বিজেপির রাজ্য সভাপতি সম্প্রতি বলেছেন, আমফানকে জাতীয় বিপর্যয় বলা উচিত নয়৷ তাদের আরও বক্তব্য, অসংগঠিত শ্রমিকদের আর্থিক সাহায্যের দাবিও বাস্তবসম্মত নয় (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬ জুন, ’২০)৷
আমফানকে জাতীয় বিপর্যয় বলতে বিজেপির এত আপত্তি কেন? এই প্রলয়ঙ্করী ঝড়ে হাজার হাজার বাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে, নদীবাঁধ ভেঙেছে, কোটি কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়েছে, কয়েক হাজার বিদ্যুতের পোস্ট উপড়ে গিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়েছে, লক্ষ লক্ষ গবাদি পশুর মৃত্যু হয়েছে৷ এই ঝড়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের আর্থিক দুর্দশা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে৷ এ যদি জাতীয় বিপর্যয় না হয়, তাহলে জাতীয় বিপর্যয় কোনটা?
এস ইউ সি আই (সি) আমফান ঝড়ের পরে পরেই একে জাতীয় বিপর্যয় ঘোষণা করে পর্যাপ্ত ত্রাণের দাবি জানিয়েছে৷ অন্য দলগুলিও দাবি তুলছে৷ অথচ ত্রাণের ব্যাপারে সর্বদলীয় প্রস্তাবে জাতীয় বিপর্যয়ের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হতেই বিজেপি বাগড়া দিচ্ছে৷ জাতীয় বিপর্যয় বললে অবশ্যই গুরুত্বের বিচারে বেশি ত্রাণ প্যাকেজ বরাদ্দ হওয়ার কথা৷ বিজেপির বিরোধিতায় তাতে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে৷ কেন্দ্রীয় সরকার নিজেও সরেজমিনে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে ত্রাণের ব্যাপারে তৎপর নয়৷ রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রের এই বঞ্চনার বিরুদ্ধে এ রাজ্যের মানুষের আজ সোচ্চার হওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে৷
অসংগঠিত শ্রমিকদের আর্থিক সাহায্যের প্রশ্নেও বিজেপি বিরোধিতা করছে৷ অথচ এই বিজেপি সরকারই রাজকোষ থেকে দফায় দফায় কোটি কোটি টাকা ত্রাণ প্যাকেজ দেয় পুঁজিপতিদের৷ ব্যাঙ্ক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করে ব্যাঙ্ককে দেউলিয়া করে দিলে বিজেপি সরকার পুঁজিপতিদের হয়ে সেই ‘ব্যাড লোন’ শোধ করে দেয়৷ এসব বিজেপি নেতাদের চোখে বাস্তবসম্মত৷ তাদের যত আপত্তি শ্রমজীবী মানুষের কল্যাণে৷
বহু ঢাক–ঢোল পিটিয়ে মোদি সরকার সম্প্রতি যে ‘গরিব কল্যাণ রোজগার প্রকল্প ঘোষণা করেছে, সেটাও বঞ্চনা এবং প্রতারণায় ভরা৷ এই প্রকল্পে ৫০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে৷ বাস্তবে এটি নতুন কোনও বরাদ্দ নয়৷ ১২ টি মন্ত্রকের ২৫ টি প্রকল্প থেকে এই টাকা কাটছাঁট করে এনে নতুন বরাদ্দ হিসাবে উপস্থিত করা হয়েছে৷ এটা জনগণের প্রতি প্রতারণা ছাড়া আর কী?
আর বঞ্চনা? সে তো সর্বব্যাপক৷ এই প্রকল্পে ২৯টি রাজ্যের মধ্যে মাত্র ৬টি রাজ্যের ১১৬টি জেলাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে৷ বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ– এই ছ’টি রাজ্য প্রকল্পে এলেও পশ্চিমবঙ্গ সহ ২৩টি রাজ্য বাদ৷ সারা দেশে ১৫ কোটিরও বেশি পরিযায়ী শ্রমিক থাকলেও মাত্র ৭০ লক্ষকে এই প্রকল্পে আনার কথা বলা হয়েছে৷ অর্থাৎ ৯০ শতাংশেরও বেশি শ্রমিককে বাদ রাখা হয়েছে এ থেকে৷ কেন এই বৈষম্য?
পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে মোদি সরকারের কোনও দায়িত্বই নেই৷ লকডাউন ঘোষণা করেই খালাস, তারা কী করে বাড়ি ফিরবে, তার কোনও পরিকল্পনাই ছিল না সরকারের৷ পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য একটি আইন আছে৷ ইন্টারস্টেট মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কমেন অ্যাক্ট–১৯৭৯৷ এই আইন অনুযায়ী পরিযায়ী শ্রমিকদের রাজ্যের শ্রমিকদের সমান হারে মজুরি দেওয়ার কথা৷ তাছাড়া ঘর ছেড়ে থাকার দরুন নানাবিধ ভাতা ও চিকিৎসার সুযোগ পাওয়ার কথা তাঁদের৷ কিন্তু পুঁজিবাদী শাসনে এইসব আইনের কোনও মূল্যই দেয় না মালিকরা৷ বিজেপি শাসিত রাজ্য থেকে শুরু করে কংগ্রেস শাসিত রাজ্য, সিপিএম শাসিত রাজ্য বা তৃণমূল শাসন– কোথাওই এই আইন প্রয়োগ করা হয় না৷ যে দলের শাসনই কায়েম থাকুক না কেন, সর্বত্রই মালিকদের একচেটিয়া অধিকার৷ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রে শ্রমিক স্বার্থে আইন মুখ বুজে থাকে আইনের বইয়ের পৃষ্ঠাতেই৷
এই অবস্থায় আমফানের জন্য বরাদ্দ হোক বা পরিযায়ী শ্রমিকদের আর্থিক সাহায্যই হোক– বাস্তবায়িত করতে হলে কেন্দ্রীয় বঞ্চনার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে৷