কর্মচারী হিসেবে স্বীকৃতি, সাম্মানিক ভাতা বৃদ্ধি সহ তাঁদের পেশাগত জীবনের নানা দাবিতে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকারা দিল্লিতে ধর্মঘট এবং মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে লাগাতার ধর্নায় সামিল হয়েছিলেন। ধর্মঘট ভাঙতে মুখ্যমন্ত্রীর সহায়তায় দিল্লির লেফটেন্যান্ট গভর্নর এসেন্সিয়াল মেনটেন্যান্স অ্যাক্ট (এসমা) জারি করেছেন। একটা দেশে বড়সড় বিপর্যয় ঘটে গেলে কিংবা অতিপ্রয়োজনীয় কাজকর্ম দীর্ঘকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেলে এসমার মতো দমনমূলক আইন জারি করে কেন্দ্রীয় সরকার। অঙ্গনওয়াড়ি আন্দোলনে কী এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে?
১৯৭৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকার গড়ে তুলেছিল ইন্ট্রিগ্রেটেড চাইল্ড ডেভলপমেন্ট সার্ভিসেস প্রোগ্রাম (আইসিডিএস বা অঙ্গনওয়াড়ি প্রকল্প)। এই প্রকল্প চালু হয়েছিল গ্রামীণ শিশুদের ক্ষুধা ও অপুষ্টি দূরীকরণের উদ্দেশ্যে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের নানা প্রান্তের অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকারা মহিলা ও শিশুদের বিকাশে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেন। অথচ এঁদের নেই সরকারি কর্মচারীর স্বীকৃতি। নেই বাঁচার মতো সাম্মানিক ভাতা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। এঁরাই সমাজের সবচেয়ে বেশি নিষ্পেষিত, অবহেলিত অংশের মানুষ। প্রকল্প চালুর ৪৭ বছর অতিক্রান্ত, কিন্তু কোনও সরকারই সরকারি কর্মচারীর স্বীকৃতি দেয়নি এঁদের। বতর্মান বিজেপি সরকার তো বটেই, সরকারি কর্মচারী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে রাজি হয়নি পূর্বতন কংগ্রেস সরকার, সিপিএম এবং তৃণমূল কংগ্রেস সহ নানা আঞ্চলিক দলও। আন্দোলনরত কর্মীদের দাবি, সরকারের উচিত অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের অবিলম্বে সরকারি কর্মচারীর স্বীকৃতি দেওয়া এবং এসমা তুলে নেওয়া। শিশুপুষ্টিতে বরাদ্দ কমানোর হোতা বিজেপি সরকার স্বাভাবিকভাবেই এই প্রকল্পকে ব্রাত্য করে রেখেছে। ভোট রাজনীতির খেলোয়াড় ক্ষমতালোভী দলগুলির নেতা-মন্ত্রীরা তাই শিশু ও মায়েদের দুঃখে চোখের কোণ মুছলেও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের দাবির প্রতি নূ্যনতম মর্যাদা দিতে রাজি নয়।
অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা তাঁদের অসহায়তার কথা, তার প্রতিকারের দাবি প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী সহ নানা প্রশাসনিক দপ্তরে বারবার জানিয়েও কোনও সুরাহা পাননি। নিরুপায় হাজার হাজার অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী আন্দোলনে নামেন। স্কিম ওয়ার্কার্স ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়া এবং শ্রমিক সংগঠন এআইইউটিইউসি সহ নানা সংগঠনের নেতৃত্বে দেশজুড়ে আন্দোলন চলছে। একমাস ধরে হরিয়ানায় আন্দোলন করে চলেছেন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী-সহায়িকারা। ফেব্রুয়ারি থেকে দিল্লির বুকে একটানা ধর্মঘট চলছে। এই প্রতিবেদন লেখার সময় ধর্মঘট ৩৯ দিনে পা দিয়েছে। সরকার এঁদের দাবি শোনার পরিবর্তে চূড়ান্ত অগণতান্ত্রিক কায়দায় ধর্মঘট ভাঙতে এসমা জারি করেছে। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা মনে করেন, এভাবে তাঁদের আন্দোলন ভাঙতে পারবে না সরকার। আশ্চর্যের বিষয়, আইনত এসমার মতো কালা কানুন সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে জারি করা যায়। কিন্তু সরকার অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের আজ পর্যন্ত সরকারি কর্মী হিসাবে স্বীকৃতি দেয়নি। তা সত্ত্বেও কীভাবে তাদের উপর এসমা জারি করল সরকার? আসলে আন্দোলন দমন করতে সরকার নিজেই নিজের আইন ভাঙছে।
অসংগঠিত এই ক্ষেত্রের কর্মীরা আজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের অধিকার, মর্যাদা সব কিছু আদায়ে বদ্ধপরিকর। সরকারি কর্মচারী হিসাবে স্বীকৃতি দিলে তাদের মাইনে বাড়াতে হবে, পি এফ-পেনশন সহ অন্যান্য সরকারি কর্মীদের মতো নানা সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে, তা দিতে রাজি নয় কোনও সরকারই। সমাজের সুবিশাল দায়িত্ব পালন করেন যে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা পুঁজিপতি শ্রেণির সেবক সরকার তাদের প্রতি নিজের দায়িত্ব অস্বীকার করছে। শিশু পুষ্টির মতো জরুরি বিষয়ে শুধুমাত্র সাফল্যের বিজ্ঞাপন দিয়েই সরকারের দায়িত্ব শেষ। আর সভ্যতার পিলসুজ এই কর্মীরা দিনরাত এক করে, ঝড়-জল উপেক্ষা করে নিজেদের নিংড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
ক্ষমতাশালী দলগুলির উপর ক্ষুব্ধ ২২ হাজার অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও তাদের পরিজন দিল্লির পৌরসভা নির্বাচনে আপ এবং বিজেপিকে বয়কট করেছিলেন। এমনকি ওই দলগুলির কোনও নেতাকে ওই সমস্ত এলাকায় প্রচার পর্যন্ত করতে দেননি। এই সংঘবদ্ধতা সরকারের চোখে আতঙ্কের।
সেজন্য অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের আন্দোলনে শিশুদের ভবিষ্যৎ নষ্ট হবে এবং সামাজিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে–এই কথা বলে আন্দোলন তুলে নেওয়ার হুমকি দিয়েছিল অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আপ সরকার। সরকারের মহিলা ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রী সেই বার্তা আন্দোলনকারীদের কাছে পৌঁছে দেন। কিন্তু সরকার নিজেদের দায় ঝেড়ে ফেলতে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের দাবি না মেনে দমনমূলক আইন প্রয়োগের যে হীন পন্থা নিচ্ছে, তাতে ধিক্কার জানিয়েছেন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকারা। দাবি না আদায় হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে বলে জানিয়েছেন নেতৃবৃন্দ। ১৪ মার্চ কলকাতা সহ দেশের নানা স্থানে সংহতি দিবস পালন করেন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী-সহায়িকারা।