বুলডোজারই কি এখন আইনের প্রতীকে পরিণত হবে বিজেপি শাসিত ভারতে?
প্রশ্নটা তুলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের বেশ কয়েকজন প্রাক্তন বিচারপতি সহ আইন ও বিচারব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত ১২ জন বিশিষ্ট মানুষ। ভারতের প্রধান বিচারপতির কাছে চিঠি লিখে তাঁরা আর্জি জানিয়েছেন, বিজেপির দুই মুখপাত্রের জঘন্য মন্তব্যকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ মোকাবিলার নামে বিজেপি সরকার যা করেছে তা ‘মুসলিম ধর্মাবলম্বী নাগরিকদের উপর রাষ্ট্রের কর্ণধারদের হিংস্র নিপীড়ন ছাড়া কিছু নয়।’ ১৪ জুন পাঠানো এই চিঠিতে সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি বি সুদর্শন রেড্ডি, ভি গোপাল গৌড়, এ কে গাঙ্গুলীর সাথে সই করেছেন দিল্লি হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ও ল কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান এ পি শাহ, মাদ্রাজ ও কর্ণাটক হাইকোর্টের দুই প্রাক্তন বিচারপতি এবং প্রাক্তন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী শান্তিভূষণ সহ ৬ জন খ্যাতনামা আইনজীবী। তাঁরা লিখেছেন, এই মন্তব্যের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখানোর জন্য বিক্ষোভকারীদের বাড়ি বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়া ‘আইনের শাসনকে পুরোপুরি ধ্বংস করার মতো কাজ, যা কখনওই মেনে নেওয়া যায় না।’
বিজেপির দুই জাতীয় মুখপাত্র ইসলাম ধর্মকে জড়িয়ে যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং ক্ষমার অযোগ্য অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন সরকার তার বিরুদ্ধে কোনও আইনি পদক্ষেপ করেনি। আন্তর্জাতিক মহলে এ নিয়ে তীব্র সমালোচনার পর বিজেপি দল থেকে তাদের সাময়িক লোক দেখানো সাসপেন্ড করেছে মাত্র। এই জঘন্য মন্তব্যকে সারা ভারতেই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ধিক্কার জানিয়েছেন। বিক্ষুব্ধ এবং আহত মন নিয়ে বহু মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন। আবার তাঁদের মধ্যে জমে থাকা স্বাভাবিক ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল বিক্ষোভের নামে কিছু অনভিপ্রেত আচরণে মদত দিয়েছে, যা আসলে বিজেপি-সংঘ পরিবারের হিন্দু এবং ইসলামিক উভয় মৌলবাদকে উস্কানি দেওয়ার হীন পরিকল্পনার অঙ্গ হিসাবেই করা হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে যে কোনও সভ্য দেশের শাসকের কাজ কী ছিল? সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে জমা ক্ষোভ, নিরাপত্তাহীনতা ও আতঙ্ক বোধকে দূর করে বিক্ষোভ প্রশমনের জন্য তাঁদের আশ্বস্ত করা দরকার ছিল যে সরকার কোনওভাবেই এই ধরনের মন্তব্য সহ্য করবে না। দেশের সকল নাগরিকের ধর্মবিশ্বাস, রীতি, সংস্কৃতি ঐতিহ্য নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচার অধিকার যাতে খর্ব না হয় সরকার সে ব্যাপারে সক্রিয় থাকবে এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান মর্যাদা ও অধিকারকে নিশ্চিত করবে। কিন্তু কী করল সরকার? উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এলাহাবাদে এবং সাহারানপুরে বিক্ষোভকারীদের বাড়িতে বুলডোজার পাঠিয়ে দিয়েছেন। একটা নামকা-ওয়াস্তে নোটিশ দরজায় লটকে দিয়েই বুলডোজার চালিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে জাভেদ আহমেদ সহ একাধিক বিক্ষোভকারীর বাড়ি-সম্পত্তি। শুধু এখানেই থামেনি উত্তরপ্রদেশ সরকার–একাধিক জেলা প্রশাসন বড় বড় ব্যানার এবং হোর্ডিংয়ে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মুখের ছবি দিয়ে ‘সন্ধান চাই’-এর কায়দায় টাঙিয়ে দিয়েছে। তাদের অপরাধী এবং সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর ব্যক্তি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সরকারি আমলা, শাসকদলের নেতা আর পুলিশই ঠিক করে দিচ্ছে কারা অপরাধী এবং ক্ষতিকর! আইন, বিচারব্যবস্থা এ সবের যেন কোনও অস্তিত্বই নেই!
প্রাক্তন বিচারপতি এবং বিশিষ্ট আইনজীবীরা চিঠিতে লিখেছেন, পুলিশ এবং স্থানীয় উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ঐক্যবদ্ধ এই অভিযান থেকে এই সিদ্ধান্তই টানা যায়– বিচার বহির্ভূত শাস্তিদানের উদ্দেশ্যেই এই কাজ করা হয়েছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে আতঙ্কগ্রস্ত করতে মুসলিম যুবকদের উপর পুলিশের অত্যাচারের় দৃশ্য, তাদের বাড়ি ভাঙার দৃশ্য, পুলিশের তাড়ায় তাদের ছুটে পালানো ইত্যাদি যে কায়দায় সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়ানো হয়েছে তা বিবেকবান মানুষকে ধাক্কা দিয়েছে বলে এই চিঠিতে লিখেছেন বিশিষ্ট আইনজ্ঞরা। তাঁরা সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন জানিয়েছেন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিক শীর্ষ আদালত। ১৬ জুন এই প্রসঙ্গে একটি মামলায় শীর্ষ আদালত উত্তরপ্রদেশ সরকারকে বলেছে, প্রতিহিংসার বশে কারও বাড়ি ভাঙা যায় না। সরকারকে আইন মেনে চলার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে আদালত। যদিও আদালত কোনও স্থগিতাদেশ দেয়নি।
আদালতে উত্তরপ্রদেশ সরকারের আইনজীবী হিসাবে দাঁড়িয়েছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের অ্যাডভোকেট জেনারেল। তিনি বলেছেন বিক্ষোভের সাথে বাড়ি ভাঙার কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু সত্যটা ফাঁস করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের রাজনৈতিক উপদেষ্টা মৃত্যুঞ্জয় নিজেই। তিনি ১০ তারিখেই বুলডোজারের সাহায্যে বাড়ি ভাঙার ছবি দিয়ে টুইটারে লিখেছেন, ‘বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীরা যেন মনে রাখে প্রতিটি শুক্রবারের পর একটা শনিবার আসে’। এখন ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যে বুলডোজার পরিণত হয়েছে আইনের প্রতীকে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কারও বিরুদ্ধে শুধু কোনও অভিযোগ থাকলেই বুলডোজার পাঠিয়ে তাদের বাড়ি ভেঙে দেওয়া হচ্ছে তাই নয়– শাসকদলের নেতারা জনসভায় দাঁড়িয়ে তা নিজেদের অন্যতম কৃতিত্ব হিসাবে তুলেও ধরছেন। যেমন বিনাবিচারে এনকাউন্টার করে অভিযুক্তদের সরাসরি হত্যা করাটাও বিজেপি শাসনের বিশেষ গর্বের বিষয় হয়ে উঠছে। ‘অভিযুক্ত’ আর ‘অপরাধী’ এই দুটি শব্দের আলাদা মানে যেন অভিধান থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ কিংবা সরকার অথবা যে কেউ কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলেই যে তাকে অপরাধী বলা যায় না, অপরাধ আদালতগ্রাহ্য বিচারপ্রক্রিয়ায় সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণ করতে হয়, এই সত্যটাই আজ বিলুপ্ত হচ্ছে।
কয়েক মাস আগেই উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের সময় খোদ প্রধানমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী উত্তরপ্রদেশের একাধিক জনসভায় এই বুলডোজার নীতির জন্য যোগী আদিত্যনাথের প্রশংসা করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর দ্বারা উৎসাহিত হয়ে রাজ্যে রাজ্যে বিজেপি নেতারা বুলজোডার রাজনীতির ভক্ত হয়ে পড়েছেন। যোগী আদিত্যনাথ সব নির্বাচনী জনসভায় তাঁর বুলডোজার কৃতিত্ব নিয়ে সরব হয়েছেন। উত্তরপ্রদেশে মুখ্যমন্ত্রীকে ‘বুলডোজার বাবা’ হিসাবে তুলে ধরে প্রচার করেছে বিজেপি। এই নব্য ‘বাবা’-র নামে গানও বাঁধা হয়েছে। মধ্যপ্রদেশে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহানের নামে বিজেপি নেতারা জয়ধ্বনী দেন ‘বুলডোজার মামা জিন্দাবাদ’। মধ্যপ্রদেশের এক বিজেপি এমএলএ নিজের বাড়ির সামনে প্রচুর বুলডোজার সাজিয়ে রেখে মুসলিমদের নারী নির্যাতনকারী হিসাবে দেখিয়ে তাদের শায়েস্তা করার স্লোগানও লিখে রেখেছেন। মাত্র কিছুদিন আগেই রামনবমীর মিছিলের নামে অস্ত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে বিজেপি দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরী, মধ্যপ্রদেশের একাধিক শহরে এবং উত্তরপ্রদেশে দাঙ্গা বাধানোর চেষ্টা করেছিল। সেখানে অশান্তি হওয়া মাত্র সব কিছুর জন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে দায়ী করে বুলডোজার দিয়ে তাদের বাড়ি-ঘর় গুঁড়িয়়ে দেওয়া হয়েছে। দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরীতে প্রতিবাদ হওয়ায় সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়, বুলডোজারের গতি রোধ হয়। পরে সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল দিল্লির শাহিনবাগেও বুলডোজার দিয়ে বাড়ি ভাঙা হয়েছে। সব ক্ষেত্রেই প্রতিবাদ হওয়ার পর সরকার বলেছে প্রতিহিংসা নয়, তারা বেআইনি নির্মাণ ভাঙতে গিয়েছিল মাত্র। অদ্ভূতভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই বেআইনি নির্মাণের কথাটা সরকারের মনে পড়েছে বিজেপি সংঘপরিবারের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কোনও প্রতিবাদ ধ্বনিত হওয়ার পরেই!
যদি সরকারের বেআইনি নির্মাণ ভাঙার যুক্তিটাকে তর্কের খাতিরেও সঠিক বলে ধরা যায়, তা হলেও প্রশ্ন থাকে– সরকার যথেচ্ছভাবে কারও বাসস্থান ভাঙতে পারে? ১৯৮৫-তে মুম্বাইয়ে ফুটপাতবাসীদের ঝুপড়ি উচ্ছেদের প্রশ্নে ‘ওলগা তেলিস বনাম বম্বে মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন’ মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় ছিল যথাযথ নোটিস, পর্যাপ্ত সময় এবং সঠিক পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ছাড়া বেআইনি বলে কোনও বাসস্থান, এমনকি তা ফুটপাথবাসীদের ঝুপড়ি হলেও, ভাঙা যায় না। ২০১০-এ দিল্লি হাইকোর্ট ‘সুদামা সিং’ মামলায় সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন তৈরি করে দিয়ে বলেছিল, কোনও নাগরিকের জীবন, জীবিকা এবং মানুষ হিসাবে মর্যাদা রক্ষা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আইনের নামে কোনও সরকার তা লঙ্ঘন করতে পারে না। তাই কোনও বাসস্থান, জীবিকার স্থান ভাঙতে গেলে সরকারকে যথাযথ নোটিস শুধু নয় সঠিক পুনর্বাসনের পূর্ণ দায়িত্ব নিতে হবে।
জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলি সমাধানে বিজেপি সরকারের চরম ব্যর্থতা আড়াল করতে এখন বিজেপির একমাত্র হাতিয়ার খোলাখুলি সাম্প্রদায়িক বিভাজন ঘটিয়ে খেটে-খাওয়া মানুষকে নিজেদের মধ্যে লড়িয়ে দেওয়া, যাতে সরকারের দিকে তারা আঙুল না তোলে। সে জন্যই মুসলিম মাত্রেই অপরাধী এই জিগির তুলে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, আসাম, কর্ণাটক, বিহার সহ নানা রাজ্যে বিজেপি নিজেদের শক্তি দেখাতে বুলডোজারকে হাতিয়ার করেছে। বুলডোজার এখন সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার একটি হাতিয়ারে পরিণত। এই বুলডোজারের বিজেপি সরকার গুঁড়িয়ে দিচ্ছে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষার টিকে থাকা অবশিষ্টাংশকে। এক্ষেত্রে বিশেষভাবে লক্ষ করা দরকার, আদালত রায় দিলেও তা কার্যকর করার জন্য সরকারকে বাধ্য করেনি। যেখানে গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ এগিয়ে এসে প্রতিবাদ করেছেন, আন্দোলন হয়েছে সেখানেই আদালত কিছুটা ভূমিকা নিয়েছে। তাই আদালতের মুখের দিকে তাকিয়ে না থেকে গণতন্ত্র রক্ষায় গণতন্ত্রপ্রিয় এবং বামমনস্ক মানুষকে ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলনের পথে যেতে হবে। সেটাই বিজেপির মুখোশ খোলার একমাত্র রাস্তা।