একা রামমন্দির হাসতে হাসতে ভোট-বৈতরণী পার করে দেবে–নিশ্চিত ছিলেন বিজেপি নেতারা। তাই, এমনকি অযোধ্যার অসমাপ্ত মন্দিরও বিপুল প্রচার আর প্রবল জাঁকজমকে তড়িঘড়ি উদ্বোধন করে দিলেন প্রধানমন্ত্রী। পাত্তা দিলেন না শঙ্করাচার্যদের আপত্তিকেও। কিন্তু দেশ জুড়ে মাতন তেমন লাগল কই! সাত ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির স্বপ্ন দাগ কাটছে না মানুষের মনে। সব কা সাথ সব কা বিকাশ, ভারতকে বিশ্বগুরু বানানোর স্লোগান পুরনো হয়ে গেছে। সামনে এসে যাচ্ছে মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্বের মতো জ্বলন্ত সমস্যাগুলি। ফলে শত শত কোটি টাকা খরচ করে ‘মোদি কি গ্যারান্টি’-র রঙিন বিজ্ঞাপনে ছয়লাপ করে দিতে হল গোটা দেশ। এখন রেডিও-টিভি-রাস্তাঘাট-রকমারি ওয়েবসাইট– সর্ব দিকেই মোদিজির ‘গ্যারান্টি’-র ফুলঝুরি। ইতিমধ্যে শুরুও হয়ে গেছে বহু প্রতীক্ষিত লোকসভা নির্বাচন। কিন্তু কী আশ্চর্য! প্রথম দফার ভোটে, বিশেষ করে যে অঞ্চলটিকে ‘গো-বলয়’ বলা হয় সেই বিজেপি আধিপত্যের উত্তরপ্রদেশ, বিহার, রাজস্থান ও পশ্চিম মহারাষ্ট্রের হিন্দু সমাজের মধ্যে ভোট দেওয়ার সেই উৎসাহ কোথায়! এমনকি বিজেপির খোদ কর্মী-সমর্থকদের একটা অংশ পর্যন্ত নানা কারণে ভোট না দিয়ে ঘরে বসে থেকেছেন! এই অবস্থায় ভোটবাক্স ভরানোর উদগ্র বাসনায় আবার তাঁদের পুরনো অস্ত্রটিকেই হাতে তুলে নিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ও বিজেপি নেতা-মন্ত্রীরা। দেশের নাগরিকদের হিন্দু-মুসলমানে ভাগ করে হিন্দুদের মনে মুসলিম-বিদ্বেষ জাগিয়ে তুলতে সব মুখোশ খুলে নেমে পড়েছেন বিজেপি নেতারা। বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন মিথ্যাচারের।
গত ২১ এপ্রিল রাজস্থানের বাঁশওয়াড়ায় এবং তার পরের দিন উত্তরপ্রদেশের আলিগড়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কংগ্রেসের ইশতেহারের নিন্দা কর়ে বলেছেন, সেখানে দেশের সম্পদ মুসলমানদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার কথা রয়েছে। অত্যন্ত জঘন্য ভাষা প্রয়োগ করে তিনি বলেছেন, ‘‘কংগ্রেস ক্ষমতা হাতে পেলে আপনাদের সম্পত্তি তুলে দেবে ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ হাতে, তুলে দেবে তাদের হাতে ‘যাদের ঘরে বাচ্চা-কাচ্চার সংখ্যা বেশি’।’’ মোদিজি এমনও বলেছেন যে, দেশের মা-বোনেদের মঙ্গলসূত্র তা-ও নাকি বেহাত হয়ে যাবে।
এমন অবান্তর কথা যে কোনও রাজনৈতিক দলের ইশতেহারেও থাকতে পারে না, সে তারা যতই জনস্বার্থবিরোধী হোক– এ কথা নিতান্ত অন্ধভক্ত না হলে যে কেউই ধরতে পারবেন। তা সত্ত্বেও স্বয়ং দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন এ হেন যুক্তি-বুদ্ধিহীন মিথ্যা প্রচার দিয়ে ভোটের আসর মাত করার চেষ্টা করেন, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে তিনি এবং তাঁর দল এবারের নির্বাচনে জয় সম্পর্কে গভীর অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। শুধু মোদিজি নন, বিজেপি সভাপতি জে পি নড্ডা সহ অন্যান্য নেতারাও যে ভাবে একই গালগল্প ছড়িয়ে চলেছেন, তাতে বোঝা যায়, এবারের ভোটেও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানোর সেই পুরনো হাতিয়ারটিই বিজেপির শেষ সম্বল।
বাস্তবে জাতীয় রাজনীতির মঞ্চে নরেন্দ্র মোদির উত্থানই ঘটেছে উগ্র হিন্দুত্ববাদ তথা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের অস্ত্রটি হাতে নিয়ে। সেই ২০০২ সালে গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনে প্রকাশ্য জনসভায় সরাসরি তিনি মুসলমানদের সন্তানসংখ্যা নিয়ে কুৎসিত বিদ্রূপ করেছিলেন। ওই বছরেই কুখ্যাত গুজরাট গণহত্যার পর রাজ্যের মুসলমানরা যে সব ত্রাণশিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, সেগুলিকে ‘সন্তান উৎপাদনের কারখানা’ আখ্যা দিয়ে দিলেন। গোটা দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ এর তীব্র নিন্দায় ফেটে পড়েছিলেন। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি আর বিজেপি আজ সমার্থক। লোকসভা, বিধানসভা বা আঞ্চলিক– প্রতিটি নির্বাচনেই বিজেপি দলটি নোংরা সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে, দাঙ্গা বাধিয়ে, মেরুকরণ ঘটিয়ে যেন-তেন-প্রকারেণ জেতার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে বার বার এতে সাহায্য করেছেন নরেন্দ্র মোদি সহ বিজেপির তাবড় নেতারা। কখনও মুসলমানদের অনুপ্রবেশকারী আখ্যা দিয়ে, কখনও মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে হিন্দুদের সংখ্যালঘু হয়ে পড়ার অবৈজ্ঞানিক ও অবাস্তব আতঙ্ক ছড়িয়ে, কখনও সিএএ-এনআরসি চালু করে মুসলমানদের নাগরিকত্বকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে মুসলিম বিদ্বেষের রাজনীতি চালিয়ে গেছেন তাঁরা।
সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের এই কুৎসিত রাজনীতি বিজেপি দলটির চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। বাস্তবে এ ছাড়া দেশের সাধারণ মানুষকে মাতিয়ে রাখার অন্য উপায়ও বিশেষ নেই তাদের হাতে। গোটা দেশের অর্থনীতি আজ ভয়ঙ্কর ভাবে বিপন্ন। ব্রিটিশ আমলের চেয়েও দুস্তর বৈষম্য কায়েম হয়েছে দেশের হাতে গোনা একচেটিয়া পুঁজিগোষ্ঠী ও সংখ্যাগরিষ্ঠ খেটে-খাওয়া মানুষের মধ্যে। মূল্যবৃদ্ধি, বেকারিতে জনজীবন বিপর্যস্ত। দেশে নারী-নিরাপত্তার অস্তিত্ব নেই। ধর্ষণ, গণধর্ষণ, নারী-নির্যাতন, নারীহত্যা, শিশুমৃত্যু, নারী ও শিশু পাচারের পরিসংখ্যান ক্রমাগত আকাশ ছুঁতে চলেছে। গৃহহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-চিকিৎসা পরিষেবা বঞ্চিত হয়েছে ধুঁকছে দেশের কোটি কোটি মানুষ। ২০২৩-এর বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ১২৫টি দেশের মধ্যে ভারত নেমে গেছে ১১১তম স্থানে। দেশের সম্পদ মুসলমানদের হাতে চলে যাওয়ার আতঙ্ক ছড়াতে চাইছেন মোদিজি। অথচ বিজেপি-শাসনাধীন কেন্দ্রীয় সরকার নিজেই সেই সম্পদ অর্থাৎ বিমানবন্দর, বন্দর, খনি, বিদ্যুৎ প্রকল্প, রেলদপ্তর থেকে শুরু করে রাষ্ট্রায়ত্ত বহু সংস্থা জলের দরে তুলে দিয়েছে ঘনিষ্ঠ কয়েকজন পুঁজিপতির হাতে। বাস্তবে স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে কেন্দ্রে কংগ্রেস ও বিজেপির শাসনে নিঃস্ব হয়ে গেছেন দেশের অর্ধেক মানুষ। সবার নিচে থাকা দেশের ৫০ ভাগ মানুষের হাতে এখন রয়েছে মোট সম্পদের মাত্র ১ ভাগ। দিনে দিনে আরও ফুলেফেঁপে উঠছে হাতে-গোনা কয়েকটি কর্পোরেট পুঁজিপতির মুনাফার সিন্দুক, আর দিনে দিনে নিঃস্বতর হয়ে যাচ্ছেন কোটি কোটি মেহনতি মানুষ। একটি হিসাবে দেখা যাচ্ছে, দেশের ৭০ কোটি সাধারণ মানুষের মোট সম্পদের সমান সম্পদ কুক্ষিগত করে রেখেছে নরেন্দ্র মোদির ঘনিষ্ঠ মাত্র ২১ জন পুঁজিপতি। ২০১২ থেকে ২০২১-এর মধ্যে দেশে তৈরি হওয়া সম্পদের ৪০ শতাংশই চলে গেছে মাত্র ১ শতাংশের হাতে। দেশে গণতন্ত্রের হাল বিপন্ন। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর আঘাত নামছে। সরকারি নীতির বিরোধিতাকেই রাষ্ট্রবিরোধিতা বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে। হয় কথায় নয় কথায় বিরোধী মত প্রকাশকারীদের জেলে পুরে দেওয়া হচ্ছে, চাপানো হচ্ছে জামিন অযোগ্য কঠিন থেকে কঠিনতর ধারা। এদিকে ২০১৪ সালে প্রথম বার সরকারে বসার পর থেকে জনসাধারণকে দেওয়া বিজেপি সরকারের ‘আচ্ছে দিন’, ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ’ ইত্যাদি প্রতিটি প্রতিশ্রুতিই মিথ্যাচার বলে প্রমাণিত হয়েছে। অতি সম্প্রতি আবার নির্বাচনী বন্ড নিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারি দেশের মানুষের সামনে এই দলটির মনমোহিনী মুখোশের শেষ আবরণটুকুও টেনে ছিঁড়ে দিয়েছে।
সব মিলিয়ে এ বারের নির্বাচনে বিজেপির অবস্থা বিশেষ সুবিধার নয়। মানুষের কাছে কী বলে ভোট চাইবেন, বুঝে উঠতে পারছেন না প্রধানমন্ত্রী সহ বিজেপি নেতারা। তাই শেষ আশ্রয় হিসেবে আবার ঘষে মেজে চকচকে করে তোলার চেষ্টা করতে হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার বিষ-মাখা হাতিয়ারটিকেই। যদিও সেই হাতিয়ার দিয়েও এবার কার্যসিদ্ধি হবে কিনা মোদিজি নিজেও তাতে সন্দিহান। সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই উগ্র হিন্দুত্ববাদের বিরোধী। তাঁরা ভারত দেশটিকে সমস্ত ধর্মের মানুষের স্বভূমি বলেই মনে করেন। আরও একটি বিষয় উল্লেখের দাবি রাখে। গত ১৭ এপ্রিল ছিল রামনবমী। এই দিনটিকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েক বছর ধরে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা উত্তেজক পরিস্থিতি সৃষ্টির অপচেষ্টা চালায়। এ বছর দিনটি ভোটের ঠিক আগে এসে যাওয়ায় সেই সম্ভাবনা এবারেও ছিল প্রবল। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বিহারের এক জনসভায় রামনবমীতে ‘ধর্মবিরোধীদের পাপ মনে রাখা’-র হুমকিও দিয়ে রেখেছিলেন যা সাম্প্রদায়িক প্ররোচনা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কিন্তু এত সত্তে্বও এ বছর কোথাওই এই দিনটিতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি উগ্র ধর্মবাদীরা। স্পষ্টতই এ একটা শুভ ইঙ্গিত। বোঝা যায়, ধর্ম-বর্ণ-জাত-পাত নির্বিশেষে জীবনযন্ত্রণায় জেরবার সাধারণ মানুষ সাম্প্রদায়িক বিভেদ তৈরির এই নোংরা প্ররোচনায় পা দিতে আর রাজি নয়। ফলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর দলবল যতই তাঁদের সাম্প্রদায়িক বিভেদের অস্ত্রে শান দিন, আশা করাই যায়, সে অস্ত্রকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলবে দেশের গণতন্ত্রপ্রিয় শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ।