কাশ্মীর নিয়ে স্বৈরচারী ঘোষণার ঠিক আগেই গণতন্ত্র হত্যায় বিজেপি পাশে পেয়ে গিয়েছিল ভোট ময়দানে তার প্রবল বিরোধী কংগ্রেসকে৷ ২ আগস্ট রাজ্যসভায় ইউএপিএ সংশোধনী আইনের পক্ষে ভোট দিয়েছেন কংগ্রেসের এমপিরা৷ বহুজন সমাজ পার্টির এমপিরাও সংসদ এড়িয়েছেন, পাছে উপস্থিত থাকলে সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে সিবিআই মামলার কোপে পড়তে হয় বিজেপি সরকার ইউএপিএ আইনে সংশোধন এনে বলেছে, যে ইচ্ছা করলেই সরকার কোনও নিরপরাধ মানুষকেও ইউএপিএ আইনে সন্ত্রাসবাদী বলে দাগিয়ে গ্রেপ্তার করে জেলে ভরতে পারে৷ তার জন্য কোনও আইনি অনুমোদন নিতে হবে না৷
সন্ত্রাসবাদী ব্যক্তির সংজ্ঞা কী? কোন নিরিখে সরকার ঠিক করবে একজন ব্যক্তি সন্ত্রাসবাদী, নাকি নয় যে কোনও আইন যা একজন মানুষের জীবনের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এত গুরুত্বপূর্ণ অপর ক্ষেত্রে এইরকম ধোঁয়াশা যে কী মারাত্মক হতে পারে, তা এ দেশের প্রতিবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী মানুষ জানেন৷ কাশ্মীরের নিরীহ সাধারণ মানুষ, মণিপুর, আসাম সহ উত্তর–পূর্বের মানুষ, এই পশ্চিমবঙ্গের লালগড়, নন্দীগ্রামের মানুষ জানেন– প্রশাসন, পুলিশ মিলিটারির ইচ্ছা–নিচ্ছার উপর বাঁচতে হলে জীবন কতটা দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যাখ্যাহীনতাতেই আবার একবার স্পষ্ট হয়ে গেল ‘সন্ত্রাসবাদী’ তকমাটি বিরোধী দমনেই ব্যবহার করবে সরকার৷
এমনিতেই ইউএপিএ আইনের ৩৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকার যে কোনও সংগঠনকে সন্ত্রাসবাদী বলে ঘোষণা করে তার সদস্য কর্মকর্তা, অর্থ জোগানদাতা সকলকে ইচ্ছা করলেই গ্রেপ্তার করে বিনা বিচারে ১৮০ দিন পর্যন্ত আটকে রাখতে পারে৷ এই আইন অনুসারে পুলিশ, সিবিআই, এনআইএ ইত্যাদি সরকারি সংস্থা কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলেই ধরে নেওয়া হয় অভিযুক্ত অপরাধী৷ ফলে সরকারের দায় থাকে না অভিযোগ প্রমাণ করার৷ অভিযুক্তকেই প্রমাণ করতে হয়, সে নির্দোষ কি না৷ যা ন্যায়বিচারের নীতির সম্পূর্ণ বিপরীত৷ এই নতুন সংশোধনীতে কোনও সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের সাথে যুক্ত নয় এমন ব্যক্তিকেও সন্ত্রাসবাদী ঘোষণা করার পর শাস্তি দেওয়ার আলাদা কোনও বিধান সরকার আনেনি৷ প্রচলিত আইনের ৩৮, ৩৯ ইত্যাদি ধারাতেই তাদের বিচার হবে৷ তাহলে আলাদা করে সাংগঠনিক সংযোগহীন ব্যক্তিদের এভাবে সন্ত্রাসবাদী তকমায় চিহ্ণিত করে কোন উদ্দেশ্য সাধন হবে? দেখা যাচ্ছে বাস্তবে সন্ত্রাসবাদীদের চিহ্ণিত করার চেয়েও এই আইন কাজে লাগবে বিরোধী কণ্ঠস্বরকে ভয় পাওয়ানোর কাজে৷ একবার সন্ত্রাসবাদী তকমা কারও গায়ে লাগিয়ে দিলে আরএসএস–বিজেপির সংগঠিত নেটওয়ার্ক তার বিরুদ্ধে সামাজিক বয়কটের মতো প্রচারে নেমে পড়তে পারবে৷ তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার জন্য চাপ দিতে পারবে, সোস্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে তার বিরুদ্ধে মানুষের মন বিষিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারবে৷
কে সন্ত্রাসবাদী? সংসদে দাঁড়িয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলেছেন, তা হাড় হিম করা সন্ত্রাসের অনুভূতিই জাগায়৷ কোনও ব্যক্তির রচনা, সাহিত্য, প্রচারকে সরকার সন্ত্রাসমূলক মনে করলে সে সন্ত্রাসবাদী বলে গণ্য হবে৷ তিনি এমনও বলেছেন, ‘Radicalism’ অর্থাৎ সমাজের আমূল পরিবর্তনের জন্য প্রচার করাটাও সন্ত্রাসবাদ৷ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্য একদিকে মানব সভ্যতার অগ্রগতির ইতিহাসের বিরোধী, অন্যদিকে দেশের সংবিধান প্রদত্ত ব্যক্তি স্বাধীনতারও বিরোধী৷ সমাজ পরিবর্তনের কথা বলা যদি সন্ত্রাসবাদ হয়, এই বিশ্বের বহু মনীষীই যে এই অভিযোগে অভিযুক্ত হবেন নিছক মতবাদ প্রচারের জন্য কেউ সন্ত্রাসবাদী বলে গণ্য হতে পারে না, একাধিকবার সুপ্রিম কোর্টও এ কথা বলেছে৷ ১৯৮৫ সালের বলওয়ান্ত সিং বনাম পাঞ্জাব রাজ্য সরকারের মামলা, ২০১১ সালে অনুপ ভুঁইঞা বনাম আসাম রাজ্য সরকারের মামলা, ২০১১ সালের ডাক্তার বিনায়ক সেনের মামলা সহ বহু মামলায় সুপ্রিম কোর্ট এবং কেরালা হাইকোর্ট সহ একাধিক হাইকোর্ট বারবার বলেছে কেবলমাত্র রাষ্ট্রের কাছে আপত্তিকর এমন কোনও মতবাদকে সমর্থন করেছে, বা তার কাছে সেই মতবাদের সমর্থনে বই মিলেছে এমন কারণে কাউকে সন্ত্রাসবাদী বলা যাবে না৷ কাউকে সন্ত্রাসবাদী বলতে গেলে সরকারকে সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণ করতে হবে যে, সেই ব্যক্তি কোনও সন্ত্রাসবাদী অপরাধমূলক কার্যকলাপ সরাসরি করেছে৷ এমনকী যে আমেরিকার উদাহরণ দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই আইন আনলেন, সেই আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট ‘জয়েন্ট অ্যান্টি ফ্যাসিস্ট রিফিউজি কমিটি’ বনাম ম্যাক গ্রাথ–এর মামলায় বলেছিল, কাউকে সন্ত্রাসবাদী বলে দেগে দেওয়ার এই সর্টকাট রাস্তা আসলে দখলদারির চিন্তা থেকে ধার করা৷ এ কাজ যখন কোনও রাষ্ট্র করে, নিজের ভিতর থেকেই নিজেকে ধ্বংসের পথ সে সুগম করে৷
এনআইএ আইনও এমন করে সংশোধন করা হল যে, এনআইএ–র নিচুতলার অফিসাররা পর্যন্ত রাজ্য সরকারের তোয়াক্কা না করে যে কোনও রাজ্যে ঢুকে কোনও ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার, যে কোনও সময় বিনা নোটিশে তল্লাসি, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা সহ সব করতে পারবে৷ দেশের সংবিধান বলে, আইন শৃঙ্খলা রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত বিষয়, অথচ রাজ্য সরকারকে না জানিয়ে এনআইএ–র হাতে এই যথেচ্ছ ক্ষমতা দিয়ে বিজেপি সরকার যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপরই আঘাত হেনেছে৷
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ‘উদার প্রতিশ্রুতি’ দিয়েছেন, এই আইনের অপব্যবহার হবে না৷ কী করে তিনি এ বিষয়ে এত নিশ্চিত? তাঁর কথায়, যাকে সন্ত্রাসবাদী বলা হবে তিনি স্বরাষ্ট্রসচিব বা মুখ্যসচিবের কাছে আবেদন জানাবেন এবং ৪৫ দিনের মধ্যে তার নিষ্পত্তি হবে৷ তারপরেও যদি না হয়, তাহলে সরকার নিযুক্ত রিভিউ কমিটির কাছে আবেদন জানানো যাবে৷ অর্থাৎ পুরো বিষয়টিই সরকারি মর্জির উপর নির্ভরশীল৷ বুর্জোয়া গণতন্ত্রের মধ্যেও ন্যায়বিচারের একটা ঠাটবাট বজায় রাখার চেষ্টা কিছুদিন আগেও ছিল৷ কিন্তু আজকের চূড়ান্ত সংকটগ্রস্ত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার রক্ষক শাসকরা সেটুকু গণতন্ত্রও রাখতে নারাজ৷ তাই বিচারবিভাগ নয়, সমস্ত বিচারের ভারটা তুলে দেওয়া হল সরকারি আমলাদের উপরই৷ ক্ষমতাসীন দলের বিরাগভাজন কোনও ব্যক্তিকে, বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায় ‘Radicalism’ (সমাজ বদলের কথা) প্রচার করছেন এমন কোনও ব্যক্তিকে সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে ন্যায়বিচার দেবেন আমলারা? বিচারবিভাগের কোনও ভূমিকাই এখানে রাখা হল না৷
কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এই ফ্যাসিবাদী পদক্ষেপের পাশে পেয়েছে সংসদীয় রাজনীতিতে তার ‘প্রবল শত্রু’ কংগ্রেসকে৷ তারা বহু বিরোধী বক্তৃতা দিয়ে শেষ পর্যন্ত ভোট দিয়েছে দুই অগণতান্ত্রিক এবং ফ্যাসিবাদী আইনের পক্ষেই৷ কংগ্রেস নেতা পি চিদম্বরম বলেছেন, ভোট না দিলে বিজেপি তাঁদের বিরুদ্ধে প্রচার করত যে তাঁরা সন্ত্রাসবাদের পক্ষে অপূর্ব যুক্তি সন্দেহ নেই৷ যে বিজেপি–আরএসএসের আদর্শে পুষ্ট সনাতন সংস্থা চার জন বিশিষ্ট যুক্তিবাদী মানুষকে হত্যায় অভিযুক্ত, যে দলের একজন এমপি সন্ত্রাসবাদী হামলার মূল অভিযুক্তদের অন্যতম৷ তারা কাকে সন্ত্রাসবাদের সমর্থক বলবে এই ভয়েই নাকি কংগ্রেস কেঁচো হয়ে গেল আসলে ইউএপিএ থেকে শুরু করে এনআইএ বা অতীতের টাডা–পোটা এমন সবগুলি দানবীয় আইনের হোতা তো কংগ্রেসই৷ আজ বিজেপি তার পুঁজিপতি মালিক প্রভুদের সেবাদাস হিসাবে প্রতিবাদীদের গায়ে পাইকারি হারে সন্ত্রাসবাদী তকমা লাগানোর ব্যবস্থা করছে৷ কারণ তারা জানে, বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মানুষের ক্ষোভ যেভাবে বাড়ছে, তা যে কোনও সময় সংগঠিত আকারে ফেটে পড়বেই, তাই যে কোনও প্রতিবাদী আন্দোলন, শোষণ মুক্তির আন্দোলনকে অঙ্কুরেই গলা টিপে হত্যার ব্যবস্থা হচ্ছে৷ কংগ্রেস একইভাবে এ দেশের আসল মালিক পুঁজিপতি শ্রেণির সেবাদাস হিসাবে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকেছে৷ ভারতে তারাই প্রায় সমস্ত ফ্যাসিবাদী অপকর্মের স্রষ্টা৷ এই কংগ্রেসকেই গণতান্ত্রিক তকমা দিয়ে কেউ কেউ বিজেপির ফ্যাসিস্ট রাজনীতিকে প্রতিহত করার কথা ভাবছে৷ সর্বাত্মক বিরোধী ঐক্যের নামে যাঁরা তা ভাবছেন, কংগ্রেসের এই সমর্থনের পর তারা কী বলবেন৷
এই ঘটনা আবার দেখিয়ে গেল বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, তার ফ্যাসিবাদী প্রবণতার বাড়বাড়ন্তের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলাটাই রাস্তা৷ এর বদলে কংগ্রেসের ভোটসর্বস্ব বুর্জোয়া রাজনীতির সাথে ঘোঁট পাকিয়ে কিছু আসন বাড়িয়ে নেওয়ার রাস্তা বিজেপির এই রাজনীতির বিরুদ্ধে কখনও প্রতিরোধের শক্তি হতে পারে না৷