প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সহ বিজেপির নেতা-মন্ত্রীরা হামেশাই ‘গুজরাট মডেল’-এর কথা বলেন, সেখানকার ‘বিকাশের’ কথা, জনসাধারণের ‘উন্নতির’ কথা বলেন। গুজরাটে বিজেপি ক্ষমতায় আছে দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে, সেই ১৯৯৮ সাল থেকে। এর ওপর ২০১৪ সালে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকে সে রাজ্যে ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকার চলছে। কিন্তু সেই গুজরাটের ভিতরের এমন সব চিত্র মাঝেমাঝে সংবাদমাধ্যমেপ্রকাশিত হয়, যা দেখে আঁতকে উঠতে হয়।
সম্প্রতি ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরোর তথ্যে এরকম একটি ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। এনসিআরবি জানিয়েছে, ২০১৬ থেকে ২০২০, এই পাঁচ বছরে গুজরাটে ৪১ হাজার ৬২১ জন মহিলা নিখোঁজ হয়েছেন।
কেবল গুজরাটেই নয়, বিজেপি শাসিত সকল রাজ্যে, তথা গোটা দেশেই মহিলাদের সুরক্ষা আজ বিপন্ন। উত্তরপ্রদেশ থেকে কর্ণাটক, দিল্লি থেকে পশ্চিমবঙ্গ সর্বত্রই মেয়েদের উপর অপরাধের ঘটনা বাড়ছে। ২০১৪ সালে কেন্দ্রের ক্ষমতায় আসার আগে যে বিজেপি মহিলাদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’-এর স্লোগান তুলেছিল, তাদের সাংসদ এবং ভারতের কুস্তি ফেডারেশনের সভাপতি ব্রিজভূষণ শরণ সিং-এর বিরুদ্ধে মহিলা কুস্তিগিররা যৌন নির্যাতনের অভিযোগে এক মাসের বেশি সময় ধরে ধর্নায় বসেছিলেন। কিন্তু সরকার তাঁদের বিষয়ে কিছু বলেনি শুধু তাই নয়, পুলিশ দিয়ে বর্বরের মতো টেনে-হিঁচড়ে গ্রেফতার করেছে।
এর আগে উত্তরপ্রদেশে, বা জম্মু-কাশ্মীরে যখন তরুণী ও শিশুদের গণধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছিল, তখন বিজেপি সরকার দোষীদের বাঁচাতে রীতিমত তৎপর ছিল। এমনকি দোষীদের সমর্থনে বিজেপির নেতা-কর্মীরা মিছিল পর্যন্ত করেছিল। উত্তরপ্রদেশেরই উন্নাওতে বিজেপির প্রাক্তন বিধায়ক কুলদীপ সেঙ্গার একটি তরুণীকে ধর্ষণে অভিযুক্ত হওয়ার পর, মেয়েটির বাবাকেও হত্যা করে। পুলিশ সে ক্ষেত্রেও প্রথমে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি, পরে তীব্র প্রতিবাদের চাপে তারা ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়। কয়েক বছর আগে কর্ণাটকে এবং সদ্য ত্রিপুরায় বিজেপি বিধায়কেরা বিধানসভার অভ্যন্তরে নীল-ছবি দেখছিল। এরা তাহলে অন্য সময় কেমন জীবনযাপন করে? নারী নির্যাতনের মুখ্য কারণগুলি যথা মদ ও মাদক দ্রব্যের প্রসার, সিনেমা ও বিজ্ঞাপনে নগ্ন নারীদেহের অবাধ প্রদর্শন, ইন্টারনেটে যৌনতার খোলাখুলি প্রদর্শন বন্ধে সরকার কোনও ব্যবস্থাই নেয়নি। ফলে মেয়েদের প্রতি সম্মানবোধ আসবে কেমন করে? তাদের মানুষ হিসেবে নয়, উপভোগের বস্তু হিসেবে দেখা হয়। এভাবেই যুব-সমাজকে অমানুষে পরিণত করা হচ্ছে।
গুজরাটের কথায় ফিরে আসা যাক। কোথায় গেলেন ওই নিখোঁজ হওয়া বিপুল সংখ্যক মহিলা? প্রাক্তন আইপিএস অফিসার এবং গুজরাট রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের সদস্য সুধীর কুমার বলছেন, ‘কিছু ক্ষেত্রে আমি দেখেছি যে বালিকা এবং মহিলাদের গুজরাটের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এবং জোর করে দেহব্যবসায় নামানো হচ্ছে।’ তাঁর মতে খুনের মতোই গুরুত্ব দিয়ে এই সব ঘটনার তদন্ত করা উচিত। রাজ্যের প্রাক্তন এডিজি ডঃ রাজন প্রিয়দর্শীও মনে করেন দেহব্যবসায় নামানোর জন্যই ওই মহিলাদের একটা বড় অংশকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘আমার কার্যকালে দেখেছি নিখোঁজ মহিলাদের অধিকাংশকেই দেহব্যবসায়ে নামানোর জন্য চক্রগুলো অন্য রাজ্যে নিয়ে যায় এবং তাদের বিক্রি করে দেয়।’ খেড়া জেলার এই প্রাক্তন এসপি বলেন, ‘একবার উত্তরপ্রদেশ থেকে কাজ করতে আসা একটি লোক এক মহিলাকে অপহরণ করে এবং তাকে নিজের রাজ্যে নিয়ে গিয়ে খেতমজুর হিসেবে বিক্রি করে দেয়। আমরা সেই মহিলাকে উদ্ধার করি। তবে এমন সৌভাগ্য খুব কম জনের ক্ষেত্রেই ঘটে’। গুজরাটের মহিলাদের বিষয়ে এই সত্য প্রকাশ্যে আসার সাথে সাথে সামাজিক মাধ্যমে ঝড় ওঠে। এটাই যে প্রকৃত ‘গুজরাট মডেল’ সেই কথা অনেকে বলছেন। বাধ্য হয়ে আসরে নামতে হয় গুজরাট পুলিশকে। একদিনের মধ্যে তারা জানায় নিখোঁজ মহিলাদের মধ্যে ৯৪.৯ শতাংশকে উদ্ধার করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং মাত্র ২১২৪ জন নিখোঁজ রয়েছেন। প্রথমত, যে গুজরাট পুলিশ রাজ্যে ভয়ঙ্কর গণহত্যার সময় নিষ্ক্রিয় ছিল, যারা ওই গণহত্যার সাক্ষী ‘খুঁজে না পাওয়ায়’ বহু নৃশংস অপরাধী ছাড়া পেয়ে গেছে, যে রাজ্যের পুলিশ সঞ্জীব ভাট সহ প্রতিবাদী অফিসারদের জেলে পোরার জন্য মিথ্যা মামলা সাজিয়েছে, যারা সোহরাবুদ্দিন, ইসরাত জাহান সহ অনেক নির্দোষকে মিথ্যা এনকাউন্টারে হত্যা করেছে, তাদের দেওয়া তথ্য কতটা বিশ্বাসযোগ্য? দ্বিতীয়ত, গুজরাট পুলিশের তথ্যই যদি সঠিক হয়, তা হলেও তো রাজ্যের ২১২৪ জন মহিলা নিখোঁজ রয়েছেন! এই ২১২৪ জন কি একটা নিছক সংখ্যা? এঁদের অনেকেরই তো পরিবার আছে, বাবা-মা-স্বামী-সন্তান আছে! এঁদের কি মর্যাদা নিয়ে বাঁচবার অধিকার নেই? কার দোষে নিষিদ্ধপল্লিকে এঁদের ঠিকানা বানাতে হচ্ছে? কোনও সভ্য দেশের গণতান্ত্রিক সরকার কি এই ভাবে এই মহিলাদের দায়িত্ব কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারে? দেশের মানুষ কিছুতেই এই পরিস্থিতি মানতে পারে না।