বিজেপি যেন এই সুযোগটির অপেক্ষাতেই ছিল৷ তারা জানত জম্মু ও কাশ্মীর সরকার থেকে সমর্থন তুলে নিলে মুখ্যমন্ত্রীর পদে ইস্তফা দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতির৷ ছক মতোই জারি হল রাষ্ট্রপতি শাসন৷ যা বকলমে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারেরই শাসন৷ জাতীয় স্বার্থ, জম্মু–কাশ্মীরের স্বার্থের কথা বলতে বলতে বাস্তবে সেগুলি সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে বিজেপি সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থ গোছানোর কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ল৷ সেই স্বার্থটি হল কাশ্মীর সমস্যার মূল কারণ গুলিয়ে দিয়ে তাকে মুসলমানদের সমস্যা হিসাবে তুলে ধরে হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক তৈরির চেষ্টা করা৷ বিজেপি জানে, এ ক্ষেত্রে সন্ত্রাসবাদ এবং পাকিস্তানের জুজু দেখানোর কোনও বিকল্প নেই৷
সময় নষ্ট না করে বিজেপি নেতারা কাশ্মীরকে ইস্যু করে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন হিন্দুত্ববাদের জিগির তুলতে৷ সব কিছুর পাশাপাশি রামমন্দির নির্মাণের প্রচার বিজেপি চালিয়ে যাচ্ছিল৷ এখন তার সাথে তারা যুক্ত করে দিল জম্মু–কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা তুলে নেওয়ার দাবি৷ জম্মু–কাশ্মীরের ভারতভুক্তির সময় থেকেই ঐতিহাসিক কারণে ৩৭০ ধারায় কিছু বিশেষ অধিকার দেওয়া আছে৷
সরকার থেকে বেরিয়েই বিজেপি ৩৭০ ধারা বাতিলের দাবিকে এত গুরুত্ব দিয়ে তুলছে কেন? এতে জম্মু–কাশ্মীরের মানুষের কী স্বার্থ রয়েছে? কিছুমাত্র নেই৷ বিজেপির একমাত্র লক্ষ্য দেশজুড়ে মুসলিম বিরোধী মানসিকতাকে চাঙ্গা করা এবং তার ভিত্তিতে হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে সংহত করার চেষ্টা করা৷
বিজেপি–পিডিপি জোট শুরু থেকেই ছিল একটি সুবিধাবাদী জোট৷ গদির দখল নেওয়াই ছিল এই উভয় দলের উদ্দেশ্য৷ এই সরকারের সময়ে কাশ্মীরে জঙ্গি তৎপরতা অনেকখানি বেড়েছে৷ অনেক সাধারণ নাগরিক এবং জওয়ানের প্রাণ গিয়েছে৷ পরিস্থিতিকে যখন আর কোনও ভাবেই সামাল দেওয়া যাচ্ছে না, তখন সেই ব্যর্থতার দায় যাতে নিজেদের ঘাড়ে এসে না পড়ে তাই সরকার ভেঙে বেরিয়ে আসার কৌশল৷ এখন বিজেপি চাইছে মিলিটারি তাণ্ডব চালিয়ে কাশ্মীরকে ঠাণ্ডা করতে৷ কাশ্মীরের মানুষের যেগুলি সত্যিকারের ক্ষোভের কারণ সেগুলি সমাধানের চেষ্টা না করে সেই ক্ষোভকে মিলিটারি দিয়ে দমন করতে চাওয়া কি কোনও দায়িত্বশীল দলের আচরণ হতে পারে? অথচ বিজেপি সেই চেষ্টাই করছে৷ এই চেষ্টা আগেও বহুবার হয়েছে৷ প্রতিবার তা ব্যর্থ হয়েছে৷ ভারতের চিন্তাশীল গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষজন দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে যে, কাশ্মীর সমস্যার সমাধান আলোচনার মাধ্যমে আবেগমুক্ত মন নিয়ে করতে হবে৷ গায়ের জোরে তা হবে না৷ সরকারের পক্ষ থেকেও যতগুলি টিম নানা সময়ে কাশ্মীরে গিয়েছে তারা প্রত্যেকেই মত দিয়েছে যে আলোচনার মধ্য দিয়েই সমস্যার সমাধান করতে হবে এবং সে সুযোগ রয়েছে৷ গোটা একটা রাজ্যের সব মানুষকে সন্ত্রাসবাদী বলে দেগে দেওয়া কোনও দায়িত্বশীল সরকারের আচরণ হতে পারে না৷ যা বিজেপি প্রথম থেকেই করে আসছে৷ সুজাত বুখারির মতো সাংবাদিক যিনি আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের কথাই বারবার বলে আসছিলেন তাঁকে খুন করে কি সে রাস্তাটিকেও অনেকখানি বন্ধ করে দেওয়া হল না? আজ যে বিজেপি সভাপতি বলছেন, কঠোর মিলিটারি তৎপরতা ছাড়া কাশ্মীরকে ঠাণ্ডা করা যাবে না সেই অমিত শাহ, এমনকী যে প্রধানমন্ত্রী সব ব্যাপারে টুইট করেন, মন কি বাত বলেন, তাঁরা কেউ সুজাত বুখারির মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ তো দূরের কথা, নিন্দাটুকুও করলেন না৷ সদ্য ভেঙে যাওয়া জম্মু–কাশ্মীর সরকারের এক মন্ত্রী তো সাংবাদিকদের সরাসরি হুমকি দিয়েছেন, সাংবাদিকরা নিজেরাই ঠিক করে নিন, কী করবেন৷ তাঁরা কি সুস্থভাবে বাঁচতে চান, নাকি সুজাত বুখারির মতো পরিণতি দেখতে চান? ফলে কাশ্মীরে বিজেপির উদ্দেশ্য বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়৷
প্রধানমন্ত্রী সহ বিজেপি নেতাদের মুখে ‘সুশাসন’ আর ‘সবার বিকাশের’ স্লোগান যে নেহাতই ভুয়ো ছিল তা তো আজ স্পষ্ট৷ ফলে বিজেপির হাতে রয়েছে মেরুকরণ তথা হিন্দু–মুসলমান বিভেদে উসকানি দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার জিগির তোলার তাসটিই৷ সেটি খেলতেই এখন উঠেপড়ে লেগেছেন বিজেপি নেতারা, তাতে দেশের স্বার্থ, কাশ্মীরের মানুষের স্বার্থ চুলোয় যাক৷ এর দ্বারা বিজেপি তার রাজনৈতিক দেউলিয়াপনাকেই প্রকট করে তুলল৷ সে প্রমাণ করল দেশের মানুষের জীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি সমাধানে তার করার কিছুই নেই, তাই দেশের মানুষকে তার বলারও কিছু নেই৷ ভারতের মতো বহু ধর্ম, বহু বর্ণ, বহু ভাষার একটি দেশে শাসন পরিচালনা করার মতো দায়িত্বশীলতাই তার নেই৷ এমন একটি দেশের শাসন পরিচালনার জন্য, সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য যে সহিষুতা, যে উদারতা, যে বিচক্ষণতা শাসক দলের দেখানো দরকার, তার ধারেকাছে বিজেপি যেতে পারেনি৷ পুঁজিবাদ একচেটিয়া চরিত্র অর্জন করার মধ্য দিয়ে একদিকে সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র অর্জন করেছে, অন্য দিকে তীব্র শোষণের মধ্য দিয়ে সে যে বাজার সংকট তৈরি করেছে তা এই শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটিকে টিকিয়ে রেখে সমাধানের কোনও রাস্তা নেই৷ এই অবস্থায় শাসক দলগুলির পুঁজিপতি শ্রেণির পলিটিক্যাল ম্যানেজার তথা তাদের শোষণের কাজকে সুচারু রূপে করে যাওয়ার সহায়ক তথা সেবাদাসের ভূমিকা পালন করা ছাড়া অন্য কোনও ভূমিকা নেই৷ এদের পিছনে আম্বানি আদানি টাটা বিড়লা সহ একচেটিয়া পুঁজিপতিদের টাকার থলির সমর্থন থাকতে পারে, তার জোরে তারা পেশিশক্তি, সরকারি প্রশাসন এবং প্রচারশক্তিকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনে জিততেও পারে, কিন্তু কাশ্মীরের মতো জটিল সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলা ছাড়া তার সমাধান করার ক্ষমতা তাদের নেই৷ কাশ্মীরে বিজেপির ভূমিকা সে কথাই প্রমাণ করেছে৷
বিজেপির সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থদুষ্ট নীতি কাশ্মীর জুড়ে অসন্তোষের আগুনকে আরও ছড়িয়ে দিতেই সাহায্য করবে৷ আলোচনা এবং কাশ্মীরীদের দাবিগুলির প্রতি সহানুভূতির পরিবর্তে সেনা–শক্তির ব্যবহার কাশ্মীরী যুবকদের আরও বেশি সরকার বিরোধী করে তুলবে৷ তার সুযোগ নেবে কাশ্মীর এবং পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলি৷ বিজেপির এই পদক্ষেপ কাশ্মীরের জনগণ তো বটেই, সারা দেশের পক্ষে বিপজ্জনক৷ এ তার অক্ষমতা না ইচ্ছাকৃত অপকর্ম তার জবাব তারাই দিতে পারে৷
(৭০ বর্ষ ৪৫ সংখ্যা ২৯ জুন, ২০১৮)