সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির বিপুল জয় সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)–এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ ২৭ মে নিচের বিবৃতি দেন৷
নগ্নভাবে বুর্জোয়া শ্রেণির স্বার্থ রক্ষায় কেন্দ্রের বিজেপি সরকার কর্তৃক গৃহীত একের পর এক চূড়ান্ত জনবিরোধী নীতিতে বিপর্যস্ত দেশের মেহনতি জনগণ ভোট–পূর্ববর্তী সময়ে ক্রোধে ফুঁসছিল এবং এই শ্বাসরোধকারী পরিস্থিতি থেকে মুক্তি চাইছিল৷ কিন্তু জনজীবনে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী এই নীতিগুলিকে নির্বাচনী প্রচারপর্বে অত্যন্ত চাতুর্যের সাথে পিছনে ঠেলে দেওয়া হল৷ এ শুধু আরএসএস–বিজেপি করল তাই নয়, অন্যান্য ভোটসর্বস্ব বুর্জোয়া দলগুলি তো বটেই, এমনকী সিপিএম–সিপিআইয়ের নির্বাচনী প্রচারেও এগুলি গুরুত্ব পেল না৷ উল্টে কিছু তৈরি করা ইস্যু অত্যন্ত ধূর্ততার সাথে সামনে নিয়ে আসা হল জনগণের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য৷ ধর্মীয় উগ্রতা, জাতিদম্ভ, যুদ্ধ–উত্তেজনা, সাম্প্রদায়িক জাতপাতগত মেরুকরণ প্রভৃতিতে জোরালো ভাবে মদত দেওয়া হল৷ শাসক বুর্জোয়া শ্রেণির আশীর্বাদধন্য হয়ে অর্থবল–পেশিবল–প্রচারমাধ্যম ও প্রশাসনিক ক্ষমতাকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করে অত্যন্ত ধূর্ততার সাথে নির্বাচনী ফলাফলকে কারচুপির দ্বারা বিজেপির পক্ষে নিয়ে আসা হল, যা সম্পূর্ণই জনগণের ইচ্ছা ও স্বার্থের বিরোধী৷ নানা সময়ে আমরা একাধিকবার বলে এসেছি যে, আজকের দিনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কণামাত্র নেই৷ তাকে সম্পূর্ণ ভাবেই প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে৷ এবারের লোকসভা নির্বাচনে যেভাবে আরএসএস–বিজেপি জঘন্য ধরনের ষড়যন্ত্র, প্রতারণা, অসততা এবং ভণ্ডামিকে আশ্রয় করল, তা আমাদের উপরোক্ত বক্তব্যকে সন্দেহাতীত সত্য বলে প্রমাণ করেছে৷ অন্য আরেকটি প্রাসঙ্গিক লক্ষণীয় বিষয় হল, সমস্ত রকমের গণতান্ত্রিক ন্যায়নীতিকে লংঘন করে নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ থাকার ভান দেখিয়ে বাস্তবে শাসক বিজেপির নির্বাচনী স্বার্থরক্ষায় বেপরোয়া ভূমিকা নিয়েছে৷
মার্কসবাদ–লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারায় পরিচালিত আমাদের দল বরাবর বলে আসছে, চরম সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট রাজনীতিকে এবং আরএসএস–বিজেপির আক্রমণকে প্রতিহত করার জন্য যে জরুরি কাজটি করা দরকার, তা হল জনগণের জীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলিকে নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ বাম–গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলা৷ আমরা আরও বলেছি, এই ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পরিবেশ এমন একটা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল সৃষ্টি করবে যা ধর্মের ভিত্তিতে ও অন্যান্য নীচ উপায়ে জনগণকে বিভক্ত করার আরএসএস–বিজেপির ষড়যন্ত্রকে বিফল করে দিতে পারে৷
দেশের মধ্যে বাস্তবেও একটার পর একটা স্বতঃস্ফূর্ত কৃষক বিক্ষোভ, শ্রমিক, নারী ও ছাত্রদের বিক্ষোভ চলছিলই, যা সংগঠিত বাম–গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলার সুযোগ দিয়েছিল৷ আমরা সিপিআই(এম), সিপিআই ও তাদের সহযোগী দলগুলিকে বার বার এই মর্মে আহ্বান জানিয়েছি, তারা যাতে বুর্জোয়া সংসদীয় রাজনীতিতে আটকে থাকার লাইন পরিত্যাগ করে এই ধরনের ঐক্যবদ্ধ গণসংগ্রাম গড়ে তুলতে এগিয়ে আসে৷ কিন্তু তারা আমাদের কথায় কর্ণপাত করেনি৷ সিপিআই(এম) এবং সিপিআই আমাদের আবেদনে কোনও সাড়া দেয়নি এবং পরিবর্তে পার্লামেন্টে কিছু সিট পাওয়ার জন্য বুর্জোয়া বিরোধী দলগুলিকে তো বটেই এমনকী কোথাও কোথাও সংকীর্ণতাবাদী আঞ্চলিক বুর্জোয়া দলগুলিকেও ‘সেকুলার’ ও ‘গণতান্ত্রিক’ তকমা দিয়ে তাদের সাথে নানা ধরনের নীতিহীন সুবিধাবাদী আঁতাত ও বোঝাপড়ায় যোগ দিয়েছে৷ এর ফলেই শাসক বুর্জোয়া শ্রেণি তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত রাজনৈতিক ম্যানেজার বিজেপিকে আবার কেন্দ্রীয় সরকারের গদিতে বসাতে সফল হয়েছে৷ লক্ষনীয় হল, এই পরিস্থিতিতে সমস্ত প্রতিকূলতা এবং বিপদের মোকাবিলা করে আমাদের দল নির্বাচনী সংগ্রামে মার্কসবাদ–লেনিনবাদ-শিবদাস ঘোষের চিন্তাধারা এবং সংগ্রামী বামপন্থার ঝান্ডাকে তুলে ধরেছে৷ সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আমাদের এই ভূমিকাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন৷
জনস্বার্থের নিরিখে এই নির্বাচনী ফল বিপর্যয়কর হলেও এতে মনোবল হারাবার কিছু নেই৷ সংসদীয় নির্বাচনের এই ফলাফলের সামনে মানুষের কর্তব্য হচ্ছে, পরিস্থিতিকে বুঝে উঠে দাঁড়ানো এবং শোষক শ্রেণি এবং বিজেপি সরকারের প্রতিটি ভয়ঙ্কর নির্মম আক্রমণকে প্রতিহত করার শপথ নেওয়া৷ আরএসএস–বিজেপির এই চূড়ান্ত জনবিরোধী সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী কার্যকলাপ প্রতিহত করা সম্ভব শক্তিশালী শ্রেণিসংগ্রাম ও গণসংগ্রামের ঢেউ তুলে যাকে অবশ্যই সংগ্রামী বামপন্থার মূল রাজনৈতিক লাইনের ভিত্তিতে এবং উন্নত নীতি–নৈতিকতা ও সংস্কৃতির আধারে৷ দেশের জনসাধারণ এবং বামপন্থী দলগুলির সৎ, বিবেকবান কর্মীদের কাছে আমাদের আন্তরিক আবেদন, জনজীবনের ন্যায়সঙ্গত দাবি নিয়ে দেশ জুড়ে একটার পর একটা গণআন্দোলনের ঢেউ তুলতে আমাদের এই উদ্যোগে সামিল হোন৷
সর্বহারার মহান নেতা কমরেড শিবদাস ঘোষ প্রতিষ্ঠিত এবং তাঁর চিন্তায় পরিচালিত আমাদের দল এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) শক্তিশালী শ্রেণিসংগ্রাম এবং গণসংগ্রাম গড়ে তোলার জন্য বরাবরের মতো এখনও দায়বদ্ধ৷