সুপ্রিম কোর্টের বর্ষীয়ান এবং বিশিষ্ট আইনজীবী এবং আইন ও বিচার সংক্রান্ত গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী প্রশান্ত ভূষণের বিরুদ্ধে শীর্ষ আদালতের আনা স্বতঃপ্রণোদিত (সুয়ো-মোটো) আদালত অবমাননার মামলা প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার বদলে তুলে দিয়ে গেছে বহু প্রশ্ন। ৩১ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অরুণ মিশ্রের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ তাঁকে আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে ১ টাকা জরিমানা অথবা তিনমাসের জেল, না হলে তিন বছর আইনজীবী হিসাবে সাসপেন্ড থাকার রায় দিয়েছে।
আদালত ক্ষমা চাইতে বলায় তিনি বলেছিলেন, যে বক্তব্যের জন্য আদালত তাঁকে অপরাধী সাব্যস্ত করেছে, সেটি বলা উচিত ছিল বলেই তাঁর বিবেক মনে করে। ফলে তিনি ক্ষমা চাইলে তা আন্তরিক হবে না। এ কাজ তাঁর নিজের বিবেক এবং আদালত উভয়ের ক্ষেত্রেই তা মর্যাদাহানিকর হবে।
যে দুটি টুইটার মন্তব্য কেন্দ্র করে এই শাস্তি, তার প্রথমটিতে প্রশ্ন ছিল বিশেষ কোম্পানির অতি দামী বাইকে বসে ছবি তোলার সময় প্রধান বিচারপতি মাস্ক এবং হেলমেট পরেননি কেন? পরে বাইকটি স্ট্যান্ডে আছে দেখে তিনি হেলমেট কথাটি প্রত্যাহার করেন। অপর টুইটে তিনি বলেছিলেন, সাম্প্রতিক কালে দেশের সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। এ জন্য শেষ চারজন প্রাক্তন প্রধান বিচারপতিকে তিনি দায়ী করেছিলেন। এক সাথে ২০০৯ সালে তহলকা পত্রিকাকে দেওয়া তাঁর একটি সাক্ষাতকারকে ধরে আদালত অবমাননার যে মামলা এতদিন চাপা পড়েছিল, তাও তুলে আনা হয়েছে।
বেশ কয়েকজন প্রাক্তন বিচারপতি, বহু বিশিষ্ট আইনজীবী, আইনের ছাত্র সহ সারা দেশের গণতন্ত্রপ্রিয় অসংখ্য মানুষ আবেদন করেছিলেন, প্রশান্ত ভূষণকে কোনও শাস্তি দেওয়া দূরে থাকুক, শীর্ষ আদালতের উচিত সমালোচনাকে খোলা মনে বিচার করা এবং এতে কোনও সত্য থাকলে তা গ্রহণ করা। যে কোনও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানেরই মানুষের সমালোচনাকে গুরুত্ব দিয়ে শোনা এবং তা থেকে সত্যটা গ্রহণ করা দরকার। সমালোচনা গ্রহণ করলেই কোনও প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা হানি হয় না। বরং দুই লাইনের টুইটার মন্তব্যেই শীর্ষ আদালতের মতো প্রতিষ্ঠানের ভেঙে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হলে, তা দেখিয়ে দেয় এ দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির ক্ষয় কতদূর বিস্তৃত হয়েছে! এ কথা কি কোনওভাবেই অস্বীকার করা যায় যে, সাম্প্রতিক কালে বিশেষত ২০১৪ পরবর্তী সময় ভারতে বিচার ব্যবস্থার উপর সরকারের ছড়ি ঘোরানোর প্রচেষ্টা যেমন বেড়েছে। অন্যদিকে তাকে মোকাবিলা করে বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা বজায় রাখার চেষ্টার ঘাটতি নিয়েও জনমানসে প্রশ্ন উঠছে। ইন্দিরা গান্ধীর আমল থোক চলে আসা ‘কমিটেড জুডিশিয়ারি’ তৈরির অপচেষ্টার সাথে নরেন্দ্র মোদী সরকারের কার্যকলাপের হুবহু মিল পাওয়া যাচ্ছে শুধু নয়, সে কাজে বর্তমান সরকার আরও এগিয়ে। এই লক্ষণ দেখে আইন, ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষ উদ্বিগ্ন! ফলে এই সমস্ত প্রশ্নের পরিস্কার উত্তর হওয়া আজ অত্যন্ত জরুরি।
আদালতে দাঁড়িয়েই কেন্দ্রীয় সরকারের অ্যাডভোকেট জেনারেল পর্যন্ত প্রশান্ত ভূষণ মামলায় আদালতে কমপক্ষে ৯ জন সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতির নাম তুলে ধরতে চেয়েছিলেন যাঁরা বিচারব্যবস্থায় দুর্নীতি নিয়ে সরব হয়েছেন। কিন্তু তিন বিচারপতির বেঞ্চ তাঁকে মাঝপথেই থামিয়ে দেন। পরবর্তীকালে ‘দ্য ওয়ার’ পত্রিকা তুলে ধরেছে, প্রাক্তন বিচারপতিদের সেই সব মারাত্মক অভিযোগ। যেখানে তুলে ধরা হয়েছে কীভাবে হাইকোর্ট এমনকি সুপ্রিম কোর্টের কিছু বিচারপতি বিশেষ কিছু আইনজীবী-আহূত সান্ধ্য পার্টিতে যোগ দেন। যেখানে অর্থবান মামলাকারীরাও উপস্থিত থাকেন। আজ মানুষের মধ্যে প্রশ্ন তো উঠছেই কাশ্মীরের মানুষের সাংবিধানিক অধিকার নিয়ে মামলা শোনার সময় শীর্ষ আদালত পাচ্ছে না, অথচ রাম মন্দির নির্মাণ তার কাছে অগ্রাধিকার হয়ে যাচ্ছে! আরও প্রশ্ন ওঠে, যখন রাম মন্দির রায় নিয়ে শাসকদলের উল্লাস ধ্বনি থিতিয়ে আসার আগেই ওই রায়দানকারিদের অন্যতম সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিকে সংসদে রাষ্ট্রপতি মনোনীত প্রার্থী হিসাবে মনোনীত করা হয়। দিল্লি হাইকোর্টের যে বিচারপতি আম্বানিদের বিরুদ্ধে সরকারি ফাইল লোপাটের তদন্ত আটকেছেন তিনি অবসর নিয়েই আর্থিক দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলার অ্যাপেলেট ট্রাইবুনালের প্রধান হলে প্রশ্ন না উঠে পারে কি? যখন সরকারের অন্যায় কাজের বিরুদ্ধে দৃঢ়তা দেখানো বিচারপতি এ এ কুরেশি, তাহিলরামানি, কে এম জোসেফের ক্ষেত্রে হয় তাঁদের প্রমোশন নিয়ে টালবাহানা চলে অথবা ঠেলে দেওয়া হয় কম গুরুত্বের হাইকোর্টে, প্রশ্ন কি উঠবে না? দিল্লি হাইকোর্টের বিচারক দাঙ্গার প্রশ্নে সরকারের বিরুদ্ধে রায় দিতে পারেন এই ইঙ্গিত পেয়েই রায়দানের ঠিক আগে মধ্যরাতে তাঁকে বদলি করে দিলে, প্রশ্ন না ওঠাটাই কি অস্বাভাবিক নয়! কিছু সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে (এমনকী সাম্প্রদায়িক উস্কানির অভিযোগও) কেন্দ্রীয় সরকার এবং শীর্ষ আদালত বাকস্বাধীনতার প্রশ্ন তুলে তাঁদের সুরক্ষা দেয়, আর একদল সাংবাদিকের বিরুদ্ধে প্রাণনাশের হুমকি, পুলিশি জুলুম, এফআইআর ইত্যাদি থেকে তাঁদের রক্ষা করার প্রশ্নে আদালত বাকস্বাধীনতার কথা শুনতেই চায় না। এর মধ্যে প্রথমোক্ত দল যদি হয় সরকারের স্তাবক সাংবাদিককুল, আর দ্বিতীয় অভাগাজনরা সকলেই সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছেন। এ কি নিছক কাকতালীয় ঘটনা? প্রশ্ন তোলা কি অপরাধের?
বিচারপতি অরুণ মিশ্র যিনি প্রশান্ত ভূষণ মামলা এতদিন পরিচালনা করছিলেন, তিনি নিজেই ২০১৯-এর এপ্রিল মাসে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের বিরুদ্ধে ওঠা যৌন হেনস্থার মামলা শুনতে গিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, ধনী এবং ক্ষমতাশালীরা সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরপর ৬টি মামলা একই বিচারপতির কাছে হওয়া এবং সবকটিতে তাদের পক্ষে রায় যাওয়া নিয়ে দেশের বর্ষীয়ান সাংবাদিকরাও সুনির্দিষ্ট কিছু প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের আরও প্রশ্ন, আসন্ন সপ্তম মামলাটিও কি একই ভাবে আদানিদের পক্ষে লাভজনক হবে? (নিউজ ক্লিক, ৭ আগস্ট ২০২০) আদালতের উপর ন্যস্ত গুরুদায়িত্ব নিয়ে প্রশ্নের কোনও অবকাশ নেই এ কথা কি বলা যায়? এমনকি সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন চারজন বর্ষীয়ান বিচারপতি ২০১৬ সালের ১২ জানুয়ারি নজিরবিহীন এক সাংবাদিক সম্মেলনে সুপ্রিম কোর্টের কাজকর্মে স্বচ্ছতার অভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছিলেন। গণতন্ত্রের স্বার্থে বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা রক্ষা অত্যন্ত জরুরি। তাঁরা মুখ খুলতে বাধ্য হচ্ছেন, না হলে দেশের মানুষ বলবে সকলেই তাদের বিবেক বিক্রি করে দিয়েছে। তাঁরা প্রশ্ন তুলেছিলেন, যে মামলাগুলির রায় সরকারের বিপক্ষে গেলে সরকার অস্বস্তিতে পড়তে পারে, সেগুলিকে বাছাই করা বিচারপতিদের এজলাশে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে কেন? সেদিন তাঁরা স্পষ্টই বলেছিলেন, সর্বোচ্চ আদালতের বিশ্বাসযোগ্যতাই ধাক্কা খাচ্ছে (হিন্দু বিজনেস লাইন, ১২.০১.১৮)। দিল্লি হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি এপি শাহ যখন বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের প্রথমিক পদক্ষেপ খুবই রক্ষণশীল। সুপ্রিম কোর্ট এমন ভাবে আচরণ করছে, যাতে তাকে সরকারের থেকে আলাদা করা যাচ্ছে না’ (আনন্দবাজার পত্রিকা ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০)। এই প্রশ্ন কি চাপা দেওয়া চায়? এ দেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় বিচারপতি ও মানুষের অধিকার রক্ষা আন্দোলনের প্রথম সারির ব্যক্তিত্ব ভি আর কৃষiর আয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, আদালতের মর্যাদা রক্ষার কথা বলে আদালত অবমাননা আইনের অপব্যবহার হবেই এবং তাতে আদালতের প্রতি মানুষের অনাস্থা এবং ক্ষোভই বাড়বে। তাতে আদালতের মর্যাদা রক্ষিত হবে না। তাই তিনি ব্রিটিশ আইন কমিশনের সুপারিশের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বলেছিলেন, ভারতেও আদালত অবমাননার আইন থাকাই উচিত নয়। (দ্য প্রিন্ট, ১৭ আগস্ট ২০২০)
যে কথাটি আমরা গণদাবীর পাতায় আগেও বলেছি, বিচার ব্যবস্থা নিরপেক্ষ, এ কথা শুধু বললেই হবে না। তাকে সুনির্দিষ্টভাবে নিরপেক্ষতার প্রমাণও দিতে হবে।আজ বিচারব্যবস্থা প্রায় প্রশাসনের অঙ্গে পরিণত হয়ে পড়ছে। এ বৈশিষ্ট্য প্রকট হয়ে উঠছে বিশ্বের প্রায় সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী দেশে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের অন্যতম স্তম্ভ হিসাবে বিচারব্যবস্থার যতটুকু স্বাধীনতা এবং নিরপেক্ষতা আগে ছিল আজ আর সে পরিস্থিতি ধরে রাখতে তারা পারছে না। ২০১৯-এর জুনে রাশিয়ার সোচিতে অনুষ্ঠিত ‘সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন’ভুক্ত দেশগুলির প্রধান বিচারপতিদের সম্মেলনে ভারতের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি বিচার ব্যবস্থার উপর রাজনৈতিক চাপের কথা নিজে মুখেই তুলে ধরেছিলেন। বুর্জোয়া ব্যবস্থায় যত বেশি বেশি করে পুঁজির কেন্দ্রীকরণ ঘটছে, রাষ্ট্রও তার সমস্ত আপাত গণতান্ত্রিক মুখোশটুকুকেও আর ধারে রাখতে পারছে না। ফ্যাসিবাদের লক্ষণ আজ বুর্জোয়া রাষ্ট্রের সর্বাঙ্গে ফুটে উঠেছে। গণতান্ত্রিক অধিকার, মানুষের সমালোচনার কণ্ঠকে শাসকরা টুঁটি টিপে মারতে চাইছে। বিচারালয়কেও তারা সেই ছাঁচে ঢেলে সাজাতে উদ্যোগী। বিচারপতি ভি আর কৃষ্ণ আয়ার বলেছিলেন, ‘‘…আইনসভার সদস্যদের কেনার সমস্ত সুযোগ যেমন ধনিক শ্রেণির হাতে আছে, তেমনই বিচারক বেছে নেওয়ার ব্যাপারেও তাদের শ্রেণি স্বার্থই কাজ করে। তাই বিচারব্যবস্থা এবং তার পরিচালিত আইনের শাসন উভয়েরই শ্রেণিগত পরিচয় আছে” (পভার্টি অ্যান্ড জুডিসিয়ারি, ভি আর কৃষ্ণ আয়ার, দ্য হিন্দু ২৯ ডিসেম্বর ২০১৩)। প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া শ্রেণির রাষ্টে্রর অংশ হিসাবে ভারতের বিচার ব্যবস্থার এই ক্ষয় আজ প্রায় অবশ্যম্ভাবী। তাই এর মধ্যেও যতটুকু ন্যায় বিচার পাওয়া সম্ভব তাকে রক্ষাই আজ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম দাবি। বিচার পেতে হলেও এই গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে শক্তিশালী করাই একমাত্র রাস্তা।