মুখে ‘সকলের জন্য স্বাস্থ্য’ ঘোষণা
ঝাঁ চকচকে শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্স, আলোকোজ্জ্বল বহুতল – রাস্তাঘাট, পার্ক, চার থেকে আট লেনের হাইওয়ে, পাঁচতারা থেকে সাততারা হোটেল, রেস্টুরেন্ট, স্টেডিয়াম, শহরের বিভিন্ন প্রান্তকে জুড়ে দেওয়া ব্রিজ ও ফ্লাইওভার, ভূগর্ভস্থ রেল, অদূর ভবিষ্যতে মাটি কাঁপিয়ে চলা বুলেট ট্রেনের স্বপ্ন ইত্যাদি দেখে ও শুনে মনে হতেই পারে দেশটা সত্যিই উন্নতির ও বিকাশের শিখরে পৌঁছে গেল বলে৷ প্রধানমন্ত্রীর ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ’ স্লোগানে দেশের এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্ত নিনাদিত৷ তবু স্বাধীনতার ৭০ বছর পার করে শিক্ষা–খাদ্য–কর্মসংস্থানের মতোই ‘সকলের জন্য স্বাস্থ্য’ আজও এদেশে বহুল প্রচারিত ‘বিকাশ’–এর মতোই একটি ‘ঘোষণা’ মাত্র৷
পরিসংখ্যান বলছে আজও প্রসবকালীন মায়ের মৃত্যুতে (প্রতি হাজারে ১৭৮), ৫ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুতে (প্রতি হাজারে ১২৬) এদেশ বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউ এইচ ও)–র মানদণ্ডে ১৯০টি দেশের মধ্যে স্বাস্থ্যব্যবস্থার নিরিখে আমাদের দেশ ১১২ তম৷ প্রতিদিন এদেশের ৬০০০ জন যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন আর এই রোগে প্রতি পাঁচ মিনিটে মারা যান ২ জন৷
এই যখন দেশের প্রকৃত স্বাস্থ্যচিত্র তখন ‘আচ্ছে দিন’–এর কান্ডারি কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ২০১৭–২০ এই তিন বছরের জন্য স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দ প্রায় ২০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে৷ ২০১৪ সালে কেন্দ্রে বিজেপি যখন ক্ষমতায় আসে সে বছর স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দ ছিল ৩৭,৩৩৩ কোটি টাকা, ২০১৫ তে সেটাই ৩৩,১৫০ কোটি টাকা – মোট বাজেট বরাদ্দের ১.২ শতাংশ৷ আর এ বছর জাতীয় স্বাস্থ্যমিশন শিশুমৃত্যু, প্রসবকালীন মায়ের মৃত্যু, কালাজ্বর–ম্যালেরিয়া রোখার অঙ্গীকার করে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের কাছে প্রায় ১ লক্ষ ৫৯ হাজার কোটি টাকা (২০১৭–’২০ এই তিন বছরের জন্য) দাবি করার পরেও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক অধুনা প্রতিষ্ঠিত নীতি আয়োগের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে মাত্র ৮৫ হাজার ২১৭ কোটি টাকা অনুমোদন করেছে (অর্থাৎ গত বছরের স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দের চাইতে প্রায় ২০ শতাংশ কম)৷ অর্থ বরাদ্দ কমানোর ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির অর্থমন্ত্রক ‘রাজ্যগুলি ঠিকমতো বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ করে না’ বা ‘খরচ কমিয়ে রাজকোষের ঘাটতি কমানো দরকার’ বলে যে সব যুক্তি পেশ করেছে, বলা বাহুল্য সেগুলি নেহাতই অপযুক্তি৷ একটি স্বাধীন দেশে জনস্বাস্থ্যের গুরুত্ব যে অপরিসীম তা কাউকে বুঝিয়ে বলার দরকার হয় না৷ উপরন্তু রাজ্য খরচ না করলে তাকে চাপ দিয়ে করিয়ে নেওয়াটাও কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব৷ এখানেই সরকারের স্বাস্থ্যনীতির স্বরূপ ও প্রচারের ‘মুখোশ’–এর আড়ালে ‘জনদরদ’–এর প্রকৃত চেহারাটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে– যেখানে ঘোষণা ও তা কার্যকর করার সদিচ্ছার মধ্যে ফারাক আসমান–জমিনের৷
অথচ ‘সকলের জন্য স্বাস্থ্য’ কোনও নতুন দাবি নয়৷ স্বাধীনতার প্রাক্কালে (১৯৪৬) ভোরে কমিটির সুপারিশে প্রতিটি নাগরিকের কাছে ক্রয়ক্ষমতা ব্যতিরেকে (অর্থাৎ বিনামূল্যে) সকল প্রকার প্রয়োজনীয় চিকিৎসার সুযোগ পৌঁছে দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল৷ ১৯৭৮ সালে কাজাখস্তানের আল্মা আটায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সম্মেলনে ‘২০০০ সালের মধ্যে সকলের জন্য স্বাস্থ্য’র ঘোষণাপত্রে অন্যতম স্বাক্ষরকারী দেশ ছিল ভারতবর্ষ৷ অথচ জনগণের ভোটে নির্বাচিত কেন্দ্র ও রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলগুলি সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা দু’পায়ে মাড়িয়ে এক্ষেত্রে চূড়ান্ত গাফিলতি ও ঔদাসীন্যের পরিচয় দিয়েছে৷
২০১০ সালে যোজনা কমিশন প্রতিষ্ঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির রিপোর্টে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়ের পরিমাণ জাতীয় আয়ের ১.৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০১৭ তে ২.৫ শতাংশ এবং ২০২২ সালের মধ্যে ৩ শতাংশ করার কথা বলা হয়৷ বলা হয় দেশের প্রতিটি নাগরিককে ‘ইন্ডিয়া হেল্থ কার্ড’ দেওয়া হবে যার মাধ্যমে সব ধরনের চিকিৎসা সকলেরই মিলবে বিনামূল্যে৷ কিন্তু তৎকালীন কংগ্রেস সরকার সেই কমিটির সুপারিশ কার্যকর করতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখায়নি৷ ২০১৫ সালের মধ্যে মোট জাতীয় আয়ের ২.৫ শতাংশ স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়– প্রধানমন্ত্রী মোদির এই ঘোষণাকে অসার প্রমাণ করে পূর্বতন কংগ্রেস সরকারের পথে হেঁটে সমস্ত সমাজকল্যাণ ক্ষেত্রের মতোই স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বরাদ্দ নির্বিচারে কমিয়ে চলেছে বর্তমান বিজেপি সরকার৷ বুঝতে অসুবিধা হয় না, নামে আলাদা হলেও জনগণের প্রতি দায়িত্ব পালনে কংগ্রেস আর বিজেপিতে কোনও ফারাক নেই৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৫–তে স্বাস্থ্যখাতে ভারতের খরচ হয়েছে মোট জাতীয় আয়ের ১.২ শতাংশ, যেখানে শ্রীলঙ্কায় এই খরচ ১.৮ শতাংশ, চিনে ৩ শতাংশ এবং সারা বিশ্বে গড় ৫.৪ শতাংশ (প্রায়)৷ প্রসঙ্গত ‘সকলের জন্য স্বাস্থ্য’ এই স্লোগানকে প্রকৃত অর্থে বাস্তবায়িত করেছিল বিপ্লবোত্তর সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া৷
বিশ্ব জুড়ে পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রবল সংকটে স্বাস্থ্য এখন পরিষেবা নয়, লাভজনক পণ্য৷ প্রবল বাজারসংকটে দীর্ণ পুঁজিপতিরা তাই স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ করতে প্রবল উৎসাহী ও তৎপর৷ সরকারি বদান্যতায় একদিকে সরকারি হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা দুর্লভ ও অপ্রতুল হয়ে উঠছে, অন্য দিকে বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে উঠছে ব্যাঙের ছাতার মতো নার্সিং হোম, পে–ক্লিনিক, মাল্টি স্পেশালিটি হাসপাতাল – যেখানে প্রিয়জনকে বাঁচানোর জন্য বেসরকারি মালিকের থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয়ে চিকিৎসা কিনতে হয়৷ সংবাদে প্রকাশ, সরকারি বরাদ্দ কম থাকার ফলে ২০১২–তে চিকিৎসাজনিত খরচের প্রতি ১০০ টাকার মধ্যে নিজের পকেট থেকে দিতে হত ৬০ টাকা, আর এখন সেটাই বাড়তে বাড়তে দাঁড়িয়েছে ৭০ টাকায়৷ যাকে বলা হয় ‘আউট অফ পকেট এক্সপেন্সেস’৷ বিশাল পরিমাণ এই খরচের ধাক্কা সামলাতে না পেরে প্রতি বছর প্রায় ছয় কোটিরও বেশি মানুষ নতুন করে দারিদ্রসীমার নিচে চলে যাচ্ছেন৷ কেন না আরএসবিওয়াই, ইএসআই–এর নামে যতটুকু সরকারি চিকিৎসার সুযোগ ছিল, সরকারের জনমুখী দৃষ্টিভঙ্গির অভাবে তাও আজ যথেষ্ট অপ্রতুল৷ সাধারণ, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত মানুষ সাধারণ থেকে জটিল রোগের চিকিৎসা করাতে এসে সরকারি হাসপাতালগুলিতে বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন প্রতিদিন৷
এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যখাতে আরও বরাদ্দ বৃদ্ধিই যেখানে উচিত ও কাঙিক্ষত ছিল, সেখানে ২০ শতাংশ বরাদ্দ হ্রাস দেশের স্বাস্থ্য পরিস্থিতিকে আরও করুণ ও দুর্বিষহ করে তুলবে সন্দেহ নেই৷ উন্নয়নের ঢক্কানিনাদের আড়ালে বিজেপি সরকারের এই চূড়ান্ত অমানবিক, জনবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে সাধারণ মানুষকেই৷