বিজেপি-কংগ্রেস দুজনেই টেম্পোভর্তি কালো টাকা পায়, স্বীকার করে নিলেন প্রধানমন্ত্রী

সম্প্রতি এক সভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কংগ্রেসের বিরোধিতা করতে গিয়ে রাহুল গান্ধীকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘তিনি ঘোষণা করুন, আম্বানি-আদানিদের থেকে কত মাল তুলেছেন। কালো টাকার কতগুলো ঝুলি ভরে টাকা মেরেছেন? টেম্পো ভর্তি করে কত টাকার নোট কংগ্রেসের জন্য পৌঁছেছে?কী সওদা হয়েছে যে আপনি রাতারাতি আম্বানি-আদানিদের গালি দেওয়া বন্ধ করে দিলেন’?

প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য স্বাভাবিক ভাবেই দেশ জুড়ে সাধারণ মানুষের মনে বহু প্রশ্ন তুলে দিয়েছে যেগুলির জবাব তাঁকে দিতে হবে। প্রথমত, প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করলেন যে, নির্বাচনের সময়ে বড় বড় রাজনৈতিক দলের কাছে ধনকুবেরদের থেকে টেম্পো ভর্তি কালো টাকা যায়, সেই বিপুল পরিমাণ কালো টাকা নির্বাচনে খাটে এবং তা নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রণ করে। তা হলে কি তিনি এটাও স্বীকার করে নিলেন না যে, স্বাধীন মত প্রকাশের নামে বাস্তবে এই নির্বাচন পুঁজিপতিদের কালো টাকার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়ে চলেছে? তিনি কি দেশের মানুষকে বলবেন, তাঁরা আম্বানি-আদানিদের থেকে কতগুলি টেম্পোভর্তি কালো টাকা অতীতের নির্বাচনগুলিতে এবং এই নির্বাচনে পেয়েছেন?

দ্বিতীয়ত, তিনি যেহেতু জানেন, আম্বানি-আদানিরা টেম্পোভর্তি কালো টাকা পাঠায়, তা হলে সেই কালো টাকার বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ীদের বাড়িতে যেমন ইডি-সিবিআই হানা দিচ্ছে, তেমন করে আম্বানি-আদানিদের দফতরে তারা এত দিন হানা দেয়নি কেন? তবে কি তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ধনকুবেরদের বিপুল পরিমাণ কালো টাকার চৌকিদারি করছেন?

তৃতীয়ত, নোট বাতিলের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হিসাবে তিনি দেশের মানুষের কাছে ঘোষণা করেছিলেন, এর দ্বারা সমান্তরাল অর্থনীতি হিসাবে কাজ করা কালো টাকাকে সম্পূর্ণ রূপে ধ্বংস করা হবে। সেই উদ্দেশ্য যে ব্যর্থ হয়েছে, তা দেশবাসীর কাছে তিনি কি তবে স্বীকার করে নিলেন? তা যদি না করেন, তবে নোট বাতিলের কারণে দেশবাসীকে যে ভয়ঙ্কর আর্থিক সঙ্কটের মুখোমুখি হতে হয়েছিল, শতাধিক মানুষকে লাইনে দাঁড়িয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল, তার দায় তো তাঁর উপরই বর্তায়। অথচ তিনি এই সত্য স্বীকার করেন না। কেন দেশের মানুষ তাঁকে একজন মিথ্যাচারী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে প্রতিপন্ন করবেন না?

এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) দীর্ঘ দিন ধরেই এই সত্যকে তুলে ধরেছে যে, পুঁজিবাদী এই ব্যবস্থায় বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলি দেশের পুঁজিপতি শ্রেণির রাজনৈতিক ম্যানেজার হিসাবে কাজ করে।জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা হিসাবে পার্লামেন্টারি ব্যবস্থাটি আসলে পুঁজিবাদী শোষণচক্রকে আড়াল করার একটি অত্যন্ত সুব্যবস্থা। লেনিনের কথা অনুযায়ী, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নির্বাচন মানে, দেশের মানুষকে কারা শোষণ করবে নির্দিষ্ট সময় অন্তর তা স্থির করারই ব্যবস্থা। বুর্জোয়া এই দলগুলির নেতারা তথা সংসদে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা পুঁজিবাদী শোষণপ্রক্রিয়াটিকে চালু রাখতে একের পর এক আইন পাশ করায়। যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পার্লামেন্ট নামক গণতান্ত্রিক ঠাটটিকে সামনে রেখে পর্দার আড়ালে পুঁজিপতি চক্রের মাধ্যমেই বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে যায়। এই সব রাজনৈতিক দলগুলির খরচ চালানো, নির্বাচনের বিপুল খরচ চালানো, নেতাদের জাঁকজমকপূর্ণ জীবনযাপন করার, তাঁদের সাহেবিয়ানা, দেদার বিদেশ ভ্রমণ প্রভৃতির খরচ এই ধনকুবেররাই জোগায়। এস ইউ সি আই (সি)-র সেই বক্তব্য কত বড় সত্যি সাম্প্রতিক বন্ড দুর্নীতি তা প্রমাণ করে দিয়েছে। এই সত্যটি এতদিন এই সব দলগুলির নেতারা প্রকাশ্যে স্বীকার করতেন না।বন্ড দুর্নীতি যেমন তা প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে, তেমনই রাহুল গান্ধীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে এ বার প্রধানমন্ত্রীও সেই কথা স্বীকার করে নিলেন।

কিন্তু নির্বাচনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ এ কথা স্বীকার করতে গেলেন কেন? বিজেপির গত দশ বছরের শাসনে এ কথা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, মোদি সরকার আসলে ধনকুবেরদেরই সরকার, জনগণের সরকার নয়। জনগণের স্বার্থকে তারা যে আম্বানি-আদানির মতো একচেটে পুঁজিপতিদের পায়ে বলি দিয়েছে আজ সে কথা সাধারণ মানুষেরও মুখে মুখে ঘুরছে।

মানুষ প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছে যে, জনগণের কঠোর পরিশ্রমে, তাদেরই করের টাকায় একদিন দেশ জুড়ে যে অজস্র রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ, সম্পত্তি ও কল-কারখানা গড়ে উঠেছিল, উদারিকরণের নামে সেগুলি দেশের পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার যে কাজ কংগ্রেস আমলে শুরু হয়েছিল, মোদি শাসনে তা তুঙ্গে উঠেছে। তেল গ্যাস রেল ব্যাঙ্ক বিমা বন্দর খনি জঙ্গল সহ সব কিছু, যার প্রকৃত মালিক দেশের জনগণ, তা আজ নির্বিচারে আদানি-আম্বানিদের হাতে তুলে দিচ্ছে মোদি সরকার। সব কিছুই ঘটছে প্রকাশ্যে, বেপরোয়া ভাবে। এর ফলে দেশ জুড়ে অবাধে লুঠতরাজ চালাচ্ছে এই সব একচেটিয়া পুঁজির মালিকরা।এই লুটের দ্বারা যতই ধনকুবেরদের ধনের পাহাড় আকাশ ছুঁয়েছে, বিশ্বের ধনীদের তালিকায় তাদের নাম প্রথম সারিতে পৌঁছেছে, ততই মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি, ছাঁটাইয়ের আক্রমণ সাধারণ মানুষের উপর তীব্র হয়ে নেমে এসেছে। শ্রমিককে যতক্ষণ খুশি খাটানো, ইচ্ছেমতো কম মাইনে দেওয়া মালিকদের অধিকারে পরিণত হয়েছে।মোদি সরকারের চরিত্র তাই সাধারণ মানুষের কাছে অনেকখানিই স্পষ্ট হয়ে গেছে।

এই রকম অবস্থায় ধনকুবেরদের থেকে খানিকটা দূরত্ব দেখানোর জন্যই প্রধানমন্ত্রী এমন কথা বলেছেন। কারণ, প্রথম দু’দফার নির্বাচনে সাধারণ মানুষের একটা বিরাট সংখ্যা অংশ না নেওয়ায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে প্রধানমন্ত্রীর দলের মধ্যে। তা ছাড়া দেশের মানুষকে তিনি দেখাতে চেয়েছেন যে, বিজেপিই শুধু ধনকুবেরদের থেকে টাকা নেয় না, কংগ্রেসও নেয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর এই কথা থেকে দেশের জনসাধারণের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, বুর্জোয়া দলগুলি সবাই ধনকুবেরদের থেকে টাকা নেয়। কালো টাকাও নেয়। আর যারা ধনকুবেরদের থেকে টাকা নিয়ে নির্বাচন করে, দল চালায়, বিলাসী জীবনযাপন করে, তারা নির্বাচিত হয়ে কাদের স্বার্থে কাজ করে, একই সঙ্গে তা-ও স্পষ্ট হয়ে গেল।

এস ইউ সি আই (সি) এই কথাটিই দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে যে, এই দলগুলি কোনওটিই সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষাকারী দল নয়– এরা পুঁজিপতি শ্রেণির দল। তাই এনডিএ বা ইন্ডিয়া– যে জোটই হোক, তা আসলে পুঁজিপতি শ্রেণিরই স্বার্থরক্ষাকারী পরস্পরের বিকল্প দুটি জোট। মানুষ একটি জোটের অপশাসনে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে পুঁজিপতি শ্রেণি তাদেরই বিকল্প অন্য একটি জোটকে সামনে নিয়ে আসে। তার পক্ষে টাকা ঢালে, তাদের মালিকানাধীন মিডিয়ায় চব্বিশ ঘণ্টা তার হয়ে প্রচার চালায়। অসচেতন মানুষ সেই প্রচারে ভুলে ভাবে, এরা বোধহয় তাদের স্বার্থে কাজ করবে। গত আট দশকে সতেরোটা লোকসভা নির্বাচন হয়েছে। সাধারণ মানুষ, শ্রমজীবী মানুষের দুর্দশার পরিবর্তন হয়নি, বরং তা আরও গভীর হয়েছে। সঙ্কট আজ এতই গভীর যে, এই ষড়যন্ত্রকে আর গোপনে রাখা যাচ্ছে না, প্রকাশ্যে এসে যাচ্ছে।

এই অবস্থায় দেশের শোষিত মানুষকে আজ তাদের নিজেদের শ্রেণিস্বার্থরক্ষাকারী দলকে চিনে নিতে হবে, তার পিছনে দাঁড়াতে হবে, তাকে শক্তিশালী করতে হবে। পুঁজিপতি শ্রেণির স্বার্থ রক্ষাকারী সব দলগুলিকে পরাস্ত করে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির রাস্তাকে প্রশস্ত করতে হবে। এটিই সময়ের আহ্বান।