আজ যেমন আছে ‘ইন্টারনেট’, তেমনি মহাভারতের যুগে ছিল ‘সঞ্জয়’৷ সেই ‘সঞ্জয় টেকনিক’ থেকেই নাকি এখনকার ইন্টারনেটের সৃষ্টি বলেছেন ত্রিপুরায় বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব৷ জানেন কি, সীতার জন্ম প্রমাণ করে রামায়ণের যুগেও টেস্ট–টিউব বেবি ছিল? এই তথ্য জানিয়েছেন উত্তরপ্রদেশের উপ–মুখ্যমন্ত্রী দীনেশ শর্মা৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মন্তব্য– রামায়ণ–মহাভারতে যুগে অবশ্যই জেনেটিক্স ছিল৷ কী করে তিনি জানলেন? কেন, এ কথা তো সকলেরই জানা যে, কর্ণের জন্ম মাতৃগর্ভে হয়নি জেনেটিক্স যদি না থাকত, তাহলে কর্ণের জন্ম সম্ভব হল কী করে ফলে আপনিও না মেনে যাবেন কোথায়? তাছাড়া, প্রধানমন্ত্রীর বাণী বলে কথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রাধামোহন সিং–এর উক্তি– যজ্ঞ করুন আর বিশেষ যোগবলের অধিকারী হন৷ কেন না, ‘বিশেষ যোগবলেই কৃষিবীজে পরমাত্মার শক্তি বপন করা যায়’৷ বিজেপি সাংসদ শঙ্কর ভাইয়ের উপদেশ, গোমূত্র পান করুন, জটিল রোগ সারবে৷ কারণ, গোরু নাকি এমন প্রাণী যে নিশ্বাসের সঙ্গে অক্সিজেন ত্যাগ করে!
এ হেন হাজারো অবৈজ্ঞানিক যুক্তিহীন ও হাস্যকর দাবি জোর গলায় প্রচার করে চলেছেন আরএসএস–বিজেপির নেতা–মন্ত্রীরা৷ দেশের শিক্ষিত মানুষের কাছে পরিহাসের পাত্র হওয়ার ঝুঁকি উপেক্ষা করে এসব কথা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ভিত্তিতেই ধারাবাহিক ভাবে সুকৌশলে প্রচার করাচ্ছে সংঘ পরিবার৷ ঘটনার শুরু নরেন্দ্র মোদিকে দিয়ে৷ ক্ষমতায় এসেই ২০১৪ সালের বিজ্ঞান কংগ্রেসের উদ্বোধনী মঞ্চে গণেশের ধড়ে হাতির মাথা দেখিয়ে বলেছিলেন, প্রাচীনকাল থেকেই যে প্লাস্টিক সার্জারি চলে আসছে, গণেশের মূর্তিই তার অকাট্য প্রমাণ৷ বিমান আবিষ্কার, স্টেম সেল, কোয়ান্টাম মেকানিক্স, এমনকী হাইজেনবার্গের আনসার্টেনটি প্রিন্সিপলও বাদ যায়নি এদের এই বিজ্ঞানবিরোধী অপপ্রচার থেকে৷ যে ডারউইনবাদের উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে আধুনিক জীববিজ্ঞান, সেই তত্ত্বকেও এমনকী ভুল বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন কেন্দ্রের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী সত্যপাল সিং৷
কেন বিজেপি এমন করছে? আসলে, ফ্যাসিবাদী আদর্শের ধারক–বাহক হিসাবে এরা সত্যকে, বিজ্ঞানকে জীবন থেকে বিসর্জন দিয়েছে৷ বিজ্ঞানকে তাদের প্রয়োজন শুধুমাত্র প্রযুক্তির উন্নতির জন্য৷ কিন্তু বৈজ্ঞানিক মনন, বিজ্ঞানের যুক্তির কাঠামোর উপর শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সত্যসন্ধানী মানসিকতা– সে সবকে বড় ভয় এদের৷ তারা যে শুধু মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য এ সব হাবিজাবি প্রচার করে চলেছে, তাই নয়৷ তাদের লক্ষ্য, দেশের মানুষের চিন্তা–চেতনা–মনন– বিজ্ঞানবিরোধী অন্ধ ধ্যানধারণা ও কুসংস্কার গেঁথে দেওয়া৷ তা না হলে, হিন্দুত্ববাদের প্রভাব সমৃদ্ধ উগ্র জাত্যাভিমান ও মৌলবাদী চেতনা তাদের মধ্যে বিনা বাধায় সঞ্চার করা যাবে কী করে এইভাবেই তারা তৈরি করতে চায় হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক৷ সেই ভোটব্যাঙ্ককে গদির দখলে সুবিধাকেই৷ এই পথেই দেশে ফ্যাসিবাদ কায়েম করার পথে হাঁটছে তারা৷ যুক্তিভিত্তিক ক্রিয়ার বদলে এরা চায় জনসাধারণকে পশুর মতো একটা হুকুম পালন করার যন্ত্রে পরিণত করতে৷
যুগে যুগে শাসক শ্রেণি এটাই চেয়ে আসছে৷ কারণ, তাহলে মানুষ প্রশ্ন করতে ভুলে যাবে– কেন দেশে এই ভয়ঙ্কর বেকার সমস্যা৷ কেন জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছুঁয়েছে৷ কেন ফসলের দাম না পেয়ে চাষিকে আত্মহত্যা করতে হয়৷ বিজ্ঞান ভুলিয়ে দিতে পারলে মানুষ বুঝতেই পারবে না, আসলে যে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থায় আমরা রয়েছি, শোষণমূলক সেই অন্যায় ব্যবস্থার মূলগত নিয়মের কারণেই সাধারণ মানুষের জীবনে এত সংকট৷ এই সমাজব্যবস্থার নিয়মেই সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের জীবনে সমস্যার জোয়ার আর অল্পসংখ্যক একদল মালিকের পুঁজির পাহাড় দিন দিন আকাশ স্পর্শ করছে৷ শোষিত মানুষ যদি প্রশ্ন তুলতেই ভুলে যায়, তাহলে নিষ্ক্ন্টক হবে শাসকের সিংহাসন৷ বিজ্ঞানের আলো থেকে বঞ্চিত কুসংস্কারের বোঝা মাথায় নিয়ে নেতাদের মুখের দিকে তাকিয়ে অন্ধের মতো পথ চলা সাধারণ মানুষ নিয়তির দোহাই দিয়ে মেনে নিতে থাকবে যাবতীয় অন্যায় অত্যাচার৷ এতে সুবিধা হবে দেশের পুঁজিপতি শ্রেণির৷ তারা নিশ্চিন্তে দেশের মানুষকে শোষণ করতে পারবে, অবাধে লুঠ করতে পারবে দেশের সমস্ত সম্পদ৷ তাই তো তারা দু’হাতে টাকা ঢেলে যাচ্ছে বিজেপি–আরএসএসের পিছনে৷ বিজেপি–সংঘ পরিবারের নেতারাও বিজ্ঞানের নামে দেদার ঠগবাজি চালিয়ে যাচ্ছে৷ আশার কথা, দেশের প্রতিথযশা বিজ্ঞানী সহ অসংখ্য গবেষক, শিক্ষক–ছাত্র–ছাত্রী আজ এইসব ভাঁওতাবাজি ধরে ফেলেছেন৷ দেশের প্রধান শহরগুলিতে তাঁরা মার্চ ফর সায়েন্স–এর আয়োজন করে চলেছেন৷ বিজ্ঞানকে বাঁচাতে সচেতন মানুষ আজ রাস্তায়৷ এটাই ভবিষ্যতেতাদের বাঁচার একমাত্র রাস্তা৷
(৭১ বর্ষ ৪ সংখ্যা ২৪ আগস্ট, ২০১৮)