গোটা দেশের মানুষকে স্তম্ভিত করে দিয়ে মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসেকে ‘দেশভক্ত’ বলার স্পর্ধা দেখিয়েছেন সাধ্বী প্রজ্ঞা তথা প্রজ্ঞা ঠাকুর, যিনি মালেগাঁও বিস্ফোরণ কাণ্ডে অভিযুক্ত৷ এ হেন উগ্র হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসের নায়িকাকেই লোকসভা ভোটে ভোপাল কেন্দ্রে প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে বিজেপি কিন্তু ভোটের মুখে দলের নেত্রীর এমন মন্তব্য যে সর্বনাশা তাই দেশের মানুষের সোচ্চার প্রতিবাদের সামনে পড়ে প্রজ্ঞাকে দিয়ে ক্ষমা চাইয়ে নিয়েছে বিজেপি৷
কিন্তু নরেন্দ্র মোদি নাকি এতবড় অপরাধ এত সহজে নস্যাৎ করে দিতে রাজি নন৷ তিনি জানিয়েছেন, কিছুতেই প্রজ্ঞাকে তিনি ক্ষমা করতে পারবেন না৷ ক্ষমা না করে কী করেছেন তিনি? লোকসভা ভোটে প্রজ্ঞার প্রার্থীপদ বাতিল করেছেন? না, তিনি এসব কিছুই করেননি৷ তাহলে কি গান্ধীজির হত্যাকারীর এ হেন ভক্তকে ভোট না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন জনগণের কাছে? না, তা–ও তাঁকে করতে দেখা যায়নি এমনকী প্রজ্ঞাকে দল থেকে সাসপেন্ড করার সুপারিশও করেননি তিনি তাহলে কী ব্যবস্থা হয়েছে প্রজ্ঞার? না, বিজেপির শৃঙখলা রক্ষা কমিটিকে বিষয়টি খতিয়ে দেখে দশ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে৷ নরেন্দ্র মোদিরা ভালই জানেন, ততদিনে ভোটের ফল বেরনো, নতুন সরকার গঠন ইত্যাদি এসে যাওয়ায় মানুষের মন থেকে এই ঘটনা মুছে যাবে৷
সোজা কথায়, প্রজ্ঞার মন্তব্যকে ঘিরে নরেন্দ্র মোদির আরও একটি নাটক দেখার সুযোগ মিলল দেশবাসীর৷ বিজেপি নেতাদের নাথুরাম গডসের প্রশংসা করার ঘটনা কি এই প্রথম ঘটল? এর আগে বার বার নরেন্দ্র মোদির দলের নেতারা নানা প্রসঙ্গে নাথুরামের কুকীর্তিকে সমর্থন করেছেন৷ ২০১৫–তে বিজেপি নেতা অমিত মালব্য টুইট করে গান্ধী হত্যার পিছনে নাথুরামের যুক্তিকে সমর্থন করেছিলেন৷ এবারেও প্রজ্ঞা ঠাকুরের মন্তব্যের পরে পরেই একের পর এক বিজেপি নেতা নাথুরামের প্রশস্তি গেয়েছেন৷ প্রজ্ঞার ‘দেশভক্ত’ মন্তব্যকে সমর্থন করে বিজেপি মন্ত্রী অনন্তকুমার হেগড়ে টুইটে লিখেছেন, ‘৭০ বছর পরে অবশেষে দেশবাসী গডসের সঠিক মূল্যায়ন করেছেন৷ এ জন্য আমি আনন্দিত৷’ বিজেপি এমপি নলিনকুমার কাটিলও টুইট করে গডসেকে উঁচুতে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন৷ বিজেপির আর এক নেতা অনিল সৌমিত্রও প্রজ্ঞার সমর্থনে সোচ্চার হয়েছেন৷ এঁদের মধ্যে প্রথম দু’জনকে প্রজ্ঞার মতো করেই ছাড় দিয়ে দিয়েছে বিজেপি, সম্ভবত তাঁদের পদের গুরুত্ব বিবেচনা করে৷ দেশের মানুষের সামনে নিজেদের মুখ রক্ষা করতে একমাত্র অনিল সৌমিত্রকে সাসপেন্ড করেছে দল৷ শুধু এই ঘটনাই নয়, গত কয়েক বছর ধরে উত্তর ভারতের নানা এলাকায় একের পর এক গডসের মন্দির তৈরি করেছে বা তৈরির পরিকল্পনা করেছে সংঘ পরিবারের ঘনিষ্ঠরা৷ নরেন্দ্র মোদিকে কিন্তু সেসব আটকাতে বা তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে দেখা যায়নি তাহলে আজ হঠাৎ এমন গান্ধীভক্ত সেজে প্রজ্ঞা ঠাকুরের উপর খড়গহস্ত হওয়ার ভান কেন? আসলে ভোট বড় বালাই৷ তাই গান্ধী হত্যাকারীর পাশে দাঁড়িয়ে দেশের মানুষের ঘৃণার মুখোমুখি হতে চাননি নরেন্দ্র মোদি৷ তাহলে ভোট মিলবে না৷ অথচ আদর্শগত ভাবে মোদিদের উগ্র হিন্দুত্ববাদী দর্শনের সঙ্গে গডসের চিন্তাধারার ফারাক নেই৷ তাই আপাতত তা এড়িয়ে গিয়ে মানুষকে ভুল বোঝাতে চেয়েছেন মোদিরা৷ সেই কারণেই বহুল প্রচারিত ‘স্বচ্ছ ভারত অভিযান’–এর বিজ্ঞাপনে নরেন্দ্র মোদিকে ব্যবহার করতে হয়েছে গান্ধীজির অতি পরিচিত চশমার ছবি৷ গান্ধীজির অনুকরণে চরকার সামনেও হাঁটু গেড়ে বসে সাংবাদিকদের দিয়ে ছবি তুলিয়েছেন মোদি৷ কিন্তু এ সব যে নেহাতই ঠগবাজি, তা বুঝতে সময় লাগেনি মানুষের৷
এর আগেও নাথুরাম গডসের থেকে দলের দূরত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা করতে দেখা গেছে বিজেপি নেতাদের৷ এল কে আদবানি তাঁর স্মৃতিকথা ‘মাই কান্ট্রি, মাই লাইফ’–এ প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে আরএসএস–এর সঙ্গে গডসে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন৷ তাঁর এই বক্তব্য সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন নাথুরামের ভাই গোপাল গডসে, যিনি ছিলেন গান্ধীহত্যা মামলার অপর অভিযুক্ত৷ দি ইকনমিক টাইমস পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৯৪ সালে এক সাক্ষাৎকারে গোপাল বলেছিলেন, নাথুরাম, দত্তাত্রেয় এবং গোপাল গডসে– তিন ভাই–ই আরএসএস–এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং কোনও দিনই তাঁরা সংগঠন ছেড়ে চলে যাননি৷ গোপালের দৌহিত্র সাত্যকির বক্তব্য উদ্ধৃত করেছে রিপোর্টটি যেখানে তিনি বলেছেন, ‘‘১৯৩২ সালে সাংলিতে থাকার সময় নাথুরাম আরএসএস–এ যোগ দিয়েছিলেন৷ আমরণ তিনি সংগঠনের বৌদ্ধিক কার্যবাহ ছিলেন৷ তাঁকে দল কখনও বহিষ্কার করেনি, তিনিও কখনও দল ত্যাগ করেননি …৷’’ এই সাত্যকির মা, গোপাল গডসের কন্যা হিমানি সাভারকর ‘অভিনব ভারত’ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, যেটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সাভারকর ১৯০৪ সালে৷ লক্ষণীয়, যে মালেগাঁও বিস্ফোরণের সঙ্গে প্রজ্ঞা ঠাকুরের নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে, তার পিছনেও ছিল ‘অভিনব ভারত’ সংগঠনটির হাত৷
মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকাণ্ড ভারতের ইতিহাসে চরম লজ্জাজনক ও দুঃখজনক ঘটনা৷ গোটা দেশের মানুষের কাছে, এমনকী আদর্শগত ভাবে যাঁরা গান্ধীবাদ বিরোধী, তাঁদের কাছেও নাথুরাম গডসে একজন ঘৃণিত মানুষ৷ ফলে দেশের মানুষের কাছে নিজেদের জায়গা ধরে রাখতে, গডসের হিন্দুত্ববাদী ভাবাদর্শের সঙ্গে যত ঘনিষ্ঠতাই থাক, বিজেপি কোনও দিনই তা জোর গলায় বলার সৎ সাহস দেখাতে পারেনি৷ সেখানেও দেশবাসীর সঙ্গে আগাগোড়াই প্রতারণা করে গেছেন নেতারা৷ এবার প্রজ্ঞার ঘটনায় সেই ঠগবাজির আলখাল্লাটাই আবার গায়ে চাপালেন নরেন্দ্র মোদি৷