হঠাৎ আরএসএসের পক্ষ থেকে বিজেপি সরকারের সমালোচনায় অবাক দেশের মানুষ। চারটি রাজ্যে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর যখন স্বাভাবিকভাবেই বিজেপির এই অভিভাবকের উল্লসিত হওয়ার কথা, ঠিক তখনই আমেদাবাদে ১১-১৩ মার্চ আর এস এস-এর বার্ষিক সভায় বেকারত্ব নিয়ে মোদি সরকারের দিকে আঙুল উঠল। কেন ঘরের ভেতর থেকেই এই সমালোচনা? তবে কি আর এস এস বুঝতে পারছে ভোটের ময়দানে বিজয়ের গৌরব আর হিন্দুত্বের ক্যাপসুল দিয়ে, উগ্র দেশপ্রেম আর জাতীয়তাবাদের ভাবাবেগ দিয়ে বেকারত্বের জ্বালা ভোলানো যাচ্ছে না? তবে কি আরএসএস আপাত শান্ত জনগণের মধ্যে জমা বেকারত্বজনিত বিক্ষোভ কিঞ্চিত হালকা করার চেষ্টা করতেই সমালোচকের ভেক ধরেছে?
২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার আগে বছরে দু’ কোটি নতুন কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মোদিজি। সেই প্রতিশ্রুতি পূরণ করলে মাসে ষোল লক্ষেরও বেশি চাকরি জুটত। সেই প্রতিশ্রুতির কতটা পূরণ হয়েছে? মাসে ষোল লাখ কেন, ছ’ লাখ চাকরি জুটেছে এমন কোনও তথ্য নেই। করোনা অতিমারির সময়ের কথা না হয় বাদই থাকল। অতিমারির পূর্বেকার ছ’ বছরে কি বারো কোটি চাকরি জুটেছে? মুদ্রার বিপরীত দিকটি আরও অন্ধকার। সরকারের সংস্কারনীতির বলি হয়ে লাখ লাখ শ্রমিক কাজ হারিয়েছে। কোভিড এসে তা কোটিতে নিয়ে গেছে।
কোভিড সংক্রমণের আগে ২০২০-র ফেব্রুয়ারিতে দেশে বেকারত্বের হার ছিল ৭.৭৬ শতাংশ। সি এম আই ই (সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি)-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২-এর ফেব্রুয়ারিতে বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮.১ শতাংশ। শুধু এই তথ্য দিয়ে বেকারত্বের গভীরতা বোঝা যাবে না। আসল কথা হল কর্মক্ষম জনসংখ্যার মাত্র ৪৭ শতাংশ কিছু কাজ পায়। একটি সরকারি সমীক্ষা অনুসারে উত্তরপ্রদেশে ১৫-২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে কর্মহীনতা প্রায় ১৮ শতাংশ। এটা কম উদ্বেগজনক ঘটনা নয়। আবার যারা কর্মে নিযুক্ত তাদের মাত্র ১৫ শতাংশ নিয়মিত অর্থাৎ স্থায়ী চাকরিতে নিযুক্ত। বাকি ৮৫ শতাংশেরই কাজ অস্থায়ী প্রকৃতির– মানে আজ আছে, কাল নাও থাকতে পারে। আবার এদের মজুরিও অনেক কম, অবসরকালীন প্রাপ্তি কী, সবটাই অনিশ্চিত।
বেকারত্বের বারুদের উপর দেশটা দাঁড়িয়ে আছে। সরকারি চাকরির পরীক্ষার্থী লাফিয়ে বাড়ছে। কেন্দ্র রাজ্য সব সরকারই শূন্য পদ বিলোপ বা কমানোর নীতি নিয়ে চলছে। প্রশাসন চালাতে যে জনবল দরকার তা নেওয়া হচ্ছে মূলত চুক্তি ভিত্তিতে, ‘হায়ার অ্যান্ড ফায়ার’ নীতির ভিত্তিতে। কিন্তু এ ভাবে তো পেট চলে না। সেজন্য নিয়মিত রোজগার দরকার হয়। তার সংস্থান কোথায়?
প্রধানমন্ত্রীর এসব নিয়ে কোনও উদ্বেগ নেই, খেদোক্তি নেই। বরং রয়েছে ব্যর্থতাকে সাফল্য হিসাবে তুলে ধরার পরিসংখ্যানগত প্রয়াস। কখনও সরকার শ্রমশক্তি সম্পর্কিত রিপোর্ট চেপে দিচ্ছে, কখনও নতুন নতুন নিয়োগের বিচিত্র পরিসংখ্যান হাজির করছে। এতে গাণিতিকভাবে বেকার সমস্যার সমাধান দেখানো যেতে পারে, বিপুল কর্মসংস্থানের ঢাক বাজিয়ে ভোটে জয়লাভ করা যেতে পারে, কিন্তু বেকারত্ব দূর হয় না। মজার ব্যাপার হল, বেকার সমস্যা সমাধানের এই ভোজবাজিতে সিপিএম-বিজেপি-তৃণমূল সকলেই সমান।
কম্পিউটারের বোতাম টিপেই মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এ রাজ্যে ২২ লাখ বেকার কমিয়ে দিয়েছিলেন। নরেন্দ্র মোদী পকোড়া ভাজায় কর্মসংস্থান দেখিয়েছেন, মমতা ব্যানার্জী তো তেলেভাজাকেই বলে চলেছেন কর্মসংস্থান। বেকার সমস্যা চাপা দেওয়ার এ জাতীয় মডেল জনগণের কাছে হাস্যকর ঠেকলেও শাসক দলের নেতারা তাতে লজ্জা পান না।
এখন সংঘ হাজির করছে বেকার সমস্যা সমাধানের স্বদেশি মডেল বা ভারতীয় মডেল। সেটা কী? ‘৯০-এর দশক থেকে বিশ্বায়নের জাবর কেটে কেন্দ্রে মনমোহন থেকে অটলবিহারী, রাজ্যে জ্যোতি বসু থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য– সবাই বললেন, বিশ্বায়নের সুফল নিতে হবে। আর মোদিজি তো ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’-র উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে কয়েক ডজন দেশ ভ্রমণ করে বিশ্বরেকর্ড করে ফেললেন।
ফল কী হল? কোনও শিল্প এল? বাংলার কথা না হয় বাদই দেওয়া গেল, গুজরাটে, মহারাষ্টে্র কি তেমন শিল্প হল? কেন হল না? মিছিল, মিটিং, ঘেরাও, ধর্মঘটের মতো ‘অস্পৃশ্য’ হাতিয়ারগুলো ওই সব রাজ্যে কেন, বাংলাতেও প্রায় অদৃশ্য। তা হলে শিল্পের দেখা নেই কেন? এক সময় শিল্পপতিরা কর্মপ্রার্থীদের সরাসরি নিয়োগ করে ট্রেনিং দিয়ে কাজের উপযুক্ত করতেন। এখন তো সেটুকুও করতে হয় না। কর্মপ্রার্থীরা নিজেরাই নানা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে কোর্স করে যথেষ্ট দক্ষ। তা হলেও নিয়োগ হচ্ছে না কেন? এর উত্তর স্বাভাবিকভাবেই পুঁজিপতিরা দেন না, পুঁজিবাদী রাষ্টে্রর কর্ণধাররা কিংবা পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদরাও দেন না। এর সঠিক উত্তরটা সামনে এলে যে পুঁজিবাদী আর্থিক ব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাই চ্যালেঞ্জের সামনে পড়ে!
সংঘের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘‘অখিল ভারতীয় প্রতিনিধি সভা মনে করে একটি ভারতীয় অর্থনৈতিক মডেলের উপর জোর দেওয়া উচিত, যা হবে মানবকেন্দ্রিক, শ্রমনির্ভর, পরিবেশ-বান্ধব, বিকেন্দ্রীভূত। সেখানে সুবিধার সুষম বণ্টনের উপর জোর দিতে হবে।” প্রস্তাব দেখে মনে হবে সংঘ-অধিপতিরা বুঝি বা কার্ল মার্কসের অনুসারী হয়ে পড়েছেন। মার্কস পুঁজিবাদী অর্থনীতির বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, মুনাফাকে সর্বোচ্চ করতে পুঁজিপতিরা শ্রম নির্ভরতা কমিয়ে প্রযুক্তিনির্ভরতা বাড়ায়। মার্কসবাদ দেখিয়েছে, উৎপাদন খরচ কমাতে গিয়ে কীভাবে পরিবেশ রক্ষার দায় পুঁজিপতিরা পাশ কাটিয়ে যায়। সুবিধার সুষম বণ্টন, মানবকেন্দ্রিক অর্থনীতি অনুসরণ করলে পুঁজিবাদ আর পুঁজিবাদ থাকে না। আর উৎপাদনের বিকেন্দ্রীভবন? সেটা একচেটিয়া পুঁজিবাদের যুগে সোনার পাথরবাটি। সংঘ অধিপতিরা এ সব জানেন না এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। তা হলে তাঁরা এ কথা বলছেন কেন?
বলছেন একটি বিশেষ উদ্দেশ্য থেকে। কী সেটা? সত্য চেপে গিয়ে আরএসএস দেখাতে চাইছে যেন, নরেন্দ্র মোদিরা যে আর্থিক নীতি নিয়ে চলছেন, তা একচেটিয়া পুঁজির স্বার্থরক্ষার প্রয়োজন থেকেই নয়। যেন বিজেপি এক ভুল নীতি নিয়ে চলেছে আর সরকারকে আরএসএস সেই ভুল নীতি থেকে সঠিক নীতিতে নিয়ে আসতে চাইছে। যেন সেই নীতিতেই বেকার সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে!
কিন্তু সত্যিই কি তাই? পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আজ যে অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে, তাতে বিজেপি নেতারা যতই কর্মসংস্থানের ঢাক পেটান, তাদের আশ্বাসবাণী মুখ থুবড়ে পড়ছে। এই অবস্থায় অভিভাবক হিসাবে আসলে বিজেপিকে বাঁচাতেই আসরে নেমেছে আরএসএস। ভাবটা এমন, যেন তারা এ ব্যাপারে কত উদ্বিগ্ন! পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় আজ যে ব্যাপক কর্মসংস্থান সম্ভব নয়, আরএসএসের এই সমালোচনা দ্বারা সেই বাস্তব সত্যকে আড়াল করার চেষ্টা হল, আবার সরকার-বিরোধীদের মুখও বন্ধ করা গেল। সমালোচনা যখন ভেতর থেকেই হচ্ছে, তখন বিরোধীদের আর বলার কী-ই বা থাকতে পারে– এমন একটা বার্তা উপস্থিত করা গেল। পাশাপাশি, বিজেপি-র সমর্থকদের যে অংশটা বিশ্বায়নবিরোধী, ভারতীয় অর্থনৈতিক মডেলের সমর্থক, এই সমালোচনায় তাঁদেরও খানিকটা সন্তুষ্ট করা গেল।
বেকারত্বের যে বিস্ফোরক পরিস্থিতি দেশের মধ্যে বিদ্যমান, বিশ্বব্যাপী যে নিরবিচ্ছিন্ন মন্দা আজ শিল্পায়নের সামনে মূল বাধা, সত্যিই এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে গেলে, শিল্পায়নের জোয়ার আনতে হলে অর্থনীতিকে মুনাফার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করা প্রয়োজন। মুনাফার পরিবর্তে মানুষের সর্বাধিক পরিতৃপ্তি সাধনকেই উৎপাদনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য করা প্রয়োজন। কিন্তু তা হলে তো এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থাটিকেই ভাঙতে হয়। সংঘ নেতাদের সে সত্য স্বীকার করার সাহস নেই। তাই বিজেপি সরকারের ব্যর্থতা আড়াল করতে সমালোচকের ভেক ধরা ছাড়া তাদের উপায় কী?