সাম্প্রতিক উপনির্বাচনগুলিতে বিজেপি যেভাবে পরাস্ত হয়েছে তাতে স্পষ্ট, জাতপাত–ধর্ম নিয়ে বিজেপির কৌশলী রাজনীতি জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলিকে চাপা দিতে পারেনি৷ মানুষের ক্ষোভ আছড়ে পড়েছে বিজেপির বিরুদ্ধে৷এবার চারটি লোকসভার মধ্যে তিনটিতে এবং এগারোটি বিধানসভার মধ্যে ১০টিতেই পরাস্ত হয়েছে বিজেপি৷ বিজেপির দখলে থাকা উত্তরপ্রদেশের কৈরানা লোকসভার নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নিজে নির্বাচনী সভা করেছেন, মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ তো পড়ে থেকেছেন৷ এছাড়াও বিজেপির এক ঝাঁক নেতা–মন্ত্রী চেষ্টার কসুর করেননি৷ ধর্মীয় মেরুকরণের চেষ্টাও কম করেননি তাঁরা৷ তা সত্ত্বেও সেখানে পরাস্ত হয়েছে বিজেপি৷
ক্ষমতায় বসার আগে বিজেপি নেতারা উন্নয়নের অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন৷ বলেছিলেন, বিজেপি শাসনে সবার জীবনে ‘আচ্ছে দিন’ আসবে৷ প্রধানমন্ত্রী স্লোগান তুলেছিলেন, ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’৷ বলেছিলেন, বছরে ২ কোটি বেকারকে চাকরি দেবেন৷ গত চার বছরে এসব মিথ্যার স্বরূপ বেড়িয়ে পরেছে৷ বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে৷ নোট বাতিলে কালো টাকা উদ্ধার হয়নি, মানুষ নাজেহাল হয়েছেন৷ প্রস্তুতিহীন জিএসটি চালু ক্ষুদ্র ব্যবসার সর্বনাশ করেছে৷ লক্ষ লক্ষ শ্রমিক–কর্মচারীকে বেকার করে দিয়েছে৷ চাষিদের আত্মহত্যার মিছিল আরও দীর্ঘ হয়েছে৷ শ্রম–আইন সংস্কারের নামে শ্রমিকদের উপর শোষণ আরও তীব্র হয়েছে৷ ধনী–দরিদ্রে বৈষম্য আরও দ্রুত গতিতে বেড়েছে৷ শিল্পপতি–পুঁজিপতিরা অবাধে লুঠতরাজ চালাচ্ছে৷ প্রমাণ হয়েছে বিজেপি শাসন আলাদা কিছু নয়৷ বাস্তবে এমনটাই হওয়ার কথা ছিল৷ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যে দল পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থে কাজ করবে তারাই শেষ পর্যন্ত জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে৷
উন্নয়নের ফোলানো বেলুন চুপসে যেতেই বিজেপি নেতারা আস্তিনে লুকানো মেরুকরণের অস্ত্রটি বের করে এনেছেন৷ ধর্ম–বর্ণ–জাতপাত ভিত্তি করে একের পর এক দাঙ্গা–সংঘর্ষ লাগিয়ে মানুষের মধ্যে বিভেদের আগুন জ্বালিয়েছেন৷ সাময়িকভাবে তার ফলও পেয়েছেন তাঁরা৷ একের পর এক রাজ্যে ক্ষমতা দখল করেছেন৷ এবারের উপনির্বাচনগুলি যেন সেই রাজনীতিতে লাগাম পরাল৷ এবার বিজেপির বিরুদ্ধে বিরোধী কিছু দলের ঐক্য দেখা গেছে যা বিজেপিকে পরাস্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে৷ বিজেপির জনবিরোধী শাসনের পরিণামে জনসমর্থনে ভাটা অব্যাহত থাকলেও মূলত বিরোধী জোটই বিজেপিকে ঘায়েল করেছ৷
এ রাজ্যে কয়েক বছর আগে সিপিএমের অবাম এবং জনবিরোধী শাসনে অতিষ্ঠ হয়ে মানুষ তৃণমূলকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল৷ কিন্তু তৃণমূলের রাজনীতিও বুর্জোয়াদের স্বার্থরক্ষাকারী, স্বাভাবিকভাবেই জনবিরোধী চরিত্রের কারণে তার বিরুদ্ধেও জনসাধারণের ক্ষোভ ক্রমাগত বাড়ছে৷ সেই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে তৃণমূলের বিকল্প হিসাবে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি নিজেকে তুলে ধরার চেষ্টা করছে৷ অতীতে এ রাজ্যে কংগ্রেস শাসনে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠলে তাকে সরানোর জন্য ঠিক একই ভাবে সিপিএমকে তুলে ধরা হয়েছিল এবং মানুষ কোনও বিচার না করে তাকে সমর্থন করেছিল৷ তারপর তৃণমূলকে আনা হল৷ এখন আবার তৃণমূলের বিকল্প হিসাবে বিজেপির কথা হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যাতে মানুষ চিরকাল শাসক শ্রেণির একটি দলের পরিবর্তে আর একটি দলের মধ্যেই চরকি পাক খেতে থাকে, যাতে তাদের স্বার্থরক্ষাকারী দলকে কিছুতেই চিনতে না পারে৷
দেশজোড়া উপনির্বাচনে বিজেপির পরাজয় থেকে কি এ কথা বলা চলে– সাম্প্রদায়িকতা পরাস্ত হল? গত চার বছর ধরে বিজেপি–আরএসএস ধর্মীয়–জাতিগত বিদ্বেষের যে বিষ গোটা সমাজ জুড়ে ঢেলে দিয়েছে তা কি শুধুমাত্র নির্বাচনে তাদের পরাস্ত করার দ্বারা দূর হতে পারে– যদি তাকে আদর্শগত ভাবে পরাস্ত করা না যায়? একচেটিয়া পুঁজিপতিদের একটি অংশ নানা কারণে বিজেপির বিকল্প হিসাবে কংগ্রেসকে তুলে ধরছে৷ ফলে কর্পোরেট মিডিয়াও বিরোধী জোটের নেতা হিসাবে কংগ্রেসকেই জনমনে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে৷ কিন্তু কংগ্রেস কি আদর্শগত ভাবে বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে মোকাবিলা করতে পারে? কংগ্রেসের ইতিহাস তা বলে না৷ কংগ্রেসের দীর্ঘ দিনের ‘নরম’ সাম্প্রদায়িক রাজনীতিই তো দেশজুড়ে বিজেপির উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রসারের জমি তৈরি করে দিয়েছে৷ বিজেপির বিরোধিতা করা মানেই কি বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরোধিতা করা, ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে লড়াই করা? মোটেও তা নয়৷ তা যদি হত তবে এর আগে অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকারের পতনের পর বিজেপি আর মাথা তুলতে পারত না৷ কংগ্রেসের বিজেপি বিরোধিতা কোনও নীতি বা আদর্শগত বিরোধিতা নয়, ভোট রাজনীতির বিরোধিতা, ক্ষমতায় বসে পুঁজিপতিদের সেবক হওয়ার প্রতিযোগিতা– যেমন বিরোধী বুর্জোয়া–পেটি বুর্জোয়া সব দলই ভোট রাজনীতির স্বার্থে শাসক দলের বিরোধিতা করে, তেমনই৷ এই বিরোধী জোটের মধ্যে মায়াবতী অখিলেশ লালুপ্রসাদদের মতো জাতপাত ভিত্তিক রাজনীতিকরাও রয়েছেন, যাঁরা বিজেপির উচ্চবর্ণবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে নিম্নবর্ণবাদী রাজনীতি করছেন৷ এটাও এক ধরনের বিভেদমূলক রাজনীতি৷ এ ছাড়াও আঞ্চলিকতাবাদী দলগুলিও রয়েছে৷ এদের কারোরই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ অবস্থান নেই৷
তা হলে কারা পারে বিজেপি–আরএসএসকে আদর্শগত ভাবে মোকাবিলা করতে? পারে তারাই যারা নিজেরা যথার্থই ধর্মনিরপেক্ষ এবং ধর্ম–জাতপাত নিয়ে নিজেরা রাজনীতি করে না শুধু নয়, এর মারাত্মক ফলটা শোষিত মানুষের সামনে তুলে ধরে৷ যারা পরিষ্কার বোঝে, বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য শোষিত মানুষকে বিভক্ত করে শোষক শ্রেণির বিরুদ্ধে তাদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামকে দুর্বল করা, পুঁজিপতি শ্রেণির শোষণের রাজনীতিকে আড়াল করা, জাত–ধর্ম নির্বিশেষে দরিদ্র শোষিত মানুষের সকল দুরবস্থার জন্য যে পুঁজিপতি শ্রেণির শোষণই দায়ী, এই মূল বিষয়টিকে আড়াল করা৷ বিজেপি–আরএসএসের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সাথে যে যথার্থ ধর্মচর্চার কোনও সম্পর্ক নেই, তারা যে পুঁজিপতি শ্রেণির এজেন্ট হিসাবেই কাজ করছে, এ বিষয়টি মানুষের কাছে স্পষ্ট করে তুলে ধরতে পারে তারাই যারা শোষিত মানুষের শোষণমুক্তির জন্য শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াই করছে৷ একমাত্র যথার্থ বামপন্থীরাই এ কাজ করছে৷
পুনর্লিখনের নামে বিজেপি ইতিহাসকে বিকৃত করছে, শিক্ষার সিলেবাসে ইতিহাসের নামে বিকৃত এবং অবৈজ্ঞানিক তথ্য ছাত্রদের মনের মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছে, আরএসএসের সংগঠিত হাজার হাজার সুক্লে তরুণ ছাত্রদের হিন্দুত্বের ছাঁচে গড়ে তুলছে, স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসকেও বিকৃত করে তুলে ধরছে৷ এসবেরই আসল উদ্দেশ্য এক দল ছাঁচে ঢালা মানুষ তৈরি করা– যারা প্রশ্ন করবে না, নেতৃত্বকে অন্ধের মতো মেনে চলবে৷ এ একটা বিশেষ মনন প্রক্রিয়া, যা একবার কার্যকর হলে সমাজে মানুষ গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটাই ধ্বংস হয়ে যায়৷ জার্মানি ইটালিতে ফ্যাসিবাদ গড়ে ওঠার ইতিহাস সে শিক্ষা রেখে গেছে৷ বিজেপি এদেরই উত্তরাধিকারী৷
স্বাভাবিক ভাবেই কোনও জাতপাতভিত্তিক আঞ্চলিক বুর্জোয়া দল নয়, বুর্জোয়াদের স্বার্থরক্ষাকারী কোনও জাতীয় দল নয়, একমাত্র যথার্থ বামপন্থী দলই যথার্থ ধর্মনিরপেক্ষ হিসাবে বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মোকাবিলা করতে পারে৷ কারণ যথার্থ বামপন্থীরাই একমাত্র নিজেরা আদর্শগত এবং নীতিগত ভাবে জাতপাত–ধর্ম–বর্ণে বৈষম্য থেকে মুক্ত৷
এঁরাই প্রতিদিনকার আচরণে ধর্মনিরপেক্ষ ভূমিকা নেন৷ এঁদের রাজনীতির ভিত্তি বিজ্ঞানের যুক্তি এবং ইতিহাসের শিক্ষা৷ শুধুমাত্র ভোটের দ্বারা বিজেপি–আরএসএসের এই রাজনীতিকে পরাস্ত করা যায় না৷ একে পরাস্ত করতে হলে চাই একদিকে এর বিরুদ্ধে তীব্র আদর্শগত সংগ্রাম, অন্য দিকে মানুষের জীবনের দাবিগুলি নিয়ে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তোলা এবং সেই আন্দোলনে ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে শোষিত মানুষের অংশগ্রহণ৷ বামপন্থার রাস্তা পরিত্যাগ করে ভোট রাজনীতিতে সহজে সাফল্যের আশায় যাঁরা কংগ্রেসের হাত ধরে সাম্প্রদায়িকতা রুখবেন বলে ভাবছেন তাঁরা ক্ষতি করছেন বামপন্থারই৷
গণআন্দোলনের ময়দানেই শোষিত মানুষ ধরতে পারে ধর্ম নয়, জাত নয়, তার সবচেয়ে বড় পরিচয় সে শোষিত মানুষ৷ শোষণমুক্তির জন্য তার প্রয়োজন জাত–ধর্ম নির্বিশেষে শোষিত মানুষের ঐক্য৷ সাম্প্রদায়িকতা জাতিভেদ এই ঐক্যে বিঘ্ণ ঘটায়৷ এটা এক নতুন চেতনা৷ চেতনার এই উত্তরণের মধ্য দিয়েই আদর্শগত ভাবে বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে পরাস্ত করা সম্ভব৷
(৭০ বর্ষ ৪২ সংখ্যা ৭জুন, ২০১৮)