২০১৮ সালে বসে ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়ার’ প্রচারক প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল আবিষ্কার করেছে যত নষ্টের গোড়া নাকি আধুনিক শিক্ষা! তাই কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর এবং তাঁর দফতরের প্রতিমন্ত্রী সত্যপাল সিংহ সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনীতে গিয়ে বলেছেন, আধুনিক শিক্ষা পুরোপুরি ব্যর্থ৷ তাই ‘প্রকৃত দেশপ্রেমিক’ গড়ে তুলতে তাঁরা সিলেবাসে আধুনিক শিক্ষার কিছু বিষয় বাদ দিয়ে বৈদিক শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করবেন৷ তার মধ্য দিয়েই নাকি মূল্যবোধ গড়ে তুলবেন তাঁরা!
কিন্তু কেন? এর পিছনে আছে একটা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা৷ সেই অনুসারেই দেশজুড়ে ছড়ানো হচ্ছে এমন ধারণা, যাতে মনে হয় আধুনিক যুগের বিজ্ঞানী, মনীষী, শিল্পী, কবি সাহিত্যিকরা নতুন কিছু করেননি৷ যা কিছু জানার তা অতি প্রাচীন কালেই শেখা হয়ে গেছে৷ যেহেতু সভ্যতার কাছ থেকে মানুষের নতুন কিছু পাওয়ার নেই৷ তাই শোষণ–জুলুম চিরকাল চলেছে, চিরকাল চলবে একেই ভবিতব্য হিসাবে মেনে নিয়ে রাষ্ট্রের অনুগত দাস হয়ে জীবন কাটিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই৷ অন্ধতা, গোঁড়ামি, কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানসিকতার প্রসার ঘটিয়ে বিজ্ঞানসম্মত চিন্তার চর্চাকে ধ্বংস করতে এদেশের শাসকরা সবসময়েই সক্রিয় থেকেছে৷ বিজেপি ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় বসার পর এই প্রচেষ্টার তীব্রতা আরও বেড়েছে৷
বিজেপির চিন্তায় বৈদিক শিক্ষাই নাকি এযুগে স্বদেশপ্রেম এবং মূল্যবোধের আধার অথচ ভারতীয় নবজাগরণের মনীষীরা থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলনের আপসহীনধারার বিপ্লবীরা প্রায় সকলেই এভাবে প্রাচীনত্ব এবং ঐতিহ্যের দোহাই পেড়ে বৈদিক শিক্ষার গণ্ডিতে ছাত্রদের আটকে রাখার জন্য সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের প্রচেষ্টার বিরোধিতা করেছেন৷ নবজাগরণের ঊষাকালেই রাজা রামমোহন রায় অনুভব করেছিলেন হাজার বছরের প্রাচীন শিক্ষা নয়– ভারতীয় ছাত্রদের জন্য দরকার আধুনিক জ্ঞান–বিজ্ঞান, আধুনিক গণিতের চর্চা৷ লর্ড আমহার্স্টের কাছে লেখা চিঠিতে তিনি লিখছেন, ‘‘এ দেশকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করে রাখার সবচেয়ে ভাল পরিকল্পিত পথ হল সংস্কৃত শিক্ষা পদ্ধতি…এই দেশে ইতিমধ্যেই দু’হাজার বছর ধরে এই শিক্ষা চলে আসছে৷ ব্রিটিশ সরকার হিন্দু পণ্ডিতদের দিয়ে পুনরায় তাই চালু করছে৷ যার ফলে মিথ্যা অহঙ্কার জন্মাবে৷ …বেদান্ত শিক্ষার দ্বারা যুবকরা উন্নত নাগরিক হতে পারবে না৷… উন্নততর ও উদার শিক্ষার জন্য প্রয়োজন অঙ্কশাস্ত্র, প্রাকৃতিক দর্শন, কেমিস্ট্রি, অ্যানাটমি ও অন্যান্য কার্যকর বিজ্ঞান শিক্ষা৷’’ রামমোহন রায়ের কি মূল্যবোধ ছিল না এদেশের নবজাগরণের কান্ডারিরা প্রাচীন মূল্যবোধের বদলে নতুন আধুনিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ দেশে আনতে চেয়েছিলেন৷ তাই রামমোহনকে পৌত্তলিকতা, সতীদাহের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে৷ বিদ্যাসাগরকে দেশাচার, কুসংস্কাররের প্রাচীরকে আঘাত করতে হয়েছে৷ শরৎচন্দ্র তাঁর সাহিত্যে মূল্যবোধের নতুন ধারণা এনে বললেন, ‘‘কোনও আদর্শই বহুকাল স্থায়ী হয়েছে বলেই তা নিত্যকাল স্থায়ী হয় না এবং তার পরিবর্তনেও লজ্জা নেই …আতিথেয়তা আমাদের বড় আদর্শ, কত কাব্য, কত উপাখ্যান, কত ধর্ম–কাহিনী এই নিয়ে রচিত হয়েছে৷ অতিথিকে খুশি করতে দাতাকর্ণ নিজের পুত্রকে হত্যা করেছিলেন৷ এই নিয়ে কত লোকে কত চোখের জলই যে ফেলেছে তার সংখ্যা নেই৷ অথচ এ কাহিনী আজ শুধু কুৎসিত নয়, বীভৎস৷ সতী–স্ত্রী কুষ্ঠগ্রস্ত স্বামীকে কাঁধে নিয়ে গণিকালয়ে পৌঁছে দিয়েছিলেন, – সতীত্বের ও আদর্শেরও একদিন তুলনা ছিল না, কিন্তু আজ সেকথা মানুষের মনে শুধু ঘৃণার উদ্রেক করে’’(শেষ প্রশ্ন)৷ সেই ঘৃণিত বস্তাপচা মূল্যবোধই বিজেপির হাতিয়ার হয়েছে যখন দরকার ছিল আধুনিক যুগে এই মূল্যবোধকে আরও উন্নত জায়গায় নিয়ে যাওয়া তখন বিজেপি তাকে হাজার বছর পিছনে নিয়ে যাচ্ছে কেন? কংগ্রেসও এই অপচেষ্টা স্বদেশপ্রীতির নামে করেছিল৷ এদেশের ছাত্রযুবকদের মূল্যবোধহীন, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, কূপমণ্ডুক প্রজন্মে পরিণত করার উদ্দেশ্যেই এই পদক্ষেপ নয়কি!
বৈদিক শিক্ষা না মিথ্যার চাষ বিজেপি–আরএসএসের তাদের স্কুলে পড়ানো হচ্ছে বিশ্বের যে কোনও দেশের যে কোনও বিজ্ঞান বা প্রযুক্তিগত আবিষ্কার সবই নাকি প্রাচীন ভারতের বেদ পুরাণ থেকে নকল করে করা হয়েছে৷ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী রাজনাথ সিং ২০১৩ সালে তাঁর দল ক্ষমতায় আসার আগেই এক কর্মীসভায় বলেছিলেন, বিজ্ঞানী হাইজেনবার্গের আবিষ্কৃত যে নীতি অর্থাৎ ইলেকট্রনের ‘আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল’ মেনে আধুনিক কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা এগিয়েছে তা ঋক বেদ থেকে ধার করা৷ বিজেপি–আরএসএস বলছে, বৌদ্ধ বলে আলাদা কোনও ধর্ম থাকতে পারে না, কেন না গীতা টুকেই বুদ্ধ তাঁর ধর্মমত সূত্রবদ্ধ করেন এবং যীশু হিমালয়ে এসে হিন্দু সাধুদের কাছে ধর্মশিক্ষা করে খ্রিস্ট হয়েছিলেন (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১১–১১–৯৮)৷ এমন অসংখ্য মিথ্যা বলে চলেছেন তাঁরা৷ এই মিথ্যার চাষই কি দেশপ্রেম জাগাবে?
অথচ প্রাচীন ভারতে যে একটা সময় জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার উন্নতি হয়েছিল তা বোঝাতে মিথ্যার চাষ করার কোনও দরকারই নেই৷ কারণ তা বাস্তব সত্য৷ কিন্তু তার সিংহভাগটাই হয়েছিল বৈদিক যুগের পরে, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে খ্রিস্টিয় দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে৷ ‘বৈদিক’ নয়, লোকায়ত–চার্বাক এবং বৌদ্ধ দর্শনের প্রভাবেই এই অগ্রগতি হয়েছিল৷ কিন্তু সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেবল ভারতেই এই অগ্রগতি ঘটেছিল এটা একেবারেই অনৈতিহাসিক৷ সারা বিশ্বের মানবজাতির এক অংশ হিসাবেই প্রকৃতিকে জয় করার তাগিদে ভারতেও নানা বিদ্যার চর্চা হয়েছে৷ ৫০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ভারতে যখন আর্যভট্ট পৃথিবীর আহ্ণিক গতির ইঙ্গিত দিয়েছেন তার কিছুটা আগেই গ্রিসে এবং ব্যাবিলনে পৃথিবীর আহ্ণিক গতির ধারণা এসেছিল৷ আবার গ্রিক দার্শনিক ইরাটোস্থেনিস যে পদ্ধতিতে পৃথিবীর ব্যাস মাপার কথা বলেছেন, প্রায় একই সময় সূর্য সিদ্ধান্তে অনেকটা একই ভাবে পৃথিবীর ব্যাস নির্ণয়ের কথা বলা হয়ছে৷ কিন্তু সে সময় বিশ্বের কোনও জাতির পক্ষেই পৃথিবীর বার্ষিক গতির ধারণা করা সম্ভব হয়নি৷ তার জন্য বিশ্বকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৪৪৪ খ্রিস্টাব্দে কোপারনিকাস পর্যন্ত৷ কোনও প্রতিভাধরের পক্ষেই বাস্তব পরিবেশ, সেই বিশেষ যুগের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে যাকে বলে একেবারে লম্ফ দিয়ে চমকপ্রদ কিছু আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি৷ কারণ তা প্রকৃতির নিয়ম বিরুদ্ধ৷ আবার সারা পৃথিবীর জ্ঞান–বিজ্ঞান চর্চার থেকে মুখ ফিরিয়ে কূপমণ্ডুক গোঁড়া তথাকথিত সনাতন হিন্দুত্বের নিগড়ে বাঁধতে গিয়েই নবম–দশম শতাব্দী থেকে ভারতে বিজ্ঞানচর্চার অধঃপতন ঘটেছিল৷ বেদান্ত এবং বেদ–অনুসারী নানা সামাজিক বিধি নিষেধের প্রভাবই ছিল তার কারণ৷ ভারতেই বিজ্ঞানী আর্যভট্টের পৃথিবীর আহ্ণিকগতির ধারণাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছেন ব্রহ্মগুপ্ত, ভাস্ক্রাচার্যের মতো হিন্দু জ্যোতিষিরা৷ রবীন্দ্রনাথ তাই বলেছেন, ‘‘হিন্দুযুগ একটা প্রতিক্রিয়ার যুগ – এই যুগে ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে সচেষ্টভাবে পাকা করে গাঁথা হয়েছিল৷ দুর্লঙঘ্য আচারের প্রাকার তুলে একে দুষ্প্রবেশ্য করে তোলা হয়েছিল৷ …বিশেষ অধ্যবসায়ে নিজেদেরকে পরকীয় সংস্রব ও প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ রক্ষা করার জন্যই আধুনিক হিন্দুধর্মকে ভারতবাসী প্রকাণ্ড একটা বেড়ার মতো করেই গড়ে তুলেছিল– এর প্রকৃতিই হচ্ছে নিষেধ ও প্রত্যাখ্যান৷ সকল প্রকার মিলনের এমন সুনিপুণ কৌশলে রচিত বাধা জগতে আর কোথাও সৃষ্টি হয়নি’’(হিন্দু মুসলমান, কলিদাস নাগকে লিখিত পত্র)৷ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় এর জন্য মূলত তিনটি কারণের উল্লেখ করেছেন৷ তাঁর মতে জাতিভেদ প্রথা, মনু এবং তার পরবর্তী পুরাণগুলিতে আচার–ব্যবহার–রীতি ধর্মীয় নিগড়ে কঠোরভাবে বেঁধে দেওয়া এবং বেদান্ত বিশেষত শঙ্করাচার্যের মায়াবাদের মতো ভাববাদী দর্শনগুলির প্রভাবই এর জন্য দায়ী৷ সমাজপতি এবং শাস্ত্রকারদের গোঁড়ামিই যে ভারতের অধঃপতনের কারণ তা তিনি গভীর দুঃখের সঙ্গে তাঁর ‘হিস্ট্রি অফ হিন্দু কেমিস্ট্রি’তে তুলে ধরেছেন৷ এদেশের ছাত্রদের জন্য আধুনিক শিক্ষার কথা ভেবেছিলেন বিদ্যাসাগর৷ তিনি বলছেন, ‘সংস্কৃতে অঙ্ক পড়ালে চলবে না৷ ইংরেজিতে পড়াতে হবে৷’ (এডুকেশন সেক্রেটারি ময়েটকে লেখা চিঠি)৷ তিনি আরও বলছেন, ‘সাংখ্য বেদান্ত যে ভ্রান্ত দর্শন তা আর বিবাদের বিষয় নয়’ (ওই)৷ এমনকী স্বামী বিবেকানন্দ – যাঁর শিক্ষা বিজেপি মেনে চলে বলে প্রচার করে – তিনি বলেছেন, ‘‘আমাদের দেশে প্রাচীন কাল থেকে সংস্কৃতে সমস্ত বিদ্যা থাকার দরুন বিদ্বান ও সাধারণের মধ্যে একটা অপার সমুদ্র দাঁড়িয়ে গেছে৷ যা অপ্রাকৃতিক, কল্পিত মাত্র, তাতে ছাড়া কি আর পাণ্ডিত্য হয় না?’’(ভাববার কথা – স্বামী বিবেকানন্দ)৷ বিজেপি–আরএসএস কি এই সমস্ত মনীষীদের ভারতীয় মনে করে ইতিহাসের এবং বিজ্ঞানের এই শিক্ষাকে ভুলিয়ে দিতে বিজেপি–আরএসএস তৎপর৷ না হলে হিন্দুত্বের মিথ্যা গৌরব গাথার ধোঁয়াশার আড়ালে নরেন্দ্র মোদি বা অন্য কোনও ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করা নেতাকে দেশের সর্বরোগহর অবতার হিসাবে আধুনিক মন সম্পন্ন মানুষ মেনে নেবে না৷বিজেপি আরএসএসদের বড় বড় নেতারা নিজেদের সন্তানদের কি টোল–চতুষ্পাঠীতে বৈদিক শিক্ষা নিতে পাঠাচ্ছেন৷ নাকি তাদের দেশ–বিদেশের নাম করা প্রতিষ্ঠানে লক্ষ লক্ষ টাকা দিয়ে পড়াচ্ছেন? তাঁরা আধুনিক শিক্ষার বিরুদ্ধে ভাষণ দিচ্ছেন –এই আধুনিক শিক্ষা মানে কেবলমাত্র কিছু ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যা, কিংবা মঙ্গলে রকেট পাঠানোর প্রযুক্তি নয়৷ আধুনিক শিক্ষার সবচেয়ে বড় ভূমিকা হল আধুনিক বৈজ্ঞানিক মনন তৈরি করা৷ যে মন শাসকের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলে, প্রচলিত সংস্কারের গণ্ডি ভাঙার শক্তি রাখে, তেমন মননশীলতা তৈরি করার জন্য যে শিক্ষা ব্যবস্থা তাই হল আধুনিক শিক্ষা৷ তার জন্য বস্তাপচা পুরাতন মূল্যবোধের বদলে চর্চা করা দরকার আধুনিক গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধ৷ আর সেই মূল্যবোধকেই ভয় পায় বিজেপি থেকে শুরু করে সমস্ত শাসকেরা৷
আধুনিক মনন গড়ে তোলার পথে বাধা সৃষ্টি করতেই বিজেপি–আরএসএএস তাদের তীব্র বিদ্বেষমূলক হিন্দুত্ববাদী চিন্তার ছাঁচে এদেশের ছাত্র–যুবকদের ঢেলে গড়তে চাইছে৷ এই যুক্তিহীন, ধর্মীয় গোঁড়ামি, বিদ্বেষে ভরা মননই তাদের শাসনের হাতিয়ার৷ আরএসএস–এর গুরু গোলওয়ালকার অহিন্দু মানুষদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে হিন্দুদের পায়ের তলায় রাখতে চেয়েছিলেন৷ তিনি ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামকে ব্রিটিশ বিরোধীর বদলে মুসলমান বিরোধী করতে চেয়েছিলেন, ‘‘…আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বহু আন্দোলনই নিছক ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়েছে৷ ব্রিটিশ বিরোধিতার সঙ্গে দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদকে সমার্থক করে দেখা হয়েছে৷ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে, তার নেতৃবর্গ এবং সাধারণ মানুষের ওপরে এই প্রতিক্রিয়াশীল মতের প্রভাব সর্বনাশা হয়েছে’’ (উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড)৷ অর্থাৎ তাঁর মতে ক্ষুদিরাম, নেতাজি, ভগৎ সিং, চন্দ্র শেখর আজাদ মাস্টারদা সূর্র্য সেন থেকে শুরু করে অসংখ্য বিপ্লবী এবং স্বাধীনতা সংগ্রামীরা কেউ দেশপ্রেমিক ছিলেন না৷ যে হিন্দু মহাসভা জালিয়ানওয়ালাবাগের কুখ্যাত নায়ক ডায়ারকে সমর্থন করেছিল, তাদের উত্তরসূরী বিজেপি–আরএসএস হচ্ছে ‘দেশপ্রেমিক’!
এই ছাঁচে গড়া তথাকথিত ‘দেশপ্রেমিক’রা এই দেশ, এই সভ্যতাকে বহু বছর পিছিয়ে নিয়ে যাবে৷ প্রাচীন মূল্যবোধের নাম করে মূল্যবোধহীন কিছু মানবদেহধারী যন্ত্রমানব গড়তে চায় এদেশের শাসক পুঁজিপতি শ্রেণি৷ তাদের বিশ্বস্ত সেবাদাস হিসাবে বিজেপি মানুষ গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াকেই স্তব্ধ করতে ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতির আমদানী করতে চাইছে৷ যে হুঁশিয়ারি দিয়ে বহুদিন আগেই এযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মার্কসবাদী দার্শনিক কমরেড শিবদাস ঘোষ বলেছিলেন,‘‘ফ্যাসিবাদ হ’ল অধ্যাত্মবাদ ও বিজ্ঞানের এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ৷ এতে জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের নামে একই সঙ্গে থাকে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিকে বাড়িয়ে তোলার স্বার্থে বিজ্ঞানের কারিগরি দিককে গ্রহণ করার কর্মসূচি এবং সমস্ত রকম অবৈজ্ঞানিক ধর্মীয় উন্মাদনা ও ভাববাদী ভোজবাজিকে(idealistic jugglery) শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এবং বর্তমান সমাজের আনুষঙ্গিক কুফলগুলি থেকে পরিত্রাণের সর্বরোগহর ঔষধ হিসাবে পরিবেশন করার চেষ্টা৷ এইভাবে ফ্যাসিবাদী সংসৃক্তি হ’ল বৈজ্ঞানিক বা সত্যনিষ্ঠ চিন্তার সাথে অলীক চিন্তার এক বিচিত্র সংমিশ্রণ৷ এতে প্রকৃতি জগতের প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, অন্যদিকে সামাজিক প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণায় অলীক চিন্তাই শক্তিশালী হয়ে ওঠে৷ এর উদ্দেশ্য হ’ল মানুষের চিন্তাপ্রক্রিয়াকে কার্য–কারণ সম্পর্ক যাচাই–এর বৈজ্ঞানিক পথ থেকে অন্ধবিশ্বাস, পূর্বধারণা ও কুসংস্কারের চোরাপথে চালিত করা এবং তার দ্বারা শেষপর্যন্ত সামাজিক ক্রিয়া সম্পর্কে অবজ্ঞা সৃষ্টি করা’’(সময়ের আহ্বান, রচনাবলী দ্বিতীয় খণ্ড)৷
আমাদের দেশের ছাত্র–যুবকদের মধ্যে ইতিমধ্যেই এই আত্মসর্বস্ব, মানবিক মূল্যবোধহীনব ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতির প্রসার ঘটাচ্ছে শাসক শ্রেণি৷ এই সর্বনাশা প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করতে এগিয়ে আসতে হবে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকেই৷
(৭০ বর্ষ ৪০ সংখ্যা ২৫ মে, ২০১৮)