কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক সম্প্রতি এক প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছে, অতিমারির সময়ে দেশে গরিবের সংখ্যা কত সরকারের তা জানা নেই। কেন জানানেই? অর্থ মন্ত্রকের বক্তব্য, দরিদ্রের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয় পারিবারিক খরচের সমীক্ষার ভিত্তিতে। সেই সমীক্ষাটাই নাকি সরকার করেনি! সমীক্ষা করে থাকে ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভে অর্গানাইজেশন (এনএসএসও)। ২০১১-১২ সালে মনমোহন সিংহ সরকারের আমলে এনএসএসও সমীক্ষা হয়েছিল। সেই সমীক্ষায় দেশে গরিবের সংখ্যা ছিল জনসংখ্যার ২১.৯ শতাংশ। সাধারণত পাঁচ বছর অন্তর সমীক্ষা হয়। ২০১৬-১৭ সালের সমীক্ষা এক বছর দেরি করে হলেও রিপোর্ট সরকারিভাবে প্রকাশ করা হয়নি। কারণ? সংবাদপত্রে ফাঁস হয়ে যায় রিপোর্টের একাংশ। তাতে দেখা যায় মোদি জমানায় মানুষের আয় কমেছে। ফলে মানুষ খরচ কমাতে বাধ্য হয়েছেন।
এই রিপোর্ট প্রকাশ করলে মোদি সরকারের ‘আচ্ছে দিন’-এর কঙ্কাল বেরিয়ে আসত, ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে সরকারকে অস্বস্তিতে পড়তে হত, এই অঙ্ক কষেই সরকার রিপোর্ট প্রকাশ করেনি। ফলে গরিবের সংখ্যা সরকার জানে না, এটা ডাহা মিথ্যা। প্রকৃত সত্য হল, গরিবের সংখ্যা দেশবাসীর চোখ থেকে আড়াল করতে চেয়েছে তারা।
বর্তমানে দেশে গরিবের সংখ্যা নির্ধারণের মাপকাঠি কী? অতীতে নানা সময়ে এই মানদণ্ড বহুবার পাল্টেছে। ২০১১-১২ সালের হিসাব অনুযায়ী, গ্রামে কারও মাসিক খরচ ৮১৬ টাকার কম হলে এবং শহরে ১০০০ টাকার কম হলে তিনি গরিব। যার অর্থ, গ্রামে দৈনিক ২৭.২০ টাকা এবং শহরে দৈনিক ৩৩.৩৩ টাকা কেউ খরচ করলেই তিনি আর গরিব নন! কেন এই হাস্যকর মানদণ্ড? গরিবের সংখ্যা কম করে দেখানোর জন্য মরিয়া হয়ে না উঠলে এই মানদণ্ড কেউ করতে পারে? এই মানদণ্ড বাড়িয়ে দৈনিক খরচ যদি ৩৫ টাকা করা হয়, তাহলেও তার দ্বারা চূড়ান্ত মূল্যবৃদ্ধির এই অবস্থায় দৈনিক একবেলা ভরপেট নিরামিষ আহারটুকু জুটবে না। শুধুমাত্র প্রাণধারণের জন্য দু’বেলা খাবার জোগাড় করার সামর্থ্যটুকু ধরে দারিদ্র মাপলে দেখা যাবে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণই গরিব। কিন্তু এটা স্বীকার করলে সরকারের ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। প্রশ্ন উঠবে, স্বাধীনতার ৭৫তম বছরেও কেন সিংহভাগ ভারতবাসীর দৈনিক ৭৫ টাকা খরচের সামর্থ্যটুকু নেই?
গরিবের সংখ্যা না জানলেও দেশে ধনকুবেরের সংখ্যা কিন্তু সরকারের নখের ডগায়। ২০১৮-‘১৯ আর্থিক বছরে ভারতে ১০০ কোটি টাকার বেশি বার্ষিক আয় ছিল ৭৭ জনের, ২০১৯-‘২০-তে তা বেড়ে হয় ১৪১, এবং ২০২০-‘২১-এ লকডাউন ও মন্দার মধ্যেও সংখ্যাটা ১৩৬। এদের কথাই, এদের সংখ্যাই কেন্দ্রের বিজেপি সরকার মনে রাখে। এদের স্বার্থেই কাজ করে। গরিব, নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তরা পুঁজিবাদী সরকারের কাছে ব্রাত্য। বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে সর্বোচ্চ মুনাফা লুটে শোষক ধনকুবেরদের সম্পদের রেকর্ড বৃদ্ধি হয়েছে। তার প্রতিক্রিয়ায় দরিদ্রের সংখ্যারও রেকর্ড বৃদ্ধি হয়েছে।
বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্ট দেখাচ্ছে, করোনার প্রথম ধাক্কায় ভারতে ১ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ চরমতম দারিদ্রের মুখে পড়েছেন। পিউ রিসার্চের সমীক্ষা অনুযায়ী কোভিড ও লকডাউনের জেরে আয় কমে যাওয়ায় প্রায় ৭ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ নতুন করে দারিদ্রসীমার নিচে চলে গিয়েছেন। আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষায় ২৩ কোটি মানুষকে দারিদ্রের মুখে ঠেলে দিয়েছে অতিমারি-লকডাউন। এদের কথা প্রধানমন্ত্রী মোদি ও তার মন্ত্রীরা জানেন না। এটা কীসের ইঙ্গিতবাহী? সরকার কতটা জনবিরোধী হলে পার্লামেন্টে এমন নির্লজ্জ ঘোষণা করতে পারে! অবশ্য পুঁজিপতিদের প্রধান সেবক হিসেবে এটাই হওয়ার কথা। মার্কসবাদ দেখিয়েছে, সরকার হল ক্ষমতাসীন শ্রেণির হাতে তার রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক সহ সব রকম স্বার্থপূরণের হাতিয়ার। পুঁজিবাদী সরকার হল পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষার রাজনৈতিক ম্যানেজার। এই সত্য আড়াল করার জন্য বলা হয়ে থাকে সরকার হল বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল, অব দ্য পিপল। কিন্তু বাস্তবে আমাদের দেশের সরকার বাই দ্য ক্যাপিটালিস্ট, ফর দ্য ক্যাপিটালিস্ট, অব দ্য ক্যাপিটালিস্ট। বিজেপি সরকারের সাত বছরের দুঃশাসন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, সরকার গরিবের জন্য নয়।