২৯ ডিসেম্বর আরও একটি নির্ভয়া দিবস পার হয়ে গেল। কতটা অভয় মহিলাদের দিতে পারল রাষ্ট্র? মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে চূড়ান্ত দায়িত্বহীনতাই প্রকাশ পাচ্ছে সরকারের। ২০১২ সালে ১৬ ডিসেম্বর দিল্লির প্যারামেডিকেল ছাত্রী নির্ভয়ার উপর নরপিশাচদের অত্যাচারে শিউরে উঠেছিল সারা দেশের মানুষ। ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছিল। দিল্লির হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডার মধ্যেও জনসাধারণের ঐতিহাসিক আন্দোলনের সাক্ষী ছিল গোটা দেশ। নির্ভয়াকে বাঁচানো যায়নি। ২৯ ডিসেম্বর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সে। দেশজোড়া বিক্ষোভের মুখে কংগ্রেস সরকার ‘নির্ভয়া তহবিল’ ঘোষণা করে, যা মহিলাদের নিরাপত্তা ও উন্নয়নে ব্যয় করা হবে বলে ব্যাপক প্রচারও হয়েছিল। কিন্তু প্রচারই সার, কাজ কিছুই হয়নি। পরবর্তীকালে বিজেপি সরকার কি করেছে? মহিলাদের প্রতি সহৃদয়তার নমুনা হল– ২০১৩-২০২০ পর্যন্ত ওই তহবিলের ৬৪ শতাংশ টাকা খরচই করা হয়নি। খরচ করা অংশও অন্য কাজে (বাড়ি তৈরিতে) ব্যবহার করা হয়েছে। যে কাজগুলির প্রয়োজন ছিল, অর্থাৎ মহিলাদের আর্থিকভাবে স্বনির্ভর করে তোলায়, তাঁদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি কিছুই প্রায় হয়নি। অথচ মহিলাদের উপর নির্যাতনের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ২০১৫ সালেই বহু ঢাকঢোল পিটিয়ে মহিলা ও শিশুদের নিরাপত্তা এবং তাদের মধ্যে শিক্ষার আলো ও স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ প্রকল্পের ঘোষণা করেছিল। বেটিরা কতটা শিক্ষার মুখ দেখেছে, চিকিৎসার সুযোগ পেয়েছে কিংবা তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কেমন– সে সমস্ত দেখার আগে সংসদীয় কমিটির রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।
রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, রাজ্যগুলি ৬ বছরে এই প্রকল্পের মাত্র ২৫ শতাংশ খরচ করেছে। ৭৯ শতাংশ অর্থাৎ ৪৪৭ কোটি টাকা খরচ হয়েছে শুধু বিজ্ঞাপনেই। বিজেপি সাংসদ গাভিট সম্প্রতি এই তথ্য সংসদে পেশ করেছেন। তাহলে নিরাপত্তায় কত খরচ হয়েছে, দেশের মহিলা ও শিশুরাই বা কতটা নিরাপদে রয়েছেন?
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-তে শিশুদের উপর ১ লক্ষ ২৮ হাজার ৫৩১টি অপরাধের ঘটনা ঘটেছে, এই সংখ্যাটা নথিভুক্ত হওয়া ঘটনা। নথিভুক্ত হয়নি এমন অসংখ্য ঘটনা রয়েছে। আর মহিলাদের নিরাপত্তা? এনসিআরবি-র তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-তে প্রায় চার লাখ মহিলার উপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। ন্যাশনাল কমিশন ফর উইমেন (এনসিডব্লিউ)-র তথ্যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি প্রকাশ পেয়েছে, ২০২০-র তুলনায় ২০২১-এ মহিলাদের উপর অত্যাচার বেড়েছে ৩০ শতাংশ। (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-১ জানুয়ারি, ২০২২)
শিশুকন্যা এবং মহিলাদের উপর নির্যাতন কি শুধু আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা, নাকি সামাজিক সমস্যা? ঘটনা নথিভুক্ত হওয়া না হওয়া আইন-শৃঙ্খলার বিষয়, প্রভাবশালীরা এ ধরনের দুষ্কর্মে যুক্ত থাকলে বহু সময়েই থানা অভিযোগ নিতে চায় না। এ কথা ঠিক, পুলিশ-প্রশাসন তৎপর হলে অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে শাস্তি দেওয়াও সম্ভব। কিন্তু এ রকম অসংখ্য ঘটনা ঘটার মূল কারণ বর্তমানের পুঁজিবাদী সমাজের পচা-গলা অবক্ষয়ী সংস্কৃতি, তার দোসর মদের ঢালাও প্রসার। তার পাল্টা উন্নত সংস্কৃতির চর্চা সমাজের মধ্যে না হলে এ ধরনের ঘটনা আটকানো যাবে না। ওই অবক্ষয়ী সংস্কৃতি চার হাত-পায়ের মানুষকে নরপশুতে পরিণত করে, প্রকৃত মানুষ হিসাবে গড়ে ওঠার পথে হিমালয়-সমান বাধা সৃষ্টি করে। যুবকেরা অবক্ষয়ী সংস্কৃতি বহন করে চললে এই সমাজের ‘রক্ষক’ শাসক দলগুলির সুবিধা। দুর্নীতিতে ডুবে থাকা, নিম্ন রুচি-সংস্কৃতি-মূল্যবোধ নিয়ে চলা এই দলগুলি ওই নরপশুদের তাঁবে রাখে, এদের সাহায্যে নানা রকম অপকর্ম করে। তাই তারা এই শক্তির বাড়বাড়ন্ত চায়। তাদের প্রশ্রয়েই এই রক্তবীজের ঝাড় বেড়ে ওঠে। ঘটে চলে একটার পর একটা পৈশাচিক ঘটনা– ধর্ষণ, খুন, যৌন-অত্যাচার। একটা নৃশংস ঘটনা আর একটাকে ছাড়িয়ে যায়।
বেটি বাঁচাও-এর প্রচার চলবে, পাশাপাশি মহিলাদের উপর অত্যাচার, ধর্ষণ, খুনের ঘটনাও কি চলতেই থাকবে? যারা আত্মসর্বস্বতা আঁকড়ে জীবন নির্বাহ করেন না, যারা সমাজ-বিমুখ মানসিকতা নিয়ে চলেন না, তাঁরা এ ধরনের নৃশংস ঘটনায় অন্তরিকভাবে কষ্ট পান, হৃদয়ে তাঁদের রক্তক্ষরণ হয়। কিন্তু তাঁরা বুঝতে পারেন না, কীভাবে এই সমস্যাকে নির্মূল করা সম্ভব। সরকারে আসীন দল কিংবা ক্ষমতালোভী দলগুলির জনদরদি মুখোশ খুলে দিয়ে এর বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হওয়ার দিন এসেছে আজ। প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে, বিজ্ঞাপনই যে বিজেপি-কংগ্রেসের একমাত্র ঢাল, তারা সত্যিই বেটিদের নিরাপত্তার জন্য কতটা ভাবে? আসলে সরকারের ‘বেটি বাঁচাও’ প্রকল্পের ফানুস ফুটো হয়ে গেছে।