বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠক অনুষ্ঠিত হল নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে। বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী সহ অন্যান্য নেতাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে উত্তরপ্রদেশ সহ পাঁচ রাজ্যে ভোটের আগে কেন্দে্রর বিজেপি সরকারের প্রতি মানুষের বিশ্বাসের পারদ ক্রমাগত নামছে। তাই আস্থা ফেরাতে দলীয় কর্মীদের দ্রুত মাঠে নামাতে নির্দেশ দিয়েছেন।
প্রশ্ন হল, এখন না হয় বিজেপির প্রতি আস্থা কমছে। কিন্তু মাত্র কয়েক বছর আগে ২০১৪ সালে বিজেপি বিপুল ভোটে জিতে কেন্দ্রে সরকার দখল করেছিল কী করে? সেই সময় কি তারা নিজেদের কার্যকলাপের মাধ্যমে দেশের মানুষের আস্থাভাজন হয়ে উঠেছিল? তা একেবারেই নয়। তা হলে বিজেপি জিতল কী করে? বিজেপি ২০১৪ সালে জিতেছিল কংগ্রেসবিরোধী তীব্র ক্ষোভ থেকে। কংগ্রেসের দশ বছরের চূড়ান্ত জনবিরোধী শাসনে ক্ষিপ্ত হয়ে প্রতিষ্ঠানবিরোধী মানসিকতা থেকে মানুষ বিজেপিকে ভোট দিয়েছিল। একচেটিয়া পুঁজিপতিরা মানুষের ক্ষোভকে তাদের বিশ্বস্ত আর একটি দলের দিকে চালিত করতে মাঠে নেমেছিল। তাদের ভয় ছিল এই ক্ষোভ বিপথগামী না করতে পারলে তা মানুষকে আন্দোলনে নিয়ে যাবে। তাই তারা টাকার থলি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল বিজেপির পাশে। প্রচার দিয়ে টাকার শক্তি দিয়ে প্রশাসনকে কবজা করে বিজেপিকে জেতাতে তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাতে প্রভাবিত হয়েছিল জনমত। এর মধ্যে বিজেপির প্রতি জনগণের গভীর আস্থার কোনও বিষয়ই ছিল না। যে ১৫-১৬টি রাজ্যে বিজেপি জিতেছে সেখানেও কাজ করেছে একই কারণ।
কিন্তু মানুষের জীবন তো শুধু ভোটের অঙ্কে চলে না, কে সরকারে এল আর কে গেল তার দ্বারাও চলে না। তাকে অর্থনীতির নিয়মাধীনে বাজারে কেনাকাটা করতে হয়, খাবার জোগাড় করতে হয়। সে জন্য রোজগার করতে হয়। সেখানে তাকে পড়তে হচ্ছে কঠিন পরিস্থিতির সামনে। আর তখনই সরকারের বিরুদ্ধে তৈরি হচ্ছে একরাশ ক্ষোভ-বিক্ষোভ, সেই বিক্ষোভ ফেটেও পড়ছে দেশের নানা প্রান্তে।
সরকারের কাছে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা কী? তারা চান সরকার এমনভাবে শাসন পরিচালনা করুক, যাতে মানুষ সুস্থ ভাবে খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারে। কিন্তু বাস্তবে দেশে আজ কোথাও সে পরিস্থিতি নেই। দেশের সিংহভাগ মানুষের স্থায়ী চাকরির সংস্থান নেই। স্থায়ী রোজগার নেই। নিত্যব্যবহার্য প্রতিটি জিনিসের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। ভোজ্য তেলের দাম মোদি শাসনে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। গ্যাসের দাম হাজার টাকা ছুঁইছুঁই। গ্যাসে যে ভর্তুকি দেওয়া হত, নানা শ্রুতিমধুর বাকচাতুর্যের আড়ালে তা তুলে দেওয়া হয়েছে। শীঘ্রই কেন্দ্রীয়রেশন বন্ধ করে দেবে বলছে। সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক সঙ্কট কমানোর পরিবর্তে, সরকার একের পর এক জনবিরোধী নীতির দ্বারা বাড়িয়েই চলেছে। মানুষ এই অবস্থায় সরকারের প্রতি আস্থাহীন না হয়ে পারে?
এসব প্রশ্ন তুললেই বিজেপি নেতারা বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার তো মানুষকে আর্থিক সাহায্য দিচ্ছে। কেমন সে সাহায্য? বিজেপি বলছে, বিনে পয়সায় চিকিৎসার জন্য ‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রকল্প আনা হয়েছে, কৃষকদের অ্যাকাউন্টে ডাইরেক্ট টাকা পাঠানো হচ্ছে। অর্থাৎ, অনেকটা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর ‘স্বাস্থ্যসাথী’ বা ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ বা ‘কৃষকবন্ধু’ প্রকল্পের মতো। কিন্তু মানুষ বাস্তবে কী চান? মানুষ চান নিজেদের আর্থিক সমৃদ্ধি, নিজস্ব স্থায়ী রোজগার, যাতে অন্যের দয়া ভিক্ষার উপর বা সরকারের অনুদানের উপর বাঁচতে না হয়। এই স্বনির্ভরতার উপর কেন্দ্রীয় সরকার মারাত্মক আঘাত হেনেছে।
সরকারি উদ্যোগে স্থায়ী চাকরির সুযোগ ক্রমাগত কমানো হচ্ছে। নতুন পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে না। বিপরীতে পদ বিলোপ চলছে। স্থায়ী চাকরিগুলোকে অস্থায়ী, চুক্তি নির্ভর করে দিচ্ছে। শ্রম আইনের সংস্কার করে কাজের ঘন্টা বাড়াচ্ছে, মজুরি কমাচ্ছে। মানুষ ভাল থাকবে কী করে?
এমন একটি বিদ্যুৎ আইন সরকার আনতে চলেছে যেখানে শিল্প মালিকদের বিদ্যুৎ মাশুল কমবে, বাড়বে সাধারণ মানুষের। পারস্পরিক ভর্তুকি তুলে দিয়ে এই আক্রমণ নামিয়ে আনছে। বিদ্যুৎকে পুরোপুরি তুলে দিচ্ছে বেসরকারি হাতে। যে কৃষিবিল মোদি সরকার এনেছে, তার জনবিরোধী চরিত্র উদঘাটিত করে কৃষকরা তার বিরুদ্ধে একবছর ধরে দিল্লিতে ঘাঁটি গেড়ে গণতান্ত্রিক পথে লড়লেও সরকার তা পাল্টাতে নারাজ। সরকার ওই কৃষি আইন কৃষকদের উপর জোর করে চাপাতে বদ্ধপরিকর বৃহৎ পুঁজিপতিদের স্বার্থে। এই অবস্থায় কৃষকরা বিজেপি থেকে মুখ না ফিরিয়ে পারে?
জনজীবনের সকল ক্ষেত্রেই সরকার তার জনবিরোধী নীতির দ্বারা আক্রমণ নামিয়ে আনছে। শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত মানুষ বিজেপি শাসনে ক্ষুব্ধ। নয়া জাতীয় শিক্ষানীতির মাধ্যমে শিক্ষার গৈরিকিকরণ, ইতিহাস পাল্টানো, বেসরকারিকরণ, ব্যাপক ফি বৃদ্ধি, ক্যাপিটেশন ফি বৃদ্ধি করা হচ্ছে। শিক্ষায় ‘ব্লেন্ডেড মোড’ অর্থাৎ অনলাইন ও অফলাইনের মিশ্র পদ্ধতির নামে বাস্তবে অনলাইন নির্ভরতা শিক্ষক নিয়োগকে অপ্রয়োজনীয় করে তুলছে। সাম্প্রদায়িক বিভেদ, পরধর্ম বিদ্বেষ বেড়েই চলেছে সরকারের মদতে। দলিত জনগোষ্ঠীর উপর শাসক দলের মদতপুষ্ট জাতিবাদী আক্রমণ বাড়ছে। ফলে বিজেপি শাসনে সাধারণ মানুষের ‘আচ্ছে দিন’ একেবারেই অধরা। পোয়া বারো পুঁজিপতি শ্রেণির।
এই অবস্থায় বিজেপি নেতারা দলের সমর্থন ফিরিয়ে আনার জন্য যতই দলীয় কর্মীদের মাঠে নামাক, তাদের শাসনে মানুষের দুরবস্থা বাড়তেই থাকবে এবং মানুষ পরিবর্তন চাইবেই। বার বার মানুষের বিক্ষোভ ফেটে পড়বেই। পড়ছেও। দরকার এই পরিবর্তনের আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যোগ্য সংগ্রামী বামপন্থী নেতৃত্ব। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ এবং বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ, দুটোই ভারতের পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষার রাজনৈতিক জোট। এই জোটের কোনওটিরই দ্বারা জনগণের স্বার্থ রক্ষা হতে পারে না। পুঁজিপতিদের সেবা করতে গিয়ে জনবিরোধী কাজের জন্য একটি জোট জনগণের ক্ষোভের সামনে পড়লে পুঁজিপতিরা তখন মানুষকে শান্ত করতে অপর জোটকে সামনে আনে। আবার এই জোটের জনবিরোধী কাজের জন্য মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলে পুঁজিপতিরা তখন একে সরিয়ে আগের জোটকে আনে। জনগণের বিক্ষোভকে প্রশমিত করতে পুঁজিপতিদের এটা একটা মারাত্মক কৌশল। মারাত্মক কেন? কারণ, এর প্রতারণার ক্ষমতা অনেক বেশি। এর বাইরের রূপটা গণতান্ত্রিক। মানুষ মনে করে, সে ভোট দিয়ে নিজের সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। পুঁজিপতিদের মিডিয়ার প্রচারে প্রভাবিত হয়ে মানুষ ভোট দিয়ে যাকে প্রতিষ্ঠা করেছে সে পুঁজিপতিদের পছন্দের সরকার। রাজনৈতিক বিষয়ে চর্চার অভাবে মানুষ প্রথমে তা বুঝতে পারে না। পারে অভিজ্ঞতায়, একের পর এক জনবিরোধী নীতি দেখে, আর ক্ষোভের সাথে বলে কেউ কিছু করবে না। এই ক্ষোভ বা আক্ষেপের পিছনে রয়েছে জনগণের প্রকৃত বন্ধুশক্তিকে চিনতে না পারা।
বুর্জোয়াদের বিপরীতে কারা জনগণের প্রকৃত বন্ধু? অবশ্যই বামপন্থীরা। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ভারতের অধিকাংশ বামপন্থী দল কিছু সিটের আশায় বুর্জোয়া জোটে সামিল। বামপন্থীদের যে বিকল্প জোট গড়ে উঠেছিল সেই জোটের বেশিরভাগ শরিকই কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ-র সাথে তালমিল করে চলছে। এই অবস্থায় বিকল্প বামপন্থী ঝান্ডা তুলে ধরে এস ইউ সি আই (সি) জনগণকে সাথে নিয়ে সাধ্যমতো গণআন্দোলন গড়ে তুলছে। যেখানে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলন গড়ে তুলছে সেখানেই এস ইউ সি আই (সি) সামিল হয়ে আন্দোলনের শক্তিবৃদ্ধি ঘটাচ্ছে। এই শক্তি ছাড়া সমাজে যথার্থ পরিবর্তন আনার বাস্তবে আর কেউ নেই। আর কেউ নেই বুর্জোয়াদের ছলচাতুরির মুখোশ খুলে দিয়ে জনগণকে সচেতন করার।