সম্প্রতি টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের কাছে ভারতীয় দলের হারের পর, দলের ক্রিকেটার মহম্মদ শামিকে উদ্দেশ্য করে বিজেপির আইটি সেল সমাজমাধ্যমে কুরুচিপূর্ণ প্রচার চালিয়েছে। এই ঘটনা এ দেশের ক্রীড়াপ্রেমী সহ আপামর সাধারণ মানুষকে বিস্মিত এবং ব্যথিত করেছে।
হার-জিত খেলারই অঙ্গ। পৃথিবীতে কোনও খেলোয়াড় বা কোনও দলই চিরদিন অপরাজেয় থাকে না। দেশপ্রেমের আবেগকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষ সব সময়ই চায় নিজের দেশ জিতুক। নিজের দেশের দল পরাজিত হলে তারা ব্যথা পায়। কখনও কখনও সেই ব্যথা ক্ষোভের আকারে প্রকাশিত হতে পারে। কিন্তু এবারের এই কুৎসা প্রচারের অভিমুখ এবং ধরন সম্পূর্ণ অন্য। ভারতীয় ক্রিকেট দল পরাজিত হতেই মহম্মদ শামির ধর্মবিশ্বাসকে কেন্দ্র করে যেভাবে কুৎসা এবং সংখ্যালঘুদের দেশপ্রেম নিয়ে কটাক্ষ করা হয়েছে তা পুরোটাই পরিকল্পিত। আরএসএসের মতাদর্শে পরিচালিত বিজেপি সমাজের সমস্ত ক্ষেত্রকেই হিন্দুত্বের বাতাবরণের মধ্যে আনতে চাইছে। পুঁজিপতি শ্রেণির নির্লজ্জ শোষণে দেশের চরম দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন করার জন্য ক্রমাগত চেষ্টা করে চলেছে শাসকরা। বিশেষত সামনে উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে নিজেদের অপশাসনের নজিরগুলি ঢাকতে ধর্মীয় মেরুকরণের জিগির তুলতে চাইছে তারা। তাই এই আক্রমণ।
এদেশের ক্রীড়া প্রশাসনেও বিজেপি বারবার হস্তক্ষেপ করে ক্রীড়া সংস্থাগুলোর ব্যাপক দলীয়করণ করে চলেছে। একচেটিয়া পুঁজির একনিষ্ঠ সেবা করতে দেশের সাধারণ মানুষের ওপর কর, মূল্যবৃদ্ধি সহ ব্যাপক বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে বিজেপি সরকার। এতে মানুষের ক্ষোভ যাতে সংগঠিত প্রতিবাদের আকার না নিতে পারে, সেই জন্য তাদের উগ্র ধর্মীয় বিভাজনের মধ্যে ফাঁসিয়ে দিতে এবারে তারা ক্রীড়াক্ষেত্রকে বেছে নিয়েছে। সেই কারণেই মহম্মদ শামির উপর এই ঘৃণ্য আক্রমণ। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড কিন্তু একটা শব্দও এর বিরুদ্ধে উচ্চারণ পর্যন্ত করেনি। কেন্দ্রীয় সরকারও চোখ বুজে থেকেছে। অথচ একটি গণতান্ত্রিক সরকারের দায়িত্ব হল, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পুত্র এখন ক্রিকেট বোর্ডের সচিব। যে ক্রিকেটারদের স্বার্থ দেখার জন্য বোর্ড, তাদের পাশে দাঁড়ানোর বদলে বাবার রাজনৈতিক স্বার্থই তাঁর কাছে প্রধান হয়ে উঠেছিল কি? যদিও আমরা আশাবাদী এই দেখে যে, ভারতীয় ক্রিকেট দলের একাংশ বিশেষ করে দলের অধিনায়ক বিরাট কোহলি সরাসরি বিবৃতি দিয়ে এই ঘটনার নিন্দা করে বলেছেন, ধর্ম প্রত্যেকের ব্যক্তিগত বিষয়। খেলার মাঠে প্রত্যেকে ভারতীয় হিসেবে খেলতে নামেন। তিনি আরও জানিয়েছেন, তাঁরা মহম্মদ শামির পাশে আছেন। দেশের বেশিরভাগ মানুষের মতও এটাই।
অতীতে ভারতীয় ক্রিকেটের প্রতি দায়বদ্ধতা দেখিয়েছেন যে সমস্ত ক্রিকেটাররা, তাঁদের অনেকেই ধর্ম পরিচয় অনুযায়ী সংখ্যালঘু। কিন্তু তাঁদের সকলেরই ক্রীড়া নৈপুণ্য ক্রিকেটপ্রেমী জনগণকে মুগ্ধ করেছে। মনসুর আলি খান পতৌদি বা মহম্মদ আজহারউদ্দিন, জাহির খান সহ আরও অনেকেই ভারতীয় ক্রিকেট দলকে বহু স্মরণীয় জয় উপহার দিয়েছেন। এমনকি মহম্মদ শামিও অতীতে বহুবার তাঁর নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। কিন্তু নিজেদের নোংরা কায়েমি স্বার্থে বিজেপি-আরএসএস আজ খেলাকেও ধর্মের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলতে চায়। খেলার মাঠে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার যে ঐতিহ্য রয়েছে তাকে তারা মুছে ফেলতে চায়। এর বিরুদ্ধে গোটা দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে সোচ্চার হতে হবে।