সম্মান রক্ষায় সারা জীবনব্যাপী যে অসামান্য সংগ্রাম বিদ্যাসাগর করে গিয়েছেন, তা অতুলনীয়৷ তাঁর অমিত তেজ, সত্যনিষ্ঠা, সমাজের একেবারে নিচুতলার অসহায় মানুষদের প্রতি বুকভরা ভালবাসা– জীবিতকালেই তাঁকে কিংবদন্তীতে পরিণত করেছিল৷ তিনি যাকে সত্য বলে মনে করেছেন, কোনও শক্তিই তাঁকে সেই সত্যপথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি৷ তার জন্য সারা জীবন অনেক আঘাত, অনেক প্রতিকূলতার মুখোমুখি তাঁকে দাঁড়াতে হয়েছে৷ কিন্তু কোনও কিছুর কাছেই তিনি মাথা নোয়াননি৷ শিক্ষার প্রশ্নে শাসকদের সাথে এক বিরোধের পরিণতিতে বিদ্যাসাগর এককথায় সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদ ছেড়ে দিয়ে বলেছিলেন, প্রয়োজনে আলু–পটল বেচে খাব, কিন্তু গোলামি করব না৷ সত্যের জন্য নিজের সন্তানকে ত্যাজ্যপুত্র করতেও তিনি দ্বিধা করেননি৷ বিদ্যাসাগর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছিলেন, ‘‘দয়া নহে, বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রে প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব৷’’ এই ‘অজেয় পৌরুষ’ আর ‘অক্ষয় মনুষ্যত্বে’র মূলে ছিল দেশের মানুষের প্রতি তাঁর গভীর মমত্ববোধ ও ভালবাসা৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘যে ব্যক্তি যে দেশে জন্মগ্রহণ করেন, সে দেশের হিতসাধনে সাধ্যানুসারে সচেষ্ট ও যত্নবান হওয়া তার পরম ধর্ম ও তাহার জীবনের সর্বপ্রধান কর্ম৷’’
এদেশে আধুনিক শিক্ষার বিস্তারে বিদ্যাসাগরের প্রায় একক সংগ্রাম এমন এক অসাধারণ সংগ্রাম যার নজির শুধু আমাদের দেশে কেন, গোটা বিশ্বে বিরল৷ ২২ বছর বয়সে ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে পাশ্চাত্যের উন্নত জ্ঞানবিজ্ঞান ও রেনেসাঁর চিন্তার সংস্পর্শে এসে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, একমাত্র আধুনিক শিক্ষাই পারে এদেশের মানুষের যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত, রক্তমজ্জায় মিশে থাকা ধর্মান্ধতা, কুসংস্কারের অচলায়তনকে ভাঙতে৷ শিক্ষা নিয়ে ব্যালেন্টাইনের সঙ্গে তাঁর ঐতিহাসিক বিতর্কে তিনি বলেছিলেন, শিক্ষাপদ্ধতি এমন হবে যাতে ছাত্রদের মধ্যে কোনও ভুল ধারণা সৃষ্টি না হয়৷ ব্যালেন্টাইন যেখানে বার্কলের ভাববাদী দর্শন ছাত্রদের পড়াতে বলেছেন, তার বিরোধিতা করে বিদ্যাসাগর বলেছেন, ভাষা সাহিত্য, গণিত, ভূগোল, বিজ্ঞানের পাশাপাশি এমন দর্শন পড়াও যাতে ছাত্রদের মধ্যে যুক্তি ও বিচারবোধ গড়ে ওঠে৷
তাঁর উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠেছিল অসংখ্য স্কুল৷ স্কুল স্থাপনায় তিনি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছুটে বেড়িয়েছেন৷ একটা সময় ইংরেজ শাসকরা এই স্কুলগুলিতে অনুদান বন্ধ করে দিলে তিনি সর্বস্ব দিয়ে স্কুলগুলিকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন৷ এর জন্য হাত পেতে সাহায্য চেয়েছেন৷ ছাত্রদের উপযুক্ত শিক্ষার জন্য যোগ্য শিক্ষক তৈরি, উপযুক্ত মানের পাঠ্যপুস্তক রচনা, তার জন্য বাংলা ভাষাকে আড়ষ্টতা থেকে মুক্ত করে তাকে সাবলীল ও গতিশীল করে তোলা, পাঠ্যপুস্তক ছাপার জন্য মুদ্রণশিল্প স্থাপন– সামাজিক প্রয়োজন হিসাবে যখন যেটা তাঁর সামনে এসেছে, প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন৷ তাঁর লক্ষ্য ছিল, ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত সেকুলার শিক্ষার বিস্তার ঘটানো– যা ছাত্রদের মধ্যে আধুনিক চিন্তা ও মনন গড়ে তুলবে৷ জ্ঞানের আলোয় সমৃদ্ধ হয়ে তাদেরকে সমস্ত প্রকার অন্ধতা ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করবে৷
আজকের ভারতবর্ষে যেখানে ঐতিহ্যের নামে ক্ষমতাসীন শাসকরা দেশকে মধ্যযুগীয় অন্ধকারে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে, মানুষের ধর্মীয় আবেগকে ধর্মীয় উন্মাদনার স্তরে নামিয়ে দিয়ে সংকীর্ণ স্বার্থে সম্প্রদায়গত বিদ্বেষ ও হানাহানিতে মানুষকে ফাঁসিয়ে দেশকে রক্তাক্ত করছে৷ বিদ্যাসাগরের হাত ধরে গড়ে ওঠা এদেশের আধুনিক শিক্ষার ভিত্তিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে শিক্ষায় গৈরিকীকরণ ঘটানোর সার্বিক আয়োজন চলছে– সেখানে বিদ্যাসাগরের চিন্তা ও শিক্ষার চর্চা আজ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়৷ আজ শিক্ষা ও সমাজজীবনে আমরা যে অবক্ষয়ের সম্মুখীন, সেকুলারিজমের ধারণাকে আজ যেভাবে বিকৃত করা হচ্ছে, তার প্রতিকার খুঁজে পেতে আমাদের গভীরভাবে জানতে হবে বিদ্যাসাগরের চিন্তা ও শিক্ষা৷
(৭০ বর্ষ ৪৯ সংখ্যা ২৭ জুলাই, ২০১৮)