Breaking News

বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা বিপন্ন প্রশ্ন নিরপেক্ষতা নিয়েও (৩)

দেশের বিচারব্যবস্থা নিয়ে সাম্প্রতিক কালে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই লেখাটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে।

(৩)

আজমের শরিফ, মক্কা মসজিদ, মালেগাঁও বিস্ফোরণ মামলা

২০০৬ সালের ৮ এবং ২৯ সেপ্টেম্বর মহারাষ্টে্রর মালেগাঁওতে এক মসজিদের কাছে বোমা বিস্ফোরণে ৪৯ জন মানুষ নিহত হন। ২০০৭ সালের ১৮ মে হায়দরাবাদের মক্কা মসজিদে, ওই বছরই ১১ অক্টোবর রাজস্থানের আজমের শরিফ দরগায় এবং ২০০৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর গুজরাটের মোদাসাতে বোমা বিস্ফোরণে বহু মানুষ মারা যান। প্রথমে এই বিস্ফোরণের জন্য কিছু মুসলিম সংগঠনকে সরকার দায়ী করলেও পরে তদন্তে উঠে আসে এর পিছনে ছিল ‘অভিনব ভারত’ এবং ‘সনাতন সংস্থা’ নামে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি। এই মামলাগুলির কোনওটিতেই কারও শাস্তি হয়নি। জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ) বাস্তবে কোনও ব্যবস্থা নিতে চায়নি বলেই অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে গেছে। মক্কা মসজিদ মামলায় ‘প্রমাণাভাবে’ সমস্ত অভিযুক্তের বেকসুর খালাসের রায় দেওয়ার পর হায়দরাবাদের এনআইএ কোর্টের বিচারপতি রবিন্দর রেড্ডি পদত্যাগ করেছিলেন। বিচার বিভাগের সাথে যুক্ত বহু মানুষ মনে করেন, তাঁর উপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করে এই রায় দেওয়ানো হয়েছিল। এই মামলা দেখভালের জন্য ৫০ জন সাক্ষী শেষ পর্যন্ত সরে দাঁড়ায়। এত গুরুত্বপূর্ণ একটি মামলায় এনআইএ বিশেষ অফিসার নিয়োগ পর্যন্ত করেনি। তুচ্ছ বিষয়ের একটা মামলার মতো দিশাহীন ভাবে ১১ বছর চলার পর এই মামলায় কিছুই প্রমাণ করা যায়নি (ডেকান ক্রনিকল, ১৭-০৪-২০১৮)।

মালেগাঁও বিস্ফোরণ মামলায় পুলিশ প্রথমে মুসলিম ছাত্র সংগঠন ‘সিমি’কে জড়ালেও হেমন্ত কারকারে নামে এক দৃঢ়চেতা পুলিশ অফিসারের তৎপরতায় বিস্ফোরণে ব্যবহৃত স্কুটারের সূত্র ধরে সনাতন সংস্থার কর্মকর্তা এবং হিন্দুত্ববাদী ছাত্র সংগঠনের নেত্রী প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিস্ট স্কোয়াড (এটিএস)। ২৬ নভেম্বর, ২০০৮ মুম্বই হামলার কিছুক্ষণ আগে কারকারে টিভি সাক্ষাৎকারে জানান, হিন্দুত্বের নাম করে এই সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে জাল গুটিয়ে আনা হচ্ছে, আরও কিছু প্রভাবশালী লোক এই মামলায় গ্রেপ্তার হবেন খুব শীঘ্রই। কিন্তু তিনি আর সময় পাননি। মুম্বই হামলার খবর পেয়েই তিনি কর্মক্ষেত্রে চলে যান। সেখানে বন্দুকবাজদের হামলায় তিনি ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। এই মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, কারণ হেমন্ত কারকারের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটটি নাকি খুঁজেই পাওয়া যায়নি। প্রশ্ন ওঠে আসলের বদলে একটি নকল জ্যাকেট দিয়েই তাঁকে লড়তে পাঠানো হয়েছিল কি না? অরক্ষিত অবস্থায় তাঁকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিল কারা? এই প্রশ্নটাকে কংগ্রেস-বিজেপি-শিবসেনার মতো দলগুলি চিরকালই চাপা দিতে চেয়েছে। কারণ তাদের হিন্দু ভোটব্যাঙ্ক হারানোর আশঙ্কা এর সাথে যুক্ত। ২০০৮-এর অক্টোবরে সাধ্বী প্রজ্ঞা সহ অন্যদের গ্রেপ্তারের পর থেকেই যে তাঁর উপর চাপ আসছিল কারকারে সেটা মুম্বই পুলিশের তৎকালীন কমিশনার জুলিও রিবেইরোকে জানিয়েছিলেন। কারকারে তাঁকে বলেছিলেন, মহারাষ্ট্র সরকারের এক ক্যাবিনেট মন্ত্রী এবং নানা হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী তাঁকে এই মামলা দুর্বল করতে চাপ দিচ্ছে। রিবেইরো স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, সরকারি উকিল নিজেই আদালতে দাঁড়িয়ে অভিযোগ করেছিলেন যে, মামলা নিয়ে ধীরে চলার জন্য সরকারপক্ষ থেকেই চাপ আসছে (ইকনমিক টাইমস, ২০ এপ্রিল ২০১৯)। কারকারের মৃত্যুর ফলে বিস্ফোরণ মামলাগুলি পুরোপুরি গতি হারায়। সেই সময় যিনি মালেগাঁও মামলার পাবলিক প্রসিকিউটর ছিলেন, সেই রোহিনী সালিয়ান এনডি টিভির এক সাক্ষাৎকারে সম্প্রতি জানিয়েছেন, ২০১৫ তে এনআইএ মামলা দুর্বল করার জন্য তাঁকে নানাভাবে চাপ দিতে থাকলে তিনি মামলা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। তিনি আরও বলেছেন, প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরকে যে কোনও চাপ দিয়ে, অত্যাচার করে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়নি, এ বিষয়ে আদালত এবং তিনি সম্পূর্ণ নিশ্চিত (এনডি টিভি, ২১ এপ্রিল ২০১৯)। সেই প্রজ্ঞা সিংহ ঠাকুর ওরফে সাধ্বী প্রজ্ঞা বর্তমানে বিজেপির সাংসদ। তিনি ভোট প্রচারের সময় বলেছিলেন, তাঁর অভিশাপেই হেমন্ত কারকারের মৃত্যু ঘটেছে। যাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদী হামলায় জড়িত থাকার এমন মারাত্মক অভিযোগ আছে সেই সাধ্বী প্রজ্ঞাকেই কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা দপ্তরের উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ করেছিল মোদি সরকার।

সমঝোতা এক্সপ্রেস মামলার রায়

১৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৭, লাহোরগামী সমঝোতা এক্সপ্রেসে বিস্ফোরণ ঘটায় একই হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসবাদী গ্রুপ। ১০ জন ভারতীয় এবং ৪৩ জন পাকিস্তানি নাগরিক নিহত হন। এর পর অন্যতম অভিযুক্ত স্বামী অসীমানন্দ পুলিশের কাছে সমস্ত ঘটনাগুলির পুঙ্খানুপঙ্খ বিবরণ সহ স্বীকারোক্তি দেয় (দ্য হিন্দু, ২২ মার্চ ২০১৯)। এনআইএ আদালতকে জানিয়েছিল, তাদের কাছে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রচুর প্রমাণ আছে। অথচ বিচার শেষে আদালতকে বলতে হয়েছে ‘প্রচুর প্রমাণ’ থাকা সত্ত্বেও এনআইএ-র অনিচ্ছাতেই এই মামলায় কিছুই প্রমাণ করা যায়নি। বিচারক তাঁর রায়ে উল্লেখ করেছেন, সাধারণ ভাবে যে কাজগুলি যে কোনও তদন্তে করার কথা, এমন একটি আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ তদন্তে এনআইএ সেটুকুও করেনি। তারা দিল্লি স্টেশনের সিসি টিভি ফুটেজ বা ওই দিন স্টেশনের ডরমিটরিতে কারা ছিল সেই রেকর্ডটুকুও আদালতে জমা দেয়নি (টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ১ এপ্রিল ২০১৯)। কোনও মামলায় সঠিক ও স্বাধীন তদন্ত এবং যথাযথ বিচার প্রক্রিয়ার পরেও কোনও অভিযুক্ত ছাড়া পেয়ে যাওয়া এক ব্যাপার। আর একের পর এক মামলায় হিন্দুত্ববাদী উগ্রপন্থীদের মারাত্মক অপরাধেরও তদন্তটুকু হচ্ছে না। ক্ষমতাসীন সরকার খোলাখুলি তাদের রক্ষা করতে সচেষ্ট দেখেও আদালত চুপ করে থাকলে তা বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা রক্ষার পক্ষে সহযোগী হয় কি? সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমও প্রশ্ন তুলেছে কাশ্মীরে হেবিয়াস করপাস মামলাগুলি (মানুষের মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত মামলা) শোনার ক্ষেত্রে জম্মু-কাশ্মীর হাইকোর্টের অনীহা বুঝিয়ে দেয় প্রশাসনের উপর রাজনৈতিক চাপের থেকেও তা আদালতের উপর বেশি প্রভাব ফেলছে (ইন্ডিয়ান এ’প্রেস, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৯)। সুপ্রিম কোর্টেও কাশ্মীরের মানবাধিকার এবং ৩৭০ ধারা সংক্রান্ত মামলাগুলি মাসের পর মাস ধরে পড়ে আছে। যে সুপ্রিম কোর্ট রাম মন্দিরের প্রশ্নে অতিদ্রুত বিচারের নজির তৈরি করতে পারে, সেই সুপ্রিম কোর্টই কাশ্মীরের মানুষের যন্ত্রণার কথা শোনার সময় পাচ্ছে না!

স্বজনপোষণ ও বিচারপতি নিয়োগ-ট্রান্সফার ইত্যাদিতে হস্তক্ষেপ

সংবাদমাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছে কিছু ঘটনা। কংগ্রেস নেতা পি চিদম্বরমের আগাম জামিনের শুনানি সুপ্রিম কোর্টে ফয়সলা হওয়ার আগেই তাঁকে গ্রেপ্তার করার জন্য সিবিআইয়ের অস্বাভিক তাড়াহুড়োকে যিনি সাহায্য করেছেন, সেই বিচারপতি সুনীল গাউর এই রায়ের দু’দিন পরেই অবসর নিয়েছেন। তারপরেই তাঁকে সরকার নিয়োগ করেছে আর্থিক কেলেঙ্কারি সংক্রান্ত অ্যাপেলেট ট্রাইবুনালের প্রধান হিসাবে (ইকনমিক টাইমস, ২০.০৮.১৯)। এই বিচারপতি গাউরই মুকেশ আম্বানির মালিকানাধীন রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজের বিরুদ্ধে সরকারি গোপন ফাইল সরানোর অভিযোগে নিম্ন আদালতের তদন্ত আদেশকে বাতিল করে দিয়েছিলেন (দ্য প্রিন্ট, ২৮-০৮-১৯)।

ভারতের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি পি সৎশিবম অবসর নেওয়ার পরেই কেরালার রাজ্যপাল নিযুক্ত হন। তিনি বিজেপি-নেতা তথা বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এফআইআর বাতিল করার রায় দিয়েছিলেন। তিনি সাংবাদিক সম্মেলন করে এই এফআইআর বাতিলের সাথে রাজ্যপাল পদ লাভের কোনও সংযোগ থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। কিন্তু বিচারপতিদের ‘কোড অফ কন্ডাক্ট’ বলছে, বিচারের রায়ই তাঁদের হয়ে কথা বলবে। সাংবাদিক সম্মেলন কর়ে বোঝানোর প্রয়োজন তাঁদের নেই (এনডি টিভি ২-০৯-১৪)।

আবার অন্য দিকে সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণতম বিচারপতিদের নিয়ে গঠিত কলেজিয়ামের সুপারিশ অগ্রাহ্য করে বোম্বে হাইকোর্টের বিচারক এ এ কুরেশিকে মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি করতে কেন্দ্রীয় সরকার অস্বীকার করছে। কারণ বিচারপতি কুরেশি বর্তমান কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের মতো প্রভাবশালীকে ভুয়ো সংঘর্ষ মামলায় কিছুদিন হলেও জেল খাটানোর সাহস দেখিয়েছেন (দ্য ওয়্যার ২১-০৬-১৯)। মাদ্রাজ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ভি কে তাহিলরামানিকে অপেক্ষাকৃত ছোট হাইকোর্টে ট্রান্সফার করার চেষ্টা কলেজিয়ামকে দিয়ে করিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। একজন অত্যন্ত সিনিয়ার বিচারপতি হওয়া সত্তে্বও তাঁকে এভাবে ট্রান্সফার করার প্রতিবাদে তিনি পদত্যাগ করেছেন। উল্লেখ্য, বিচারপতি তাহিলরামানি বোম্বে হাইকোর্টের বিচারপতি থাকাকালীন ২০০২-এর গুজরাট গণহত্যার সময় ঘটা বিলকিস বানো গণধর্ষণ মামলায় বিজেপির মদতপুষ্ট খুনে বাহিনীর ১১ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের ব্যবস্থা করেছিলেন (দ্য টেলিগ্রাফ, ২৮.০৯.১৯)।  (চলবে)

(গণদাবী : ৭২ বর্ষ ৩২ সংখ্যা)