নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশ কিছু পণ্যে জিএসটির হার ১৮ শতাংশেরও নিচে নামিয়ে আনল বিজেপি সরকার৷ ১ জানুয়ারি থেকে তা কার্যকর হবে বলে জানা গেছে৷ যদিও সাধারণ মানুষের নিত্যব্যবহার্য জিনিস এর মধ্যে কমই আছে৷ ২৮ শতাংশ পর্যন্ত চড়া জিএসটি চালু করে সরকার বলেছিল, এবার জিনিসপত্রের দাম কমে যাবে৷ ব্যবসা বাণিজ্যের সুবিধা হবে, ফলে বাজার সংকট কাটবে৷ এখন আবার তাঁরা বলছেন জিএসটি কমালে জিনিসপত্রের দাম কমবে৷ জিএসটি চালু করতেই যদি জিনিসপত্রের দাম কমে যায়, তাহলে জিএসটি কমিয়ে দাম কমানোর প্রতিশ্রুতি দিতে হচ্ছে কেন বিজেপি সরকারকে? তাহলে কোন কথাটা তাঁদের সত্যি– আগেরটা না এখনকারটা?
নোট বাতিল -জিএসটি |
জিএসটির দেড় বছরের মাথায় এখন সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা কী? ঘাড়ে মূল্যবৃদ্ধির বিরাট বাড়তি বোঝা৷ ওষুধ, দুধ, আটা, ভোজ্য তেল, খাদ্যশস্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য জিনিসের উপর চড়া জিএসটি ধার্য হওয়ায় দাম বেড়েছে অনেক৷ পোশাক–আসাকেও জিএসটি বাবদ দিতে হচ্ছে বাড়তি টাকা৷ ব্যাঙ্ক বা কোনও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে পরিষেবা নিতে গেলেই গ্রাহকদের জিএসটি বাবদ বেশি অর্থ গচ্চা দিতে হচ্ছে৷ বেড়েছে এটিএম ব্যবহারের খরচ, ক্ষুদ্র ঋণ সহ সব ধরনের ব্যাঙ্কঋণের প্রসেসিং চার্জ৷ জীবনবিমার প্রিমিয়াম বেড়েছে৷ পরিবহণে বহু ক্ষেত্রে ২৮ শতাংশ পর্যন্ত জিএসটি দিতে হচ্ছে৷ বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জিএসটি ভারতে৷ ফলে অন্যান্য খরচের পাশাপাশি পণ্য ও যাত্রী পরিবহণের খরচও বেড়ে গেছে৷ সরকার বলেছিল, পণ্য বিক্রি ও পরিষেবার জন্য কেন্দ্রীয় বিক্রয় কর, ভ্যাট, পরিষেবা কর ইত্যাদি নানা নামের করের বদলে শুধুমাত্র একটি সরল কর জিএসটি দিতে হবে৷ বাস্তবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা এখন হাড়ে হাড়ে বুঝছেন, জিএসটি একটি অত্যন্ত জটিল করব্যবস্থা৷
ভোটের ময়দানে ফয়দা তুলতে নেমে পড়েছে কংগ্রেসও৷ কংগ্রেস নেতারা বলছেন, আমাদের ১৮ শতাংশের দাবিই মানতে হল বিজেপিকে ক্ষমতায় এলে জিনিসের দাম সস্তা করতে নতুনভাবে জিএসটি আনবেন বলেও তারা জনসাধারণকে নির্বাচনী চমক দিচ্ছেন৷ তাঁদের রাজত্বের সময় তো জিএসটি ছিল না, তখন তারা জিনিসের দাম কমাতে পারেননি কেন? আজ তাদের জিএসটি–র অজুহাত দিতে হচ্ছে কেন?
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক পরিসংখ্যান দিয়ে বলেছে, জিএসটি চালু হওয়ায় রাজস্ব বাবদ আয় কমেছে রাজ্য সরকারগুলির৷ এই ঘাটতি পূরণের ব্যবস্থা করতে সাধারণ মানুষের পরিষেবা খাতে সরকারি ব্যয় কমছে৷ আবার এই অজুহাতে শিক্ষা–স্বাস্থ্য থেকে সড়ক নির্মাণের খরচ এমনকী পানীয় জলের দায়িত্বও সরকার তুলে দিচ্ছে বেসরকারি মালিকদের হাতে৷ তার খরচ জোগাচ্ছে সাধারণ মানুষই৷ অর্থাৎ ঘুরিয়ে বাড়তি বোঝা মানুষের ঘাড়ে চাপানো হয়েছে৷
নোট বাতিলের ক্ষেত্রেও তাই৷ একে একটি যুগান্তকারী, ঐতিহাসিক পদক্ষেপ বলে ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী সহ বিজেপির নেতা–মন্ত্রীরা৷ মানুষের অভিজ্ঞতা হল ঠিক উল্টো৷ জেরবার হয়ে গেল জনজীবন৷ শ্রমিক–কৃষক, দোকানদার, ছোট ব্যবসায়ী, ছোট শিল্প সর্বত্র মারাত্মক আক্রমণ হিসাবে নেমে এল৷ কাজ হারালেন লক্ষ লক্ষ মানুষ৷ অসংখ্য সংস্থার ঝাঁপ বন্ধ হল৷ এরই প্রতিফলন ঘটেছে সরকার স্বীকৃত সংস্থার রিপোর্টে৷ অল ইন্ডিয়া ম্যানুফ্যাকচারার্স অর্গানাইজেশন (এআইএমও) নামের সংস্থাটি সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন প্রান্তের প্রায় ৩৫ হাজার ব্যবসায়ী এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি সংস্থার উপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছে, নোট বাতিল–জিএসটি কমিয়েছে কর্মসংস্থান৷ অতি ক্ষুদ্র শিল্পক্ষেত্রে ৩২ শতাংশ, ক্ষুদ্র শিল্পক্ষেত্রে ৩৫ শতাংশ, মাঝারি শিল্পক্ষেত্রে ২৪ শতাংশ এবং বাণিজ্যক্ষেত্রে ৪৩ শতাংশ কাজ চলে গেছে৷ সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে অসংগঠিত ক্ষেত্রে৷ যেমন– সেলাই কারখানা, দেশলাই কারখানা, প্লাস্টিক কারখানা, বাজি কারখানা, ট্যানারি ইত্যাদি৷ ‘নোটবন্দির ফলেই অর্থনীতির ইঞ্জিন বিগড়ে গিয়েছিল’– ২০১৭–১৮ সালের আর্থিক সমীক্ষা পেশ করতে গিয়ে এ কথা বলতে বাধ্য হয়েছিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি৷ আবারও সমীক্ষা রিপোর্টে তা প্রমাণ হল৷
২০১৬ সালের নভেম্বরে নোট বাতিল ঘোষণা করে সরকার৷ এতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উৎপাদন মার খাবে, দেশের সাধারণ মানুষের দুর্দশা বাড়বে– একথা তখনই বারবার মানুষের কাছে তুলে ধরেছিল এসইউসিআই(কমিউনিস্ট)৷ এই সিদ্ধান্ত যে কালো টাকার কারবারিদের সুবিধা দিতে, তাদের কালো টাকাকে সাদা করতে, এ কথাও দলের প্রচারপত্রে বলা হয়েছিল৷ সাধারণ মানুষকে নিয়ে সারা দেশে আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছিল সরকারের এই জনবিরোধী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে৷ আর কোনও দল এর বিরুদ্ধে এভাবে পথে নেমে প্রতিবাদ করেনি৷ এসইউসিআই(সি) মার্কসবাদ–লেনিনবাদের গভীর উপলব্ধি থেকেই বুঝতে পেরেছিল, এতে সাধারণ মানুষের ক্ষতিই হবে, বিজেপির এই সিদ্ধান্ত মালিক শ্রেণির পক্ষে৷ সেটাই আজ অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে৷ একের পর এক অর্থনীতিবিদ যাঁরা নোট বাতিল ও জিএসটি চালুর কট্টর সমর্থক ছিলেন, তাঁরাও বিরোধিতা করে সরকারের নানা দপ্তর থেকে পদত্যাগ করছেন৷ শুধু তাই নয়, এতে যে অর্থনীতির কিছুমাত্র উন্নতি হবে না, এসইউসিআই(সি)–র এই মূল্যায়নও আজ সম্পূর্ণ সত্য প্রমাণিত৷
রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পূর্বতন গভর্নর রঘুরাম রাজন নোট বাতিলে সিলমোহর দিলেও পদত্যাগের পরে বলেন, ভারতীয় অর্থনীতির চাকা মাটিতে গেঁথে যাওয়ার জন্য নোটবন্দি ও তড়িঘড়ি জিএসটি চালুর জোড়া ধাক্কাই দায়ী৷ প্রধানমন্ত্রীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ অর্থনীতিবিদ, সরকারের ভূতপূর্ব মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যনের পদত্যাগ এবং নোট বাতিলকে ‘ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত’ তকমা সরকারের ভুল সিদ্ধান্তকেই প্রমাণ করেছে৷ বিজেপির সমর্থক তাবড় কর্পোরেট কর্তা থেকে শুরু করে সরকারি আধিকারিক, যাঁরা ডিমনিটাইজেশনের কট্টর সমর্থক ছিলেন, তাঁরাও একে একে এর বিরোধিতা করছেন৷ আসলে বিজেপি নেতারা কিছু একটা করে দেশের মানুষকে চমকে দিতে চেয়েছিলেন৷ কিন্তু তা যে জনমনে এমন প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে তা তাঁরা বুঝতে পারেননি৷ আজ ধাক্কা খেয়ে ঢোক গিলে তাদের বলতে হচ্ছে– নোট বাতিল ও জিএসটি চালু সঠিক ছিল না৷
আসলে কংগ্রেস, বিজেপি সকলেই ধনিক শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে৷ শ্রেণিবিভক্ত বুর্জোয়া রাষ্ট্রে যে কোনও আর্থিক সংস্কারই ক্ষমতাসীন সরকার করে বুর্জোয়া শ্রেণির স্বার্থে৷ সোজা কথায়, মালিক শ্রেণির সেবাদাস সরকার আর্থিক সংস্কারের মাধ্যমে মালিকদের স্বার্থই রক্ষা করে৷ কিন্তু তা তারা করে জনগণের স্বার্থরক্ষার ঢাক বাজিয়েই৷ দেশের কর্পোরেট পুঁজিপতিদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল জিএসটি চালুর৷ বিজেপিও সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে তাদের সাহায্যের রিটার্ন দিল৷ আর নোট বাতিল করে শিল্পপতিদের অনাদায়ী ঋণের বোঝায় ধুঁকতে থাকা ব্যাঙ্কগুলিকে সাময়িক ভাবে চাঙ্গা করা হল৷ সাথে সাথে ক্ষমতার গদি আঁকড়ে থাকতে জিএসটি–নোট বাতিলের জোড়া চমকে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করল বিজেপি৷ কিন্তু তাদের চমকের রাজনীতি জনগণ ধরে ফেলেছে৷