আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের পরামর্শে স্বামী বিবেকানন্দ জন্ম জয়ন্তী পালন করতে বিজেপি নেতারা কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন৷ কোটি কোটি টাকা খরচ করে অন্য দল ভাঙিয়ে এবং পুঁজিপতিদের আশীর্বাদে বেশ কিছুটা প্রচারের আলো পেলেও বাংলার মাটিতে কিছু করতে গেলে যে শুধু উগ্র সাম্প্রদায়িক জিগির দিয়ে চলবে না সে কথা বুঝে তাঁরা এখন বিবেকানন্দের শরণ নিয়েছেন৷ আশা, বিবেকানন্দ হয়ে উঠবেন ২০১৯ সালে তাঁদের ভোট বৈতরণীর কান্ডারি৷ কিন্তু হিন্দু ধর্মের অন্যতম প্রবক্তা হয়েও বিবেকানন্দ যে উদার মত প্রচার করেছেন, মানবদরদের যে গভীর অনুভুতি তাঁর সমস্ত কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত হয়ে আছে, বিজেপি এবং তাদের অভিভাবক আরএসএস কি সে ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার বহন করে? নাকি কেবলমাত্র তাঁর ধর্ম সংক্রান্ত কিছু কথাকে বিচ্ছিন্নভাবে তুলে ধরে উগ্র হিন্দুত্ববাদ, ধর্মীয় বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টির কাজে বিবেকানন্দ নামটিকে ব্যবহার করতে চায়? আরএসএসের ইতিহাস কিংবা বিজেপির কার্যকলাপ দেখলে শেষোক্ত সম্ভাবনাটিই টিকে থাকে৷
একসময় বিবেকানন্দও আশঙ্কা করেছিলেন যে তাঁর কথাকে সংকীর্ণ স্বার্থে ব্যবহার করা হতে পারে৷ তিনি একটি চিঠিতে লিখেছেন ‘‘…কলকাতার লোকদের অবশ্যই সাবধান করে দেবে, আমার কোনও লেখা বা কথার ভেতর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য মিথ্যা করে আরোপিত না হয়৷১ বিজেপির রাজত্বে যুক্তিবাদী মানুষের উপর আক্রমণ হচ্ছে৷ উগ্র হিন্দুত্ববাদী উন্মত্ততার বিরোধিতা যাঁরা করছেন তেমন লেখক–বুদ্ধিজীবী–সাংবাদিকদের হত্যা পর্যন্ত করা হচ্ছে৷ বিজেপির সর্বভারতীয় নেতৃবৃন্দ, সাংসদ থেকে শুরু করে নানা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরাও উস্কানি দিয়ে চলেছেন উগ্র বিদ্বেষের বিষ ফেনিয়ে তুলতে৷ এই উগ্রতা, ধর্মান্ধতা কি বিবেকানন্দ চেয়েছিলেন? মৃত্যুর কয়েকমাস আগে ঢাকা ভ্রমণকালে বিবেকানন্দ বলেছেন– ‘ধর্মভাব সম্বন্ধে দেখলুম, দেশের লোকগুলো বড় কনজারভেটিভ; ধর্ম করতে গিয়ে অনেকে আবার ফ্যানাটিক হয়ে পড়েছে’৷২ আজ মানুষকে ফ্যানাটিক অর্থাৎ ধর্মান্ধ বানাতে চাওয়া বিজেপি–আরএসএসই বড় বিবেকানন্দ ভক্ত সেজেছে! ২০১২ সালের গুজরাট বিধানসভা ভোট, ২০১৪ সালের লোকসভা ভোট এবং সর্বোপরি ২০১৭ সালে সদ্যসমাপ্ত গুজরাট বিধানসভা ভোটের আগে দেখা গেছে বিবেকানন্দের ছবির পাশে শোভা পেয়েছে নরেন্দ্র মোদির ছবি এবং বিজেপির ভোটের প্রতীক পদ্মফুল৷ এরা বিবেকানন্দকে ভক্তি করে? এদেশের মানুষকে যে অতি সহজে ধর্মের ভাবাবেগে ভাসিয়ে দেওয়া যায় তা বুঝেই বিজেপির ভক্তি উথলে উঠেছে৷
অযৌক্তিক চিন্তা, ধর্মান্ধতা, পুরাতন ঐতিহ্যের নামে গোঁড়ামিকেই ধর্মবিশ্বাস বলে চালাতে চাইছে বিজেপি৷ এটাই তাদের রাজনীতির ভিত্তি৷ অথচ বিবেকানন্দ বলছেন, ‘‘ধর্ম যাহা কিছু বলে, সবই যুক্তির কষ্টিপাথরে ফেলিয়া পরীক্ষা করা আবশ্যক৷ কেহই বলিতে পারে না, সকল ধর্মই কেন এই দাবি করিয়া থাকে যে, তাহারা যুক্তি দ্বারা পরীক্ষিত হইতে বাধ্য নয়৷…যুক্তির মানদণ্ড ব্যতীত ধর্মবিষয়েও কোনরূপ বিচার বা সিদ্ধান্ত সম্ভব নয়৷’’৩ বিজেপি প্রাচীনত্বের দোহাই পেড়ে পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারতের রূপক গল্পকেই ঐতিহাসিক সত্য বলে চালাতে চাইছে, শাস্ত্র বচনকে অভ্রান্ত বলে আবার দেশের মানুষের ঘাড়ে চাপাতে চাইছে, সেখানে ধর্মপ্রচারক হয়েও বিবেকানন্দ ঠিক তার বিপরীত কথা বলেছেন৷ ‘‘আমি অবশ্য বেদের ততখানিই গ্রহণ করি, যতখানি যুক্তির সাথে মেলে৷’’৪ তিনি আরও বলছেন, ‘‘…প্রাচীন শাস্ত্রে বর্ণিত এই সকল ঈশ্বরের দূত বা মহাপুরুষের কাহিনীকে যখন যুক্তিসম্মত বলিয়া প্রমাণ করিতে পারিব, তখন আমরা তাঁহাদিগকে বিশ্বাস করিব৷’’৫ যে বিজেপি–আরএসএসের প্রচারক বুদ্ধিজীবীরা মহাভারতের যুগে স্টেম সেল থেরাপি আবিষ্কার হয়েছিল বলে বিজ্ঞানের সিলেবাসে লিখেছে, যে দলের নেতা প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসে গণেশের মাথাকে প্লাস্টিক সার্জারির নিদর্শন বলেন, তাদের বিকোনন্দের অনুসারী বলে মানতে হবে?
বিবেকানন্দের আর একটি কথা আজকের সময় খুবই স্মরণযোগ্য–‘‘সকল ধর্মের ও সকল দেশের দুর্বল অপরিণত মস্তিস্ক ব্যক্তিগণ একটিমাত্র উপায়েই তাহাদের নিজ আদর্শ ভালবাসতে পারে৷ সে উপায়টি–অপর সমূদয় আদর্শকে ঘৃণা করা৷’’৬ আরও বলেছেন, ‘‘গোঁড়াদের গোঁড়ামির কারণ এই যে, তাহারা এই গোঁড়ামি করিয়া নিজেরা কিছু লাভের প্রত্যাশা করে৷’’৭ বিজেপির সাথে মিলে যাচ্ছে না? অবশ্য বিজেপি–আরএসএস ‘অপরিণত মস্তিস্ক্’ নয়, তারা জেনে বুঝে ঘৃণার রাজনীতি করে চলেছে৷ বিজেপি–আরএসএস মুসলমান বিরোধিতাকে হাতিয়ার করে নিজেদের হিন্দু ধর্মের চ্যাম্পিয়ন প্রতিপন্ন করতে চাইছে৷ এর ফলে একদিকে বেরোজগারি, বেকারি, মূল্যবৃদ্ধিতে জেরবার সাধারণ মানুষের মন আসল সমস্যা থেকে ঘুরিয়ে ধর্মের হানাহানিতে ফাঁসিয়ে দেওয়া যাবে৷ তাদের আশা এই দিয়েই তারা ভোটব্যাঙ্ক অটুট রাখতে পারবে৷ তাই সদ্য সমাপ্ত গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তীব্র ঘৃণার সাথে বিরোধী দলের নেতাকে ‘অওরঙ্গজেব কা আওলাদ’ বা অওরঙ্গজেবের সন্তান বলে বিদ্রুপ করতে পারেন৷ উত্তরপ্রদেশের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ভোটের আগে মুসলমান মহিলাদের প্রতি কদর্যইঙ্গিত করে হিন্দু ভোটব্যাঙ্ককে খুশি করতে চেয়েছিলেন৷ বিজেপি রাজত্বে তাজমহলকে ভারতীয় ঐতিহ্যের অংশ হিসাবে স্বীকার করা হচ্ছে না৷ তারা হুঙ্কার দিচ্ছে, তাজমহলের জায়গায় হিন্দু মন্দির ছিল, অতএব তা ভেঙে ফেলতে হবে৷ বিবেকানন্দের বক্তব্য কী? বিবেকানন্দের প্রিয় শিষ্যা নিবেদিতা লিখেছেন, ‘‘মোগলগণের গরিমা স্বামীজি শতমুখে বর্ণনা করিতেন৷… আগ্রার সন্নিকটে সেকেন্দ্রার সেই গম্বুজবিহীন অনাচ্ছাদিত সমাধির পাশে বসিয়া আকবরের কথা বলিতে বলিতে স্বামীজির কণ্ঠ যেন অশ্রু গদগদ হইয়া আসিত৷’’৮ নিবেদিতা আরও লিখেছেন, এক শিষ্য শাহজাহান মুসলমান বলে তাকে বিদেশি বলায় বিবেকানন্দ তাকে তীব্র ভর্ৎসনা করেছিলেন৷ উদার মনের বিবেকানন্দ এমনকী একথাও বলেছেন– ‘‘এটা খুবই স্বাভাবিক যে একই সময়ে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে এবং নির্বিরোধে আমার ছেলে বৌদ্ধ, আমার স্ত্রী খ্রীস্টান ও আমি নিজে মুসলমান হতে পারি’’৷৯
বিজেপি তথাকথিত রাম জন্মভূমি খুঁজে বার করে মসজিদ ভেঙেছে আর এখন অযোধ্যায় মন্দির আর রামের বিশালাকার মূর্তি নির্মাণ নিয়ে তাদের প্রবল উৎসাহ৷ এ বিষয়ে বিবেকানন্দ কী বলছেন? ‘‘রামায়ণের কথাই ধরুন– অলঙঘনীয় প্রামাণ্য গ্রন্থরূপে উহাকে মানিতে হইলেই যে, রামের ন্যায় কেহ কখনো যথার্থ ছিলেন স্বীকার করিতে হইবে, তাহা নহে৷…পুরাণে বর্ণিত ব্যক্তিগণ বাস্তবিকই ছিলেন, অথবা তাঁহারা কাল্পনিক চরিত্রমাত্র, এ বিচারের কিছুমাত্র আবশ্যকতা নাই৷’’১০ বিবেকানন্দকে মানতে গেলে বিজেপিকে মানা চলে কি?
জাতীয়তাবাদ এবং হিন্দুত্বকে সমার্থক হিসাবে প্রচার করছে বিজেপি৷ বিপরীতে বিবেকানন্দ বলছেন, ‘‘বেদান্তে কোন ধর্ম সম্প্রদায়, ধর্ম বা কোন জাতি বিচার নাই৷ কীভাবে এই ধর্ম ভারতের জাতীয় ধর্ম হইতে পারে?’’১১
বিবেকানন্দ বলেছেন– ‘‘দারিদ্র ও অবহেলার জন্যই আমাদের এক–পঞ্চমাংশ লোক মুসলমান হইয়া গিয়াছে৷ কেবল তরবারির বলে ইহা সাধিত হয় নাই৷’’ ‘‘…বস্তুত জমিদার ও পুরোহিতবর্গের হস্ত হইতে নিষৃক্তিলাভের জন্যই উহারা ধর্মান্তর গ্রহণ করিয়াছিল৷’’ ‘‘…এজন্য অপর কাহাকেও দোষ দিও না, দোষ দাও নিজের ধর্মকে৷’’১২ তথাকথিত ঘরওয়াপসী অর্থাৎ ধর্মান্তরণ, লাভ জেহাদের অ্যাজেন্ডা নিয়ে মশগুল বিজেপি বিবেকানন্দের এই বক্তব্যকে মানে?
একচেটিয়া মালিকদের সেবাদাস বিজেপি সাধারণ মানুষের স্বার্থকে পুঁজিপতিদের পায়ে বলি দিচ্ছে৷ এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার রক্ষক হিসাবে তারা মনুষ্যত্বকে মারতে চায়, যুক্তি–বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তাকে মারতে চায়৷ তাই মানুষকে বলি দিচ্ছে মন্দিরের ইঁটপাথরের পাষাণস্তূপে৷ এক্ষেত্রে বিবেকানন্দের কথা তাঁদের পক্ষে অস্বস্তিকর হবে– ‘‘ফেলে দে তোর শাস্ত্র–ফাস্ত্র গঙ্গা জলে৷ দেশের লোকগুলোকে আগে অন্ন সংস্থান করবার উপায় শিখিয়ে দে, তারপর ভাগবত পড়ে শোনাস৷’’১৩ তিনি বলতেন– ‘যে ধর্ম গরিবের দুঃখ দূর করে না, মানুষকে দেবতা করে না, তা কি আবার ধর্ম?’১৩ তিনি আরও বলেছেন, ‘‘ক্রোর টাকা খরচ করে কাশী–বৃন্দাবনের ঠাকুরঘরের দরজা খুলছে আর পড়ছে৷ আর এই ঠাকুর কাপড় ছাড়ছেন, তো এই ঠাকুর ভাত খাচ্ছেন, তো এই ঠাকুর আঁটকুড়ির ব্যাটাদের গুষ্টির পিণ্ডি করছেন এদিকে জ্যান্ত ঠাকুর অন্ন বিনা, বিদ্যা বিনা মরে যাচ্ছে’৷১৪ তাঁর ডপলব্ধি, ‘‘যে ভগবান আমাকে অন্ন দিতে পারেন না, তিনি যে আমাকে স্বর্গে অনন্ত সুখে রাখবেন –ইহা আমি বিশ্বাস করি না’’৷১৫ বিজেপি–আরএসএস এই বিবেকানন্দকে তুলে ধরতে সাহস পাবে তো?
কিছু দিন আগেই বিবেকানন্দের শিকাগো ধর্ম সম্মেলনের ভাষণ বিশ্ববিদ্যালয়ে শোনানোর জন্য বিজেপি সরকার ফরমান জারি করেছিল৷ যেন বিবেকানন্দ মানে আরএসএস–বিজেপির মতো হিন্দুত্ব, অন্য ধর্মের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ৷ তা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মগজধোলাই করা ছিল মতলব৷ অথচ তিনি কেন শিকাগো ধর্মসভায় গিয়েছিলেন, সে সম্পর্কে বিবেকানন্দ নিজেই বলেছেন– ‘‘তোমরা অনেকেই জান, আমেরিকায় ধর্মমহাসভা হইয়াছিল বলিয়া আমি সেখানে যাই নাই, দেশের জনসাধারণের দুর্দশা দূর করিবার জন্য আমার ঘাড়ে একটা যেন ভূত চাপিয়াছিল৷ আমি অনেক বৎসর যাবৎ সমগ্র ভারতবর্ষে ঘুরিয়াছি– কিন্তু আমার স্বদেশবাসীর জন্য কাজ করিবার কোনও সুযোগ পাই নাই৷ – সেই জন্যই আমি আমেরিকায় গিয়েছিলাম৷ তখন তোমাদের মধ্যে যাহারা আমাকে জানিতে, তাহারা অবশ্য সে কথা জানো৷ ধর্মসভা লইয়া কে মাথা ঘামায়? এখানে আমার নিজের রক্তমাংস স্বরূপ জনসাধারণ দিন দিন ডুবিতেছে, তাহাদের খবর কে লয়?’’১৬
আমাদের দেশের নবজাগরণের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে এযুগের মহান মার্কসবাদী চিন্তানায়ক বিশিষ্ট দার্শনিক শিবদাস ঘোষ দেখিয়েছিলেন যে, ভারতবর্ষের জাতীয় বুর্জোয়ারা স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়েই আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া শ্রেণির অংশ হিসাবে সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে রিফর্মিস্ট অপোজিশনাল (সংস্কারপন্থী বিরুদ্ধবাদী) হয়ে পড়েছিল৷ ফলে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে যেমন আপসমুখী ধারা প্রাধান্য বিস্তার করেছিল, তেমনি ধর্মীয় কুসংস্কার, কূপমণ্ডুকতা, সামাজিক কু–প্রথার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রেও আপসমুখী চিন্তা কাজ করছিল৷ হিন্দু ধর্মভিত্তিক চিন্তা জাতীয়তাবোধের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল৷ যদিও এর বিপরীতে আপসহীন চিন্তাও সমাজে বিরাজ করছিল৷ কিন্তু সেটি প্রাধান্য বিস্তার করতে পারেনি৷ বিদ্যাসাগরের মধ্যে প্রতিভাত হয়েছে ধর্মনিস্পৃহ মানবতাবাদের আপসহীন বলিষ্ঠতা৷ আর বিবেকানন্দের মধ্যে মানবতাবাদের সঙ্গে ঐতিহ্যবাদের সুর মিশে গেছে৷ বিবেকানন্দ হিন্দু ধর্মের পুনরুজ্জীবনবাদের প্রবক্তা হলেও স্বদেশপ্রেমের চিন্তা থেকে উদ্ভূত উদার মনোভাব নিয়ে চলেছেন৷ একদিকে তিনি জাতীয়তাবাদী মানবদরদী, যিনি সিংহগর্জনে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর তুলেছেন, অন্যদিকে অদ্বৈতবাদী ধর্মপ্রচারক বিবেকানন্দ নিজেই তাঁর এই সত্ত্বার বিরোধিতা করেছেন৷ যদিও তাঁর তেজোদ্দীপ্ত উপস্থিতি সে সময় ছাত্র–যুবকদের স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছে, সংকীর্ণ ধর্মীয় অন্ধতায় নিমজ্জিত করেনি৷ মানবতাবাদের দ্বারা প্রভাবিত বিবেকানন্দ বিদ্যাসাগরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন৷ তাই তিনি একসময় বলেছিলেন, ‘‘যখন শুনলাম ১৮৬৪ খ্রীস্টাব্দের দুর্ভিক্ষে অনাহারে এবং রোগে এক লক্ষ চল্লিশ হাজার মানুষ কালগ্রাসে পতিত হওয়ায় এই মহাপুরুষ (বিদ্যাসাগর) মর্মাহত হয়ে ‘আর ভগবান মানি না’ বললেন, তখন আমরা যারপরনাই অভিভূত হয়ে পড়লাম’’৷
মানবদরদী মন নিয়ে বিবেকানন্দ মানুষের যে কল্যাণ চেয়েছিলেন, তা আজ অর্জন করতে গেলে এগোতে হবে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত চিন্তার ভিত্তিতে৷ গড়ে তুলতে হবে আন্দোলন৷ বিজেপি এর উত্তরাধিকার বহন করতে পারে না৷ এই বিজেপির পূর্বসূরি হিন্দু মহাসভা ধর্মীয় গোঁড়ামির জিগির তুলে ভোট চাইছে দেখে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেন –‘‘ধর্মের সুযোগ নিয়া, ধর্মকে কলুষিত করিয়া হিন্দু মহাসভা রাজনীতি ক্ষেত্রে দেখা দিয়াছে৷ হিন্দু মাত্রেরই তার নিন্দা করা কর্তব্য৷’’১৭ আরএসএস সব সময় ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধিতা করে এসেছে৷ তারা আজ হয়েছে জাতীয়তাবাদের অভিভাবক!
আরএসএস–বিজেপি নেতারা বিবেকানন্দের ছবিকে তাদের হীন স্বার্থে, ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করতে এবং তার মাধ্যমে ভোট ব্যাঙ্ক তৈরির কাজে ব্যবহার করতে চাইছে৷ এর নিন্দা করা প্রতিটি ভারতবাসীর কর্তব্য নয় কি?
১৷স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ৭ম খণ্ড পৃঃ ৯, ২৷ আমি বিবেকানন্দ বলছি, পৃঃ ৩৫৪, ৩৷ স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, ২য় খণ্ড পৃঃ ২০৩), ৪৷ ওই, ৩য় খণ্ড পৃঃ ১৭৩, ৫৷ ওই, পৃঃ২০৮, ৬৷ ওই, ৪থ খণ্ড, পৃঃ ৫, ৭৷ ওই, ১ম খণ্ড পৃঃ ৮৩, ৮৷ ওই, ৯ম খণ্ড পৃ ১৭৫, ৯৷ ওই, ৩য় খণ্ড পৃঃ ১৭২, ১০৷ ওই, ৯ম খণ্ড পৃঃ ২৯৭, ১১৷ ওই, ৩য় খণ্ড পৃঃ ২৮৬, ১২৷ ওই, ৫ম খণ্ড পৃঃ ৪৩ এবং ১৪৭, ৭ম খণ্ড পৃঃ২২, ১৩৷ ওই, ৯ম খণ্ড পৃঃ ১০৪, ১৪৷ ওই, ৭ম খণ্ড পৃঃ ৫২, ১৫৷ ওই, পৃঃ ২৬, ১৬৷ ওই, ৫ম খণ্ড পৃঃ–৮৯, ১৭৷ আনন্দবাজার পত্রিকা, ১২ মে ১৯৪০, ঝাড়গ্রামে প্রদত্ত নেতাজি সুভাষচন্দ্রের ভাষণ