শিক্ষিত ছেলেটি বাবা–মায়ের করুণ মুখের দিকে আর তাকাতে পারে না, অনেক চেষ্টা করেও চাকরি জুটলো না, রাতে শুয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দেওয়ালের দিকে৷ সেই দেওয়ালে সে একটা পেপার কাটিং লাগিয়ে রেখেছে, যাতে লেখা আছে– কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী প্রকাশ জাভরেকর বলেছেন, ‘চাকরি আছে, নেওয়ার লোক নেই’ যে দেশে সাফাইকর্মী কিংবা করণিকের বিজ্ঞাপন বেরোলেও হাজার হাজার পিএইচডি ডিগ্রিধারী ও ইঞ্জিনিয়ারের আবেদন জমা পড়ে, সেখানে মন্ত্রীর এ হেন বাণী অসহায় বেকার যুবক–যুবতীদের প্রতি নিষ্ঠুর রসিকতা ছাড়া আর কী?
এ প্রশ্নের মীমাংসার দায় শাসকদের৷ দেশের শাসকরা শুধু প্রতিশ্রুতি দেন৷ ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন বছরে দু’কোটি বেকারের চাকরি দেবেন, আর আজ বলছেন, পকোড়া বেচে ২০০ টাকা আয়ও রোজগার, মুরগি–মাজন বেচেও রোজগার হয়৷ ভারপ্রাপ্ত অর্থমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল বলেছেন, নতুন নতুন চাকরির ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে, সেখানে নিয়োগও হয়ে চলেছে, কিন্তু সরকারের কাছে তার তথ্য নেই৷ বেসরকারি সংস্থা বেকারির যে ভয়াবহ পরিসংখ্যান দিচ্ছে, তা ঠিক নয়৷
খোদ সরকারের ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভের সমীক্ষা রিপোর্ট কী বলছে? দেখা যাচ্ছে দেশে বেকারত্বের হার ২.২ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৬.১ শতাংশ৷ ১৫–২৯ বছর বয়সী গ্রামীণ যুবকদের ক্ষেত্রে বেকারত্বের হার আরও মারাত্মক আকার নিয়েছে৷ ২০১১–১২ সালের তুলনায় তা তিন গুণ বেড়ে ২০১৭–১৮ অর্থবর্ষে ১৭.৪ শতাংশে পৌঁছেছে৷ মেয়েদের ক্ষেত্রে এই হার ৪.৯ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৩.৬ শতাংশ৷ এই রিপোর্ট ২০১৭–১৮ সালের৷ গত ৪৫ বছরে যা সর্বাধিক৷ এই রিপোর্ট প্রকাশ করার কথা ছিল বিগত ডিসেম্বর মাসে৷ ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল কমিশন এনএসএসও–র দেওয়া তথ্য খুঁটিয়ে পরীক্ষার পর প্রকাশের অনুমোদন দিয়েছিল৷ কিন্তু সরকার তা প্রকাশ করতে রাজি হয়নি৷ মোদি সরকারের বিরুদ্ধে রিপোর্ট ধামা চাপা দেওয়ার অভিযোগ তুলে কমিশনের প্রধান ও আর এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য পদত্যাগ করেছেন৷ আসলে এই তথ্য সরকারের মিথ্যা প্রতিশ্রুতির পর্দা ফাঁস করে দেবে, তাই তা চাপা দেওয়ার চেষ্টা৷ কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন লেবার ব্যুরোও বেকারি ও কাজের সমীক্ষা চালায়৷ সেই সমীক্ষাতেও আটটি শ্রম নিবিড় ক্ষেত্রে কাজ কমে যাওয়ার কথা ধরা পড়েছে৷ মোদি সরকার সেই সমীক্ষাও প্রকাশ করতে দেয়নি৷
সংখ্যার হিসাবে দেশে সাড়ে পাঁচ কোটির বেশি বেকার৷ কিন্তু এই হিসাব কেবলমাত্র সরকারি নথিতে থাকা বেকারের৷ বাস্তবে এই সংখ্যা এর কয়েক গুণ৷ কয়েক বছর আগে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী নিজেই বলেছিলেন, দেশের অর্ধেক মানুষ বেকার৷ যদিও কেন তারা বেকার, এর জন্য কে দায়ী, সে উত্তর তিনি দেননি৷
কিন্তু রিপোর্ট চেপে রেখে তো বাস্তবতাকে চেপে রাখা যায় না৷ এই বেকারদের কাজ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েই তো বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় বসেছিলেন৷ বলেছিলেন, বছরে দু’কোটি বেকারকে কাজ দেবেন৷ কাজ দেওয়া দূরের কথা বেকারি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে৷ সরকারের নোট বাতিলে কাজ হারানো বিপুল সংখ্যক মানুষ কাজ হারিয়ে বেকার বাহিনীকেই আরও স্ফীত করেছে৷ তা হলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এত কিছু প্রকল্প– মেক ইন ইন্ডিয়া, স্কিল ইন্ডিয়া, প্রধানমন্ত্রী কৌশল যোজনা প্রভৃতি অজস্র ঘোষণা করলেন, তার ফল কী হল? সরকারের মন্ত্রীরা তো প্রতিদিন দাবি করছেন তাঁদের সুশাসনে বৃদ্ধির হার ক্রমাগত বেড়েই চলেছে৷ এমনকী কয়েক গুণ আর্থিক সম্পদের অধিকারী চীনকেও সে ছাড়িয়ে যাচ্ছে৷ বৃদ্ধি যদি এতই হয় তা হলে কর্মসংস্থান হচ্ছে না কেন? প্রথমত যে বৃদ্ধির দাবি বিজেপি সরকারের মন্ত্রীরা নিত্য করে যাচ্ছেন, বিশেষজ্ঞরাই বলছেন, তাতে অনেক জল আছে, আছে হিসেবের কারিকুরি৷ তবুও যতটুকু বৃদ্ধি হচ্ছে তাতেও কিছু কর্মসংস্থান হবে না, এই বৃদ্ধিতে কর্মসংস্থান হবে না৷ এর নাম জবলেস গ্রোথ৷ যে সময়ে এই মারাত্মক বেকারির হিসাব প্রকাশিত হয়েছে সেই সময়ে দেশে সম্পদ তো কম তৈরি হয়নি৷
অক্সফামের রিপোর্ট দেখাচ্ছে, দেশের মোট সম্পদের ৭৭.৪ শতাংশ আছে ১০ শতাংশ মানুষের হাতে৷ ১ শতাংশ মানুষের হাতে আছে ৫১.৩ শতাংশ সম্পদ৷ আর দেশের ৬০ শতাংশ মানুষের হাতে আছে মোট সম্পদের মাত্র ৪.৮ শতাংশ৷ অর্থাৎ সম্পদ বৃদ্ধির ভাগ গরিব নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত মানুষের ভাগে কিছু জোটেনি৷ সবই গিয়েছে ধনীদের ঝুলিতে৷ আর এ সব কিছুই তো হয়েছে, কংগ্রেস এবং বিজেপি উভয়ের শাসনে, উভয়ের আর্থিক নীতিরই ফলে৷ কিছু তথ্য চাপতে পারলেও এই সত্যকে কি শাসকরা চেপে রাখতে পারবে!