বিজেপির বুলডোজার ‘রাজনৈতিক’ বলল সুপ্রিম কোর্টও

উত্তরপ্রদেশে মুখ্যমন্ত্রীর পরিচয় যখন হয় ‘বুলডোজার বাবা’, মধ্যপ্রদেশে সেই সময়ে মুখ্যমন্ত্রী খ্যাত হন ‘বুলডোজার মামা’ হিসাবে। দলীয় মুখ্যমন্ত্রীদের এই নামকরণে রীতিমতো শ্লাঘা বোধ করে থাকেন বিজেপি নেতারা। একেবারে ঢাকঢোল পিটিয়ে এই নাম প্রচারে তাঁরা ভোটের বাজারে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বিজেপি বিরোধী অথবা ধর্মে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত যে কারও বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ থাকলেই বুলডোজার পাঠিয়ে তার ঘরবাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়াকেই বিচারের একমাত্র রাস্তা বলে ঠাহর করেছে নানা রাজ্যের বিজেপি সরকার।

১৩ নভেম্বর এই বিষয়ে একটি মামলায় রায় দিতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, যখন অনেক বাড়ি বা কাঠামোর মধ্যে থেকে হঠাৎ করে একটিকে ভেঙে ফেলা হয়, অন্যগুলিকে রেয়াত করা হয়, তখন ধরে নেওয়া যেতে পারে যে এই কাজটি কোনও বেআইনি নির্মাণে বাধা দিতে নয়, বরং আইনের ঊর্ধ্বে উঠে কোনও ব্যক্তিবিশেষকে শাস্তি দেওয়ার জন্যই তা করা হয়েছে।

এনআরসি-র বিরুদ্ধে, চাকরির দাবিতে, কিংবা অন্য কোনও দাবিতে আন্দোলনে পুলিশের সাথে আন্দোলনকারীদের ধস্তাধস্তি হওয়ার পরে তাদের চিহ্নিত করে বাড়িতে বুলডোজার পাঠানোর বহু ঘটনা উত্তরপ্রদেশে আছে। কোনও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের বিরুদ্ধে কোনও ধরনের অভিযোগ ওঠা তো শুধু সময়ের অপেক্ষা– কিছুক্ষণের মধ্যে তার বাড়িতে পৌঁছে যাবে বুলডোজার। কোনও নোটিস ছাড়াই ভাঙা শুরু হয়ে যাবে বাড়ি। মধ্যপ্রদেশে গত বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক পরেই গোমাংস রাখার অভিযোগ তুলে একাধিক দলিত ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়ি ভেঙেছে বিজেপি সরকার। সে রাজ্যে যখন তখন বুলডোজার চালিয়ে বাড়ি ভাঙা সাধারণ ঘটনায় পর্যবসিত হয়েছে উত্তরপ্রদেশের মতোই। হারিয়ানার বিজেপি সরকারও পিছিয়ে নেই। এমনকি দিল্লিতে এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের পরেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়ি, দোকানকে বেআইনি তকমা দিয়ে ভেঙেছে বিজেপি পরিচালিত দিল্লি কর্পোরেশন এবং পুলিশ।

বাস্তবে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে বুলডোজার। উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যে সাধারণভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই খারাপ। নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, নারী পাচার, তোলাবাজি, বাহুবলী গুণ্ডাদের দাপট ইত্যাদির ফলে মানুষ তিতিবিরক্ত। বর্তমান শাসক বিজেপি তো বটেই সপা কিংবা কংগ্রেসের মতো কিছুদিন আগে গদি হারানো দলগুলিও উত্তরপ্রদেশে নানা সমাজবিরোধী গোষ্ঠীর মদতদাতা। এই সমাজবিরোধীদের অনেকেই আজ মূলত শাসক দল এমনকি অন্য দলেরও এমপি কিংবা এমএলএ হয়ে জাঁকিয়ে বসেছে। এই নিয়ে মানুষের তীব্র ক্ষোভকে চাপা দিতে বিজেপি সমস্ত সমাজবিরোধী কার্যকলাপের দায় চাপিয়ে দেয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর। এতে বিজেপি সরকারের অপদার্থতা ঢাকার অন্যতম হাতিয়ার উগ্র হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি চরিতার্থ করতে সুবিধা হয়। অসহায় সাধারণ মানুষকে ভুলিয়ে রাখতে এ দেশে শাসক বুর্জোয়া শ্রেণি অনেক দিন ধরেই তাদের ফ্যাসিবাদী পরিকল্পনায় ‘মহাশক্তিধর শাসক’ হিসাবে কোনও নেতাকে তুলে ধরার চেষ্টা করে। অতীতে কংগ্রেসের নেতাদের নিয়ে তারা এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছে, এখন বিজেপির নেতাদের এ ভাবেই তুলে ধরতে চাইছে শাসক শ্রেণি। সেই পরিকল্পনায় শাক্তিশালী শাসকের হাতিয়ার হিসাবে বুলডোজার বেশ মানিয়ে যায়। যার সাহায্যে এইবার একটা জবরদস্ত কিছু ঘটবে এই আশা দেখিয়ে মানুষকে চমকে দেওয়া যায়। এই পরিকল্পনার ভিত্তিতেই চরম বেআইনি জেনেও যথেচ্ছভাবে বুলডোজার চালানোকে হাতিয়ার করেছে বিজেপি সরকার। সুপ্রিম কোর্টের এই রায় রাজনৈতিক বুলডোজারে লাগাম টানবে কি না ভবিষ্যতই বলবে। তবে খুব বেশি আশা না করাই ভাল। কারণ এ দেশে আদালত অনেক মানবাধিকারের কথা বলে, কিন্তু জনজীবনে তার প্রভাব কতটুকু পড়বে তা নির্ভর করে শাসকদের ইচ্ছার ওপর। ফলে এই রায়েরও কতটুকু সরকার মানবে, নাকি ইচ্ছামতো তাকে পায়ে দলবে, তা সময়ই বলবে।

সুপ্রিম কোর্ট রায় দিতে গিয়ে বলেছে, কোনও প্রশাসনিক আধিকারিক বিচারের দায়িত্ব তুলে নিতে পারে না। বিজেপি পরিচালিত বিভিন্ন রাজ্য সরকারের প্রশাসনিক আধিকারিকদের আইন হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা এতদূর বেড়েছে যে সুপ্রিম কোর্টও তা না বলে পারছে না। আজকের ভারতে ঠিক এই কথাটাই ভুলিয়ে দিতে তৎপর ক্ষমতাসীন সরকারি দলগুলি। বুলডোজার চালিয়ে বাড়ি ভাঙা ছাড়াও অভিযোগ ওঠামাত্র ভুয়ো এনকাউন্টারে হত্যা আজ রাজ্যে রাজ্যে পুলিশের ‘আইন রক্ষার’ হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এ ব্যাপারে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলো সবচেয়ে এগিয়ে থাকলেও কোনও রাজ্য সরকারই পিছিয়ে থাকতে চাইছে না। এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও সাম্প্রতিক সময়ে আর জি কর ঘটনার পর অভিযুক্তকে এনকাউন্টারে নিকেশ করার নিদান দিয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা দ্বিতীয় সুপ্রিমো। বিচারহীনতা আজ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, সাধারণ মানুষের মধ্যে এই ধারণা ক্রমাগত দৃঢ় হচ্ছে যে, বিচার যখন হবেই না, তখন এনকাউন্টারই একমাত্র ভরসা। এক সময় বুর্জোয়া শাসকরাই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় শাসন এবং বিচারবিভাগের মধ্যে ক্ষমতার বিভাজনের কথা বলেছিল। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর এটা ছিল অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এখন যত দিন যাচ্ছে, যত অর্থনৈতিক কেন্দ্রীকরণ ঘটছে, মনোপলি শক্তিশালী হচ্ছে, তত বুর্জোয়া ব্যবস্থার গায়ে ফ্যাসিবাদের লক্ষণ ক্রমাগত বেশি বেশি করে ফুটে বেরচ্ছে। প্রশাসনের হাতেই সর্বময় ক্ষমতা ক্রমাগত কেন্দ্রীভূত করার চেষ্টা হচ্ছে। বিচারবিভাগের স্বাধীনতা বিপন্ন তো বটেই, এমনকি সংসদের কার্যকারিতাও কার্যত শূন্যে পরিণত হচ্ছে। পুলিশ এবং আমলারাই শাসক দলের ইচ্ছায় যা খুশি করার, যে কোনও মানুষকে দোষী সাব্যস্ত করার অধিকারী হয়ে উঠছে। তারই ফল যেমন বিজেপি রাজ্যে বুলডোজার এবং প্রায় সর্বত্র এনকাউন্টারের বাড়বৃদ্ধি।

আশঙ্কার বিষয় হল শক্ত হাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে এই স্বৈরাচার যদি জনমানসেও প্রশ্রয় পেতে থাকে তাহলে তা যে কোনও মানুষের ওপরই প্রযুক্ত হতে পারে। এর ফলে ন্যায় বিচার দূরে থাক, বিচার কথাটাই পুরোপুরি প্রহসনে পরিণত হবে। মানবাধিকার, অভিযুক্তের বক্তব্য খোলা মনে শোনার ব্যবস্থা রাখা এগুলি কোনও সমাজের উচ্চকোটিতে থাকা বুদ্ধিজীবীর সাজানো ধারণা নয়, আইনের ন্যূনতম শাসন এগুলি ছাড়া থাকতে পারে না। বিজেপি সরকারের রাজনৈতিক বুলডোজারের গতি শুধু আদালত থামাতে পারবে না, ন্যায়বিচারের দাবিতে নাগরিক সমাজের সচেতনতা ও সক্রিয় আন্দোলন এর অন্যতম গ্যারান্টি।