এ বছর ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে উত্তর–পূর্ব দিল্লির জাফরাবাদে দাঙ্গার নামে যে পরিকল্পিত গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল এবং যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হতে দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের অধীন দিল্লি পুলিশ দাঁড়িয়ে থেকে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালনের (এমনকি কোনও কোনও ক্ষেত্রে দাঙ্গায় সক্রিয় মদত) জন্য দিল্লি হাইকোর্টের ভর্ৎসনা শুনেছিল, সেই ভয়াবহ ঘটনার একটি রিপোর্ট তথ্য অনুসন্ধান কমিটি সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র দপ্তরের কাছে জমা দিয়েছে এবং এর অংশবিশেষ সংবাদমাধ্যমেও দেওয়া হয়েছে৷ এই কমিটিতে হাইকোর্টের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, তিন জন আমলা, এনআইএ–র প্রাক্তন সরকারি ডকিল সহ ছ’জন ছিলেন৷ ‘কল ফর জাস্টিস’ নামে এক এনজিও–র দ্বারা গঠিত হলেও বাস্তবে এই কমিটি ছিল সরকারের অদৃশ্য হাতে–গড়া এক কমিটি৷ কমিটির সদস্যরা ২৯ ফেব্রুয়ারি এবং ১ মার্চ দাঙ্গা কবলিত এলাকা ঘুরে দেখেন৷ তারা জানান ‘হিন্দু এলাকাগুলিতে দোকান ও বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি এবং হিন্দু মানুষরা সাক্ষ্যপ্রমাণ তাদের দেখাতে পারলেও, মুসলিম মানুষরা তেমন কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণ দেখাতে পারেননি৷ তারা আরও জানান এই ঘটনার পিছনে সিএএ বিরোধী আন্দোলনের মদতদাতা ‘টুকড়ে টুকড়ে গ্যাং’, বিভিন্ন মৌলবাদী সংগঠন এবং পাকিস্তান ও আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলির হাত রয়েছে৷ (টাইমস নাও নিডজ.কম, মে ২৯,২০২০)৷ কমিটির এই অনুসন্ধান সুষ্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় সরকারের জঘন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভূমিকাকে আড়াল করতেই এই কমিটি গড়া হয়েছিল৷ না হলে মাত্র দু’দিন ঘুরে বিস্তীর্ণ এলাকার ভীত সন্ত্রস্ত মানুষের কাছে তারা পৌছতে পারলেন কী করে? যে মানুষগুলি এলাকাছাড়া হয়ে গিয়েছে তাঁদের কাছে পৌঁছানোর কোনও তাগিদ তাঁদের ছিল না৷ যেখানে ঘটনার সমসাময়িক দিনগুলিতে সংবাদপত্র, মিডিয়া, ম্যাগাজিনগুলিতে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলির বাড়িঘর, দোকানপাট, মসজিদের ভাঙচুরের ছবি ও তথ্য প্রকাশিত হয়েছিল, কমিটির সদস্যদের নজরে তা পড়ল না কেন? সরকারের ঘোষিত ৫৩ জন মৃতের মধ্যে মুসলিমের সংখ্যা ৩৮৷ ঘরছাড়াদের অধিকাংশই মুসলিম৷ তা হলে এটা কি ‘জাস্টিস’? নিরপেক্ষ সত্য উদঘাটন? আবার আরএসএস ও হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির ভূমিকার ব্যাপারে কমিটি সম্পূর্ণ নীরব থাকল৷
আসলে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের হীন সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যটি বুঝলে এই সংগঠিত পরিকল্পিত দাঙ্গার চরিত্রটি বুঝতে কারও অসুবিধা হয় না৷ কি ছিল সেই সময়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট? মুসলিম বিদ্বেষ সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের আপামর সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভাজনের উগ্র সাম্প্রদায়িকতাকে মদত দিতে কেন্দ্রীয় সরকার এনেছিল নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, ২০১৯৷ এর বিরুদ্ধে দেশের প্রান্তে প্রান্তে গড়ে উঠেছিল ধারাবাহিক আন্দোলন৷ দিল্লির শাহিনবাগে তিন মাস ধরে মহিলাদের অবস্থান এই আন্দোলনগুলিতে প্রেরণা জোগাচ্ছিল৷ পাশাপাশি দিল্লির দুই বিশ্ববিদ্যালয় জেএনইউ এবং জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার মুক্তচিন্তার বাহক ছাত্রছাত্রীদের সাহসী প্রতিবাদ কর্মসূচিও দেশের সচেতন চিন্তাশীল নাগরিকদের সমর্থন পাচ্ছিল৷ আবার এই দুই আন্দোলনকে ভাঙার জন্য সরকারের হুমকিও কম ছিল না৷ এই আবহেই দিল্লির পূর্বপ্রান্তে জাফরাবাদেও গড়ে ওঠে সিএএ বিরোধী এক অবস্থান৷ এই অবস্থান শুরু হতেই বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদী নেতা কপিল মিশ্র ডষ্কানিমূলক ভাষণে দিল্লি পুলিশকে হুমকি দিয়ে বলেন যে, অবিলম্বে আন্দোলনকারীদের হঠিয়ে না দিলে, তারা নিজেরাই এই কাজ করবে৷ এরপরই এই হত্যাকাণ্ড ও দাঙ্গার ঘটনা ঘটল৷ অথচ এই সম্পর্কে কমিটির কোনও পর্যালোচনা ছিল না৷ ফলে এটা পরিষ্কার বিজেপি সরকারের ইঙ্গিতেই তৈরি এই কমিটির রিপোর্ট আসলে দিল্লির এই ঘটনার পিছনে বিজেপি দলের ঘৃণ্য হীন কাজকে ঢাকতেই মরিয়া প্রয়াস ছাড়া আর কিছু নয়৷
তেমনি বিজেপি সরকারের আরও ঘৃণ্য কাজ হল করোনা ও লকডাডনের এই পরিস্থিতিতে যখন মানুষের রাস্তায় নেমে আন্দোলন করার সুযোগ নেই, তখন তারা সিএএ বিরোধী আন্দোলনকারীদের এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ইডএপিএ আইনে গ্রেপ্তার করে প্রতিহিংসা চালাচ্ছে৷ কিন্তু প্রতিহিংসা চালিয়ে হোক, বা সত্যকে চাপা দেওয়ার প্রয়াসই হোক, ইতিহাসে কোনও শাসকই এইভাবে চিরকাল তার শাসন শোষণের যন্ত্র বহাল রাখতে পারেনি৷ বিজেপিও পারবে না৷