নির্বাচনের আগে বিজেপি নেতারা উত্তরবঙ্গে গিয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছিলেন, তাঁরা ক্ষমতায় ফিরলে সমস্যা–জর্জরিত চা–শ্রমিকদের জীবনে সুরাহা এনে দেবেন৷ অথচ কেন্দ্রীয় বাজেটে উপেক্ষা ছাড়া আর কিছু জুটল না তাঁদের৷ স্বাভাবিক ভাবেই চা–বলয়ের আক্ষেপ, অপাত্রে ভোট দিলাম৷ শুধু চা–বলয় নয়, ‘বিজেপিকে ভোট দিয়ে কী পেলাম’– এই আক্ষেপ ধীরে ধীরে শ্রমিক–কৃষক–সাধারণ মানুষ– সব মহলেই উঠতে শুরু করেছে৷
এ রাজ্যে বিজেপি যাদের ভোটে ১৮টি সাংসদ আসনে জয়ী হল, তাঁদের সকলে যে বিজেপির সমর্থক এমন নয়৷ এমনকি বেশিরভাগকেই বোধহয় বিজেপির সমর্থক বলা যাবে না৷ তৃণমূলের দুর্নীতি, তোলাবাজি, জবরদস্তি একটা বিরাট অংশের মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল৷ তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল তৃণমূলকে শিক্ষা দেওয়া৷ কে পারে সেই শিক্ষা দিতে? দু’লক্ষ কোটি টাকা ঢেলে নির্বাচনী প্রচারে বিজেপি মিডিয়ার একটি বড় অংশের যেমন দখল নিয়েছিল তেমনই সোসাল মিডিয়ার প্রচারে দিনকে রাত বানিয়ে ছেড়ে ছিল৷ এই প্রচারের বন্যায় ভেসে গিয়ে একটা অংশের মানুষ মনে করেছিল, বিজেপিই বোধ হয় পারে তৃণমূলকে শিক্ষা দিতে৷ প্রচারের শক্তি এমন যে তা তাঁদের একবারও ভাবতে দিল না যে, বিজেপি কী শিক্ষা দেবে তৃণমূলকে? এ রাজ্যে বেশির ভাগ বিজেপি নেতারাই তো সিপিএম–তৃণমূলের দলবদলানো সুযোগ–সন্ধানীরা৷ তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য তো জনগণের জন্য সরকারি বরাদ্দের যে লুঠতরাজ চলছে, তাতে ভাগ বসানো৷ এ ছাড়া বিজেপির এই জয়ের পিছনে কাজ করেছিল সিপিএম নেতৃত্বের তৃণমূলকে দুর্বল করার নামে বিজেপিকে শক্তিশালী করার কর্মসূচি৷
বিজেপিকে ভোট দেওয়া এই মানুষগুলির অনেককেই আর খুব একটা উৎফুল্ল লাগছে না৷ এর কারণ কী? পাড়ায়, চায়ের দোকানে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলতেই জানা গেল, বাজেট তাঁদের দারুণভাবে হতাশ করেছে৷ কিন্তু বাজেট কি সবাই এমন বোঝেন নাকি যে, তা দেখে তাঁরা হতাশ হয়ে পড়েছেন? না, বাজেটের খুঁটিনাটি সবাই হয়ত বোঝেন না, কিন্তু তার প্রত্যক্ষ ফল টের পেতে অনেকেরই দেরি হয়নি৷ যেমন, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত অংশ, যারা খানিকটা রোজগার করেন, তাঁরা দেখলেন দ্বিতীয় দফার বিজেপি সরকারের বাজেটে তাঁদের জন্য প্রত্যক্ষ পাওনা গোল্লা৷ আয়করে কোনও রেহাই মিলল না৷ অথচ দেশের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের জন্য কর্পোরেট কর দিব্যি কমিয়ে দেওয়া হল৷ বিজেপিকে ভোট দিয়েছে বলে, তার সব কাজকেই আনন্দের সঙ্গে মেনে নিতে হবে– এমন দিব্যি তো কেউ দেয়নি৷ আবার পেট বড় বালাই৷ খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের অনেকেরও আশা ছিল, লাফিয়ে বাড়তে থাকা জিনিসপত্রের দামে সরকার লাগাম পরাবে, নতুন কলকারখানা খোলার কথা ঘোষণা করবে, দেশজুড়ে ছেয়ে থাকা বেকারদের কাজের ব্যবস্থা করবে৷ কিন্তু গোটা বাজেটে অর্থমন্ত্রী এগুলি নিয়ে একটি কথাও উচ্চারণ করলেন না৷ উপরন্তু তেলের উপর লিটার পিছু ২ টাকা করে সেস চাপিয়ে আর্থিক সংকটে ধুঁকতে থাকা সাধারণ মানুষের উপর আর এক দফা মুল্যবৃদ্ধি–ভাড়াবৃদ্ধি বোঝা চাপিয়ে দিলেন৷ জীবনে এগুলির প্রভাব বোঝার জন্য অর্থনীতির পণ্ডিত হতে হয় না৷ মানুষ বোঝে জীবনের জ্বালায়৷ তাই তাঁদের আফশোস– কাকে আনলাম!
শিল্পাঞ্চলের যে শ্রমিকরা বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন, তাঁরা সরকারের একের পর ঘোষণায় নিজেদের প্রতারিত মনে করছেন৷ বলছেন, এ কাকে সমর্থন করলাম সরকারে বসেই বিজেপি প্রথমে ৪২টি, পরে আরও ১০টি রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকে শিল্পপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে৷ রেলের নিজস্ব কারখানাগুলিও একই ভাবে পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দিচ্ছে৷ এর নিশ্চিত পরিণতি বিপুল সংখ্যায় কর্মসংকোচন তথা শ্রমিক–কর্মচারী ছাঁটাই৷ শুধু তাই নয়, শ্রম আইনে এতদিন শ্রমিকদের জন্য যতটুকু নিরাপত্তার কথা বলা ছিল, সে–সব বদলে নতুন আইন নিয়ে আসছে সরকার যেখানে মালিকদের হাতে শ্রমিক শোষণের অবাধ অধিকার থাকবে অথচ শ্রমিকদের থাকবে না প্রতিবাদ করার অধিকার৷ বিজেপি নেতা–মন্ত্রীরা নির্বিকার ভাবে বলে চলেছেন, এতে শ্রমিকদের মঙ্গলই হবে৷ স্বাভাবিক ভাবেই শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে৷
দেশে আজ অসংগঠিত শ্রমিক–কর্মচারীর সংখ্যাই বেশি৷ আশা–ঙ্গনওয়াড়ি–মিড ডে মিল কর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী প্রভৃতি হিসাবে লক্ষ লক্ষ নারী–পুরুষ কোনও রকম সুযোগ–সুবিধা ছাড়াই নামমাত্র মাইনেতে বছরের পর বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছেন৷ তাঁদের আশা ছিল, সরকার বাজেটে তাঁদের জন্য অন্তত কিছু ঘোষণা করবে৷ বাস্তবে তাঁদের জীবনের জ্বালা জুড়োতে কোনও ঘোষণা করেনি সরকার৷ প্রবল ক্ষুব্ধ এই মানুষগুলি৷
বিজেপি কৃষকদেরও একটা অংশের সমর্থন পেয়েছিল৷ কৃষকদের আশা ছিল, এই সরকার তাদের পরিশ্রমে ফলানো ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়ার ব্যবস্থা করবে৷ সার বীজ কীটনাশকের দাম কমাবে৷ কোথায় কী বরং কৃষি ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি ক্ষেত্রকেই কর্পোরেট পুঁজির হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছে বিজেপি সরকার৷ মোহ ভাঙছে কৃষকদের৷
২০১১ সালে এ রাজ্যের মানুষ সিপিএমকে হঠিয়ে তৃণমূলকে ক্ষমতায় বসিয়েছিল৷ কিন্তু তৃণমূলের নেতা–মন্ত্রীদের আচরণে সাধারণ মানুষের মনে একটা প্রবল আশাভঙ্গের প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়৷ চৌত্রিশ বছরের সিপিএম অপশাসন, যা বাংলার বুকে একটা জগদ্দল পাথরের মতো চেপে ছিল, সিঙ্গুর–নন্দীগ্রামে কৃষকদের জমি দখলের বিরুদ্ধে রাজ্যজুড়ে একপ্রবল গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেই সরকারের অবসান ঘটেছিল৷ আর সিপিএমের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় বসেছিল তৃণমূল সরকার৷ মানুষ আশা করেছিল, দুর্নীতি, তোলাবাজি, গা–জোয়ারি এসব বন্ধ হবে৷ রাজ্যে একটা পরিবর্তন আসবে৷ কিন্তু পরিবর্তন আসেনি৷ সিপিএম নেতারা যা করছিলেন, তৃণমূল নেতারাও সেই একই কাজ করতে থাকলেন৷ অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগুলিও একই থাকল৷ যারা এক সময় সিপিএমের হয়ে লুটপাট চালাত, কাটমানি তুলত, তারা দ্রুত তৃণমূলে ভিড়ে গিয়ে নেতা হয়ে বসল৷ তৃণমূল নেতৃত্ব কিন্তু ভোট রাজনীতির স্বার্থে তাদের আটকানোর চেষ্টা করলেন না৷ ফলে লুটপাট যেমন চলছিল তেমনই চলতে থাকল৷ ক্ষুব্ধ মানুষ আবার একটা পরিবর্তনের জন্য যখন ছটফট করছে তখনই বিজেপিকে প্রচার দিয়ে দিয়ে সামনে নিয়ে এল দেশের পুঁজিপতি শ্রেণি৷
আজ যতই বিজেপির স্বরূপ প্রকাশ পাচ্ছে ততই মানুষের মনে তাদের সম্পর্কে নানা প্রশ্ন উঠছে৷ মানুষ দেখছে, বিজেপির নেতা হয়ে যারা বসছে, তাদের বেশিরভাগটাই তৃণমূল থেকে বিতাড়িত কিংবা ভাগ–বাটোয়ারা মনের মতো না হওয়ার দ্বন্দ্বে তৃণমূল ছেড়ে আসা৷ একটা অংশ সিপিএম থেকে আসা৷ স্বাভাবিকভাবেই তাদেরও অতীত রেকর্ড যথেষ্ট কালিমাখানো৷ তা হলে এরা তৃণমূলকে শিক্ষাটাই বা দেবে কী, আর মানুষের অবস্থার পরিবর্তনটাই বা ঘটবে কোথা থেকে লোকসভা নির্বাচনের আগে থেকেই মানুষ দেখছে বিজেপি কীভাবে দল ভাঙানো শুরু করেছে৷ পদের লোভ, অর্থের লোভ দেখিয়ে, চুরি–দুর্নীতিতে অভিযুক্তদের পুলিশ–প্রশাসন এবং বিচার প্রক্রিয়া সামলে দেওয়ার স্তোক দিয়ে দলভারি করছে৷ এইভাবে তৃণমূলের কায়দাতেই একের পর এক তৃণমূলের পুরসভাগুলির কাউন্সিলারদের ভাঙিয়ে এনে সেগুলির দখল নিয়েছিল তারা৷ গোটা প্রক্রিয়াটার মধ্যে নীতি–নৈতিকতার কোনও বালাই না থাকায় ক’দিন না যেতেই আবার তাদের একটা অংশ তৃণমূলে ফিরে আসছে৷ পুরো ব্যাপারটাই আসলে দরকষাকষির৷ এতে জনস্বার্থের চিহ্নমাত্র নেই৷
জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি, যা নিয়ে মানুষ জেরবার হয়ে যাচ্ছে, সেগুলি নিয়ে এই দলগুলির কারও কোনও মাথাব্যথা মানুষ দেখতে পাচ্ছে না৷ মূল্যবৃদ্ধি লাগামছাড়া হলেও এই দলগুলির নেতা–মন্ত্রীরা মানুষকে শুধু মিথ্যা স্তোক দিয়ে যাচ্ছেন– সব কিছুই সরকারের নিয়ন্ত্রণে৷ কর্মসংস্থান নিয়ে মন্ত্রীরা টুঁ শব্দ করছেন না৷ কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই৷ মালিক শ্রেণির স্বার্থে শ্রম আইন বদলে দিয়ে শ্রমিকদের উপর আরও বোঝা চাপানোর ব্যবস্থা করছে সরকার৷ মহিলাদের উপর নির্যাতন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে৷ এ সবের হাত থেকে রেহাইয়ের কোনও কর্মসূচিই এই দলগুলির কারও নেই৷ বাস্তবে যে রাজনীতির চর্চা এই দলগুলি করে তা শুধুমাত্র মালিক শ্রেণির স্বার্থই রক্ষা করে, সাধারণ মানুষের স্বার্থ নয়৷ তাই এদের জয়ে মালিকরা, পুঁজিপতি শ্রেণি উচ্ছ্বসিত৷ নির্বাচনে এদের পিছনে তারা টাকা ঢালে৷ কিন্তু এই ভ্রষ্ট রাজনীতি, যা মানুষকে ক্রমাগত প্রতারিত করে চলেছে, এর হাত থেকে রেহাইয়ের উপায় তা হলে কী? উপায় একটাই– পুঁজিপতি শ্রেণি তাদের তাঁবেদার এই রাজনৈতিক দলগুলির নেতা–মন্ত্রীদের সাথে যোগসাজশে একতরফা যে শোষণ–ত্যাচার সাধারণ মানুষের উপর চালিয়ে যাচ্ছে তার বিরুদ্ধে যথার্থ বামপন্থীদের নেতৃত্বে ধর্ম–বর্ণ নির্বিশেষে শোষিত মানুষের ঐক্যবদ্ধ ভাবে দাঁড়ানো, জীবনের দাবিগুলি নিয়ে প্রবল গণআন্দোলন গড়ে তোলা৷ আন্দোলন গড়ে তুলতে গিয়ে শোষিত মানুষের সংহতি গড়ে তোলা৷ সর্বত্র আন্দোলনের কমিটি গড়ে তোলা৷ শক্তি সঞ্চয়ের মধ্যে দিয়ে সেগুলিই এক দিন শোষণমূলক এই সমাজটিকে বদলে দেবে৷