Breaking News

বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে বুলডোজারের চাকায় পিষ্ট সাধারণ মানুষ

কৃষিকাজের প্রয়োজনে ১৯২৩ সালে আমেরিকায় বুলডোজার ব্যবহারের নকশা যাঁরা প্রস্তুত করেছিলেন তাঁরা এর এত অভিনব প্রয়োগের কথা কল্পনাও করেননি। তখন তো যোগী আদিত্যনাথ কিংবা শিবরাজ সিং চৌহান, মোহন যাদবের মতো বিজেপির বাঘা বাঘা মন্ত্রীরা ছিলেন না! গত কয়েক বছর ধরে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে বিরোধী কণ্ঠ দমনের নামে ঘরবাড়ি ভেঙে ফেলতে, দোকান কিংবা বস্তিবাসীদের ঝুপড়ি উচ্ছেদে এই যন্ত্রকে ক্রমাগত ব্যবহার করে চলেছেন শাসক বিজেপি দলের নেতারা। ফলে বুলডোজার এখন গরিব মানুষ উচ্ছেদের এক অভিনব যন্ত্র।

সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশের মণ্ডলা জেলার আদিবাসী ও সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এক গ্রামে বিরাট পুলিশবাহিনী কয়েকটি বাড়ির ফ্রিজ থেকে উদ্ধার করে গোমাংস, একটি বাড়ি থেকে পশুর চর্বি ও চামড়া, একজনের উঠোন থেকে দেড়শো গরু। পুলিশি অভিযানের পর তড়িঘড়ি এফআইআর দায়ের, মাংসের ডিএনএ পরীক্ষা, অভিযুক্তদের ধরপাকড় ইত্যাদি চলে। পরদিনই যে সব বাড়িতে গোমাংস পাওয়া গেছে সেই সব বাড়ি বেছে বেছে বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।

মধ্যপ্রদেশ একটানা ১৭ বছরের বেশি বিজেপি শাসিত। স্বভাবতই উগ্র হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী এই দলটি মধ্যপ্রদেশে পশুহিংসা প্রতিরোধ আইন ও গো-বধ নিবারণী আইনের মতো দুটি কড়া আইন চালু কর়েছে। কত বড় গো-প্রেমী তা বোঝাতে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর বিজেপি নেতা মোহন যাদব ২০২৪ সালকে ‘গোবংশ রক্ষাবর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এ হেন রাজ্যে বুলডোজার দিয়ে সংখ্যালঘু, জনজাতি মানুষের গ্রামকে গুঁড়িয়ে দেওয়া ‘বেআইনি’ কাজ হতে পারে কি? সেখানে তো মানুষ-বধ নিবারণী কোনও আইন চালু করা হয়নি! কিংবা গো-রক্ষার অজুহাতে মানুষ খুনের বিরুদ্ধেও কোনও নিষেধাজ্ঞা সংঘ পরিবারের তরফে আনা হয়নি!

রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানার অসংখ্য স্থানে গো-হত্যা বা গো-মাংস খাওয়ার অভিযোগে বহু সাধারণ মানুষ ও পশু ব্যবসায়ীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে চলেছে ধর্মোন্মাদ গো-রক্ষক বাহিনী। ধর্মে-বর্ণে মানুষকে ভাগ করে এবং সংখ্যালঘু বিদ্বেষ ছড়িয়ে সংখ্যাগুরু ভোটব্যাঙ্ক তৈরিই যে বিজেপির একমাত্র উদ্দেশ্য, তাদের লাইসেন্স ছাড়া তথাকথিত গো-রক্ষা বাহিনী আকছার এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারত কি? মধ্যপ্রদেশের ওই গ্রামে হঠাৎ কিছু মানুষ গো-মাংস ভক্ষণ ও সংরক্ষণ শুরু করেছেন, এমন নয়। এটা তাদের জীবন-জীবিকারই অঙ্গ। জবলপুরের দীর্ঘকালের জুতোর ব্যবসার সঙ্গেও তা জড়িত। এটা স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসন জানে না, এমনও নয়। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্ট সহ একাধিক আদালতের রায় আছে যে, চাইলেই কোনও মানুষের ঘরবাড়ি সরকার ভেঙে দিতে পারে না। কিন্তু শাসক দলের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডাই যেখানে পুলিশের আসল দণ্ডসংহিতা, সেই বিজেপি শাসিত রাজ্যে এটাই আইন!

২০১৫-য় উত্তরপ্রদেশে গো-মাংস রাখার অপরাধে মহম্মদ আখলাককে পিটিয়ে মেরেছিল গো-রক্ষক বাহিনী। রাজস্থানের আলোয়ারে গো-হত্যার অভিযোগে পিটিয়ে এক পশুব্যবসায়ীকে হত্যা করেছিল তারা। একজন দুষ্কৃতীও শাস্তি পায়নি। উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথ মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার নামে বুলডোজার দিয়ে চরম দমন-পীড়ন শুরু করেন। এই সুবাদে তাঁর নামকরণ হয় ‘বুলডোজার বাবা’। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় ‘চ্যাম্পিয়ন’ সাজতে আদিত্যনাথ বলেছিলেন, গুণ্ডা-মাফিয়া, জমি-দখলকারীদের জন্য ‘জিরো-টলারেন্স’ নিয়ে চলবে তাঁর বুলডোজার। কারও কারও আশা ছিল, নারী নির্যাতনকারী, অবৈধ উপায়ে টাকা লেনদেনে অভিযুক্ত দুষ্কৃতী বা সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে ইন্ধন জোগানো ব্যক্তির ক্ষেত্রে বুলডোজার ব্যবহার করবে সরকার, মানুষ কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবে। কিন্তু কোথায় কী? বেছে বেছে দলিত, জনজাতি এবং সংখ্যালঘু এলাকার মানুষের বিরুদ্ধে, কিংবা বিরোধী-স্বর দমন করার জন্য বুলডোজারের ব্যাপক প্রয়োগ করছে সরকারের পেটোয়া পুলিশ-প্রশাসন এবং পুর কর্তৃপক্ষ। দেখা যাচ্ছে, দুষ্কৃতী নয়, বিজেপি সরকারের বুলডোজার তাক করা রয়েছে গরিব-অসহায় মানুষদের দিকেই।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিরোধী দলগুলিকে যোগী আদিত্যনাথকে মডেল করতে বলেছিলেন। যোগীজি ভোটে ‘বুলডোজার বাবা’ পরিচয়ে নতুন অবতার সেজেছিলেন। মধ্যপ্রদেশের পূর্বতন মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান বা বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মোহন যাদব তাঁকে ‘মডেল’ করেছেন। মধ্যপ্রদেশের নানা স্থানে বুলডোজার চালিয়ে বস্তি উচ্ছেদ করে শিবরাজ সিং চৌহান পরিচিতি লাভ করেছিলেন ‘বুলডোজার মামা’ বলে। মধ্যপ্রদেশে বুলডোজারে বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার সাম্প্রতিক ঘটনায় দোষীদের শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে মুখ্যমন্ত্রী যাদব মন্তব্য করেছেন– রাজ্য থেকে সব উপদ্রব ও দুর্বৃত্ত নির্মূলে সক্ষম সরকার। অর্থাৎ আদিবাসী ও সংখ্যালঘু গরিব মানুষ মানেই দুর্বৃত্ত!

সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশের মানুষ বুলডোজার বাবা তথা বিজেপিকে ভোটে ধাক্কা দিয়েছেন। কিন্তু বিজেপি নেতাদের উপায় নেই। তাদের দল তথা সরকারের এমন কোনও কীর্তি নেই যা দেখে মানুষ তাদের সমর্থন করতে পারে। একটি অস্ত্রই তাদের আছে, তা হল গো-রক্ষার নামে সাম্প্রদায়িক বিভেদে উস্কানি দিয়ে ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করা।