70 Year 32 Issue 30 March 2018
মণিপুরে অনুষ্ঠিত ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে ১৬ মার্চ কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী হর্ষবর্ধন দাবি করেছেন, সদ্যপ্রয়াত খ্যাতনামা বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং বলেছেন, ‘বেদের ত্ত্বগুলি সম্ভবত আইনস্টাইনের বিখ্যাত E=mc2 সূত্রের চেয়েও উন্নত৷’’ এমন এক উদ্ভট দাবির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে মন্ত্রী মশাই–এই তথ্যের উৎস দেখাতে ব্যর্থ হন৷
অধ্যাপক হকিং ব্যক্তিগতভাবে বৈজ্ঞানিক যুক্তিধারার দৃঢ় সমর্থক এবং কোথাও কখনও এমন মন্তব্য করেননি৷ ‘ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স রিসার্চ অন বেদা’ নামের একটি সংগঠন তাদের ওয়েবসাইটে এমন কিছু ভিত্তিহীন দাবি করেছেন এবং মাননীয় মন্ত্রী এগুলির স্বীকৃতি দিয়ে প্রসার ঘটাতে চাইছেন৷ অনেকেই জানেন, ১৯ জানুয়ারি মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের একজন রাষ্ট্রমন্ত্রী এমন কথাও বলেছিলেন, ডারউইনবাদ ভুল, সিলেবাস থেকে তা বাদ দেওয়া দরকার
উদ্বেগের বিষয়, অবৈজ্ঞানিক এবং ভিত্তিহীন এসব ভাবনা ধারণার প্রচারের জন্য বারবার বিজ্ঞান কংগ্রেসের মতো মঞ্চকেই বেছে নেওয়া হচ্ছে৷ ২০১৫ সেলে ১০২তম বিজ্ঞান কংগ্রেসে জনৈক ক্যাপ্টেন বোদা দাবি করলেন, বিমান বৈদিক যুগের আবিষ্কার তাঁর আরও বক্তব্য সে যুগের বিমানগুলি সামনের দিক দিয়ে, পিছনের দিক দিয়ে, ডান দিক ও বাম দিক দিয়েও উড়তে পারত এবং মুনি ঋষিরা এতে চেপে গ্রহান্তরেও যেতে পারতেন! এখন এই বিজ্ঞান–প্রযুক্তি মন্ত্রী বিজ্ঞানী হকিং–এর নাম জড়িয়ে যে দাবি পেশ করলেন, তা প্রায় সব কিছু ছাপিয়ে গেল৷ আধুনিক বিজ্ঞানের সব আবিষ্কারই বেদে ছিল– এই দাবিটি নতুন কিছু নয়৷ প্রখ্যাত বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা সহ অনেককেই এই ধারণার বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে লড়তে হয়েছে৷ মজার বিষয় হল, এই সব হাস্যকর দাবিগুলির কোনওটিই কিন্তু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের আগে করা হয় না এবং সেই দাবির সপক্ষে কোনও প্রমাণ বা সূত্রও জানানো হয় না৷ বরং সবক্ষেত্রেই বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করার পর বলা হয়– হাজার হাজার বছর আগে বেদে এই আবিষ্কারের নিদর্শন আছে৷ ভারতীয় সংবিধানের নামে শপথ নিয়েছেন যে সব মন্ত্রী, তাঁদের বোধহয় জানা নেই, এই সংবিধানের ৫১ (এ) অনুচ্ছেদটি৷ যেখানে উল্লেখ রয়েছে– দেশবাসীকে কুসংস্কার–গোঁড়ামি মুক্ত করে বিজ্ঞানের আলোকে শিক্ষাদান এবং যুক্তিভিত্তিক জ্ঞানচর্চার স্বাধিকার রক্ষা সরকারের দায়িত্ব৷ অথচ নেতা–মন্ত্রীদের এই বচনগুলি সরাসরি সংবিধানের উক্ত ধারার বিরোধী৷
বিজেপি নেতা–মন্ত্রীদের এই উক্তিগুলি যতই হাস্যকর হোক, তা কিন্তু আকস্মিক বা অপরিকল্পিত নয়৷ শিক্ষা তথা জ্ঞানচর্চার উপর এই আক্রমণ আজ শাসক শ্রেণির স্বার্থেই প্রয়োজন৷ সমাজে কোটি কোটি শিক্ষিত বেকার হন্যে হয়ে দেশ–দেশান্তরে ঘুরছে৷ শিল্প–কলকারখানা বন্ধ, অফিস আদালতে কাজ নেই৷ কেন নেই? কেন জনগণের টাকা লুঠ হচ্ছে? ১ শতাংশেরও কম মানুষের হাতে বিশ্বের ৯০ শতাংশেরও বেশি সম্পদ জমা হচ্ছে কেন? ইত্যাদি প্রশ্ন যাতে না ওঠে সেজন্য মানুষকে যুক্তির বদলে বিশ্বাস নির্ভর করে দেওয়া আজ শাসকশ্রেণির প্রয়োজন৷ এই লক্ষ্যেই শোষক শ্রেণি চায় মানুষকে ধর্মে–বর্ণে বিভক্ত করে ঐক্য বিনষ্ট করতে৷ চিন্তায় গোঁড়ামি, যুক্তিহীনতা এনে দিশাহীন করে দিতে৷ তাই সত্য বিকৃতি, ইতিহাস বিকৃতি, আর ছদ্ম দেশপ্রেমের জোয়ার বইয়ে দেওয়া৷ এ এক আদিম যুগে পৌঁছে যাওয়ার নতুন আহ্বান৷ এর প্রতিরোধ চাই৷
উৎসাহের কথা, বিজ্ঞানকে বিকৃত করার এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা সরব৷ দেশে দেশে এই ধরনের আক্রমণের হাত থেকে সমাজ, সভ্যতা, মনুষ্যত্বকে রক্ষা করে ভাবী প্রজন্মের জন্য এক উন্নত পৃথিবী গড়তে চাই যুক্তিবিজ্ঞান নির্ভর আদর্শ ভিত্তিক সংগ্রাম৷