দেশের বিচারব্যবস্থা নিয়ে সাম্প্রতিক কালে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠছে।
সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই লেখাটি ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে
(২)
সাম্প্রতিক আরও কিছু প্রশ্ন
কাশ্মীরের মানুষের উপর সরকার যেভাবে নানা দমনমূলক ব্যবস্থা চাপিয়ে দিয়েছে, তার প্রতিকারের আশায় একের পর এক মামলা সুপ্রিম কোর্টে এসেছে। ৩৭০ ধারা বাতিল সাংবিধানিক কি না, এ বিষয়ে অনেকগুলি মামলা হয়েছে। অথচ ৭ মাসের বেশি সময় ধরে সুপ্রিম কোর্টে তার শুনানিই হয়নি! তিনজন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সহ প্রায় ৪০০ জনের বিরুদ্ধে বিনাবিচারে আটক রাখার পিএসএ আইন প্রয়োগ করেছে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলা কাশ্মীরের প্রশাসন। ৫ হাজারের বেশি মানুষ মাসের পর মাস বিনা বিচারে বন্দি। জম্মু-কাশ্মীর হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্ট সেই সব মামলা দ্রুত শোনার কোনও আগ্রহই দেখাচ্ছে না। আদালতের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে শবরীমালা মন্দিরের মামলা। কাশ্মীরের প্রশ্নে হেবিয়াস করপাস মামলাতেও সুপ্রিম কোর্ট অত্যন্ত নরম ভূমিকা নিয়েছে। কাশ্মীরের প্রাক্তন বিধায়ক ইউসুফ তারিগামিকে বেআইনিভাবে আটক রাখার বিরুদ্ধে করা হেবিয়াস করপাস মামলায় আবেদনকারীর অধিকার মেনে তাঁকে আদালতে হাজির করতে পুলিশকে নির্দেশ দেয়নি আদালত। বদলে তাঁর দলের সাধারণ সম্পাদককে পুলিশি পাহারায় এবং মুখ বুজে থাকার শর্তে একদিনের জন্য কাশ্মীরে গিয়ে দেখা করার অনুমতি দিয়েছে মাত্র।
২০১৯-এর নভেম্বর মাসে এক সপ্তাহে চারটি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠেছে। একদিকে আদালত আপাতভাবে আইন ও নিরপেক্ষ বিচারের কথা বলেছে, কিছু ক্ষেত্রে বিজেপি সরকারের সমালোচনাও করেছে, অথচ দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রীয় শাসক দলই মুচকি হাসছে। এমনিতেই ২০১৪ থেকে বিজেপি কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সর্বব্যাপক দাপট দেখা যাচ্ছে। বিজেপি নানা রাজ্যে ক্ষমতা দখলের জন্য নীতি-নৈতিকতার বালাইটুকুও রাখছে না। এই পরিস্থিতিতে পরপর এই মামলাগুলির রায় বহু মানুষকে ভাবিয়েছে। প্রথমত, ৯ নভেম্বর ২০১৯ রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদের মামলায় সর্বোচ্চ আদালত হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাস এবং পৌরাণিক কাহিনীকেই সব কিছুর উপরে বসিয়ে দিয়েছে। পাঁচ বিচারপতির মধ্যে কোনও একজন সংযোজনী হিসাবে রাম মাহাত্মে্যর বর্ণনা করেছেন (মূল রায় এবং সংযোজনীর লেখকের নাম আদালত জানায়নি), যা আদালতের বিচারপ্রক্রিয়ার অংশ হতে পারে না। অন্যদিকে আদালত ১৯৯৪ সালে দেওয়া সুপ্রিম কোর্টেরই দেওয়া রায়কে লঙ্ঘন করে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানকে জমির মালিকানা সংক্রান্ত মামলায় টেনে এনেছে। একই সাথে মেনে নিয়েছে মসজিদের সংলগ্ন জমিতে কিছু পুরনো স্থাপত্যের চিহ্ন থাকলেও তা যে হিন্দু মন্দিরই ছিল তা নিশ্চিত নয়। আদালত আরও মেনে নিয়েছে ১৯৪৯ সালে গোপনে মসজিদের মধ্যে মূর্তি বসিয়ে দিয়ে আসা এবং ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙা, দুটিই বেআইনি এবং অন্যায় কাজ হয়েছে। কিন্তু তারপরেও রামভক্তদের বিশ্বাসের কথা বলে ওই ভাঙা মসজিদের জমিতেই মন্দির গড়ার জন্য কেন্দ্রকে ট্রাস্ট গড়ে দিতে বলেছে। ভারসাম্যের কারণ দেখিয়ে মুসলিমদের অন্য কোনও জায়গায় ৫ একর জমি দিয়ে ক্ষোভ চাপা দিতে চেয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের একটা অংশের বিশ্বাসই কি সব কিছুর উর্ধ্বে? প্রশ্ন উঠছে, বাবরি মসজিদ ভাঙা না হলে কি আদালত রায় দিত যে, মসজিদ ভেঙেই মন্দির গড়া হোক (ফ্রন্টলাইন, ৬ ডিসেম্বর ২০১৯)?
লক্ষণীয়, কেন্দ্রীয় শাসক দলের একাধিক নেতা এমনকি দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যন্ত বলে বেড়াচ্ছেন, বিজেপি কেন্দ্রীয় সরকারে থাকাতেই এই রায় সম্ভব হয়েছে (টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ২২ নভেম্বর ২০১৯)। আর একটি রায়ে সুপ্রিম কোর্ট রাফাল মামলায় দুর্নীতি হয়েছে কিনা তার বিচার করতেই রাজি হয়নি। যদিও বিচারপতি জোসেফ কুরিয়ান তাঁর আলাদা রায়ে বলেছেন, চাইলে সিবিআই বা কোনও তদন্তকারী সংস্থা রাফাল বিমানের দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করতেই পারে। আদালতের রায় তাতে বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না। কিন্তু এমনিতেই সরকারের খাঁচার তোতা বলে পরিচিত সিবিআই সরকারের সর্বোচ্চ স্তরের বিরুদ্ধে তদন্ত করবে, আজকের ভারতে সে আশা বৃথা। ফলে সুবিধা দেখছে বিজেপি। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল, বিচারপতি জোসেফ কুরিয়ানের সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগ আটকাতে বহু চেষ্টা করেছিল বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার।
তৃতীয় ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট তার আগেকার অবস্থান থেকে সরে এসে শবরিমালা মন্দিরে ১২ থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত মহিলাদের ঢোকার পক্ষে রায় পুনর্বিবেচনার জন্য সাত বিচারপতির বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করার কথা বলেছে। একই সাথে সেই বেঞ্চ জানিয়ে দিয়েছে তারা মুসলিম, পারসি, দাউদি বোহরাদের মতো ধর্মে নারীর অধিকারের প্রশ্নও বিচার করবে। হিন্দু ধর্ম সংক্রান্ত বিতর্কের মামলায় অন্য ধর্ম সম্প্রদায়কে টেনে আনাকে এই সম্প্রদায়গুলির বহু মানুষ অযৌক্তিক বলে মনে করছেন। যদিও এতে হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলি যথেষ্ট উৎসাহিত।
চতুর্থ মামলাটিতে কর্ণাটকের ১৭ জন এমএলএ-র সদস্যপদ বাতিলের জন্য স্পিকারের সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে জানিয়েও সর্বোচ্চ আদালত তাদের ভোটে লড়ার অনুমতি দেয়। তারপরেই তাদের ১২ জনই বিজেপির হয়ে উপনির্বাচনে জিতেও যান। অথচ কর্ণাটকে কংগ্রেস-জেডিএস কোয়ালিশন ভাঙতে যে টাকার খেলা হয়েছে তা আজ কারও অজানা নয়। বিজেপি এদের অনেক টাকার বিনিময়ে এবং মন্ত্রীত্বের প্রলোভন দিয়ে কিনেছিল বলে সমস্ত সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে। এই কেনাবেচার পিছনে কাজ করেছে খনি মাফিয়াদের টাকার থলি। এই এমএলএরাও তা পুরোপুরি অস্বীকার করেননি। কিন্তু অনৈতিক কার্যকলাপের জন্য স্পিকার বর্তমান বিধানসভার পূর্ণ মেয়াদ পর্যন্ত এই ১৭ এমএলএ-র সদস্যপদ খারিজ করে দেওয়ায় বিজেপি এদের মন্ত্রী বানাতে পারেনি। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তাদের সে বাধা দূর হয়েছে। একদিকে সর্বোচ্চ আদালত স্পিকারের সিদ্ধান্ত এবং নৈতিকতাকে মান্যতা দিল, অন্যদিকে বিজেপি যা চাইছিল তাই হতে পারল একই রায়ে (টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ১৭ নভেম্বর ২০১৯)।
২৭ বছরেও বাবরি মসজিদ ভাঙার কোনও শাস্তি হল না
১৯৯২ সাল থেকে চলছে বাবরি মসজিদ ভাঙার মামলা। ৪০০ বছরের পুরনো একটি ‘হেরিটেজ’ স্থাপত্য ভাঙার শাস্তি ভারতীয় দণ্ডবিধিতে যথেষ্ট কড়া। কিন্তু সে আইন প্রয়োগ করবে কে? বিজেপি সরকার তো করবেই না, হিন্দু ভোটব্যাঙ্কে ক্ষতির আশঙ্কায় কংগ্রেসও তা করেনি। এই মামলার অন্যতম আসামী লালকৃষiর আদবানি, মুরলি মনোহর যোশী, উমা ভারতী, অটল বিহারি বাজপেয়ী, অশোক সিঙ্ঘল সহ আরও সব তাবড় সংঘপরিবার-বিজেপি নেতা। লিবেরহান কমিশন সুস্পষ্টভাবে বাবরি মসজিদ ধ্বংসকে একটি পরিকল্পিত ঘটনা এবং এর ধ্বংসের জন্য এই নেতাদের দায়ী করা সত্ত্বেও নিম্ন আদালত সকলকেই বেকসুর খলাস করে দেয়। হাইকোর্টও এই রায় বজায় রাখে। সাধারণত কোনও একটি জমি নিয়ে ফৌজদারি এবং দেওয়ানি মামলা চললে ফৌজদারি মামলার বিচার আগে হয়। কিন্তু ফৌজদারি বিচারের আগেই সুপ্রিম কোর্টের রায়ে জামির অধিকার পেয়ে গেল যারা, অভিযুক্ত তারাই। ফলে এই মামলার আর কোনও মানেই থাকল না। সুপ্রিম কোর্ট যদিও বলে দিয়েছে ২০২০ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যে এই মামলার নিষ্পত্তি করতে হবে। কিন্তু ২১ জন আসামীর ৮ জন এখন মৃত। আদবানির বয়স ৯২। অন্যদেরও যথেষ্ট বয়স হয়েছে। ফলে এঁদের জীবৎকালে এই মামলার ফয়সলার আশা করছেন না কেউই।
সোহরাবুদ্দিন ভুয়ো সংঘর্ষ মামলা
২০০৫-‘০৬ সালের গুজরাট পুলিশের হাতে ভুয়ো সংঘর্ষে নিহত হয়েছিলেন শেখ সোহরাবুদ্দিন, তাঁর স্ত্রী কওশর বাই এবং তুলসিরাম প্রজাপতি। ২০১৮ সালে সেই মামলার রায় দিতে গিয়ে বিচারপতি এস জে শর্মাকে বলতে হয়েছে, এর স্বপক্ষে প্রায় কোনও প্রমাণই তদন্তকারীরা পেশ করেনি। সব বুঝেও অপরাধীদের শাস্তি দিতে না পারার যন্ত্রণায় বিচারককে বলতে হয়েছিল, ‘সোহরাবুদ্দিন শেখ এবং তুলসিরাম প্রজাপতির পরিবার, বিশেষত তার মা নর্মদাবাইয়ের জন্য আমি গভীর দুঃখ অনুভব করছি’ (দ্য ওয়্যার ২৯.১২.১৮)। অথচ সিবিআই তাদের চার্জশিটে এই হত্যাকাণ্ডকে ভুয়ো সংঘর্ষে খুন বলেই স্বীকার করেছে। এমনকি গুজরাট পুলিশের প্রায় দশজন অফিসার এবং সেই সময় বিজেপির রাজ্য সরকারের এক প্রভাবশালী মন্ত্রী জেলেও গিয়েছিলেন। কিন্তু চিত্রটা বদলে যায় ২০১৪ সালের মে মাসে বিজেপি কেন্দে্র ক্ষমতা দখলের পর।
২০ জুন ২০১৪ ছিল বিজেপির ক্ষমতা-কেন্দে্রর দ্বিতীয় ব্যক্তিটির আদালতে সশরীরে হাজিরার দিন। কিন্তু তিনি কোনও কারণ না দেখিয়েই হাজিরা দেননি। বিচারপতি উটপট এতে উষ্মা প্রকাশ করে ২৬ জুন তাঁকে হাজিরা দিতেই হবে বলে কড়া নির্দেশ দেন। কিন্তু আকস্মিকভাবে ২৫ জুন বিচারপতি উটপটকে পুনায় বদলি করে দেওয়া হয়। অথচ ২০১২ সালে সর্বোচ্চ আদালত এই মামলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একই বিচারককে বহাল রাখার নির্দেশ দিয়েছিল। পরবর্তী বিচারক বিএইচ লোয়া দায়িত্ব নিয়েই এই মামলায় আগের বিচারকের মতোই কড়া অবস্থান নিয়ে বিজেপির সেই প্রভাবশালী নেতাকে হাজিরা দিতেই হবে বলে নির্দেশ দেন। ১৫ ডিসেম্বর সেই হাজিরার দিন ঠিক হয়। কিন্তু ১ ডিসেম্বর বিচারপতি লোয়ার আকস্মিক এবং রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে। তাঁর পরিবার এই মৃত্যু স্বাভাবিক নয় বলে দাবি করে। বিচারপতি লোয়ার বোন অভিযোগ করেন, বোম্বে হাইকোর্টের এক বিচারপতির মাধ্যমে বিচারপতি লোয়াকে এই মামলা মিটিয়ে নিতে ১০০ কোটি টাকা ঘুষের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। মৃত্যুর সাতদিন আগে বিচারপতি লোয়া পরিবারের সদস্যদের কাছে এই ঘটনাটি বলে তাঁর জীবনের আশঙ্কা আছে বলে উল্লেখ করেছিলেন। তাঁর বাবাও একই অভিযোগ তুলছিলেন (ক্যারাভান পত্রিকা, ২১.১১.২০১৭)। এই ঘটনার যথাযথ তদন্ত হয়নি। বিচারপতি লোয়ার মৃত্যুর ঘটনায় কোনও অস্বাভাবিকতা নেই বলে রায় দিয়েছিলেন যে বিচারপতি, তাঁকে অতি দ্রুত সুপ্রিম কোর্টে প্রোমোশন দিতে কেন্দ্রীয় সরকার উদ্যোগী হয় (এনডি টিভি ২৭.১০.২০১৭ এবং টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ১০.০৫.২০১৯)। বিচারপতি লোয়ার জায়গায় যাঁকে বসানো হয়, সেই বিচারপতি গোসাভি বিজেপির সেই প্রভাবশালী মন্ত্রী সহ সমস্ত অভিযুক্তকে নিঃশর্তে মুক্তি দিয়ে দেন। চার্জশিট হয়ে যাওয়ার পরেও কোনও প্রমাণ দাখিল এবং শুনানি ছাড়াই একতরফা ভাবে সবার মুক্তি মিলে যায় (দ্য স্ক্রোল, ২৯.১২.২০১৮)। পরবর্তী বিচারক এস জে শর্মার সামনে এই মামলার ইতি টানা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। যা দেখে এই মামলার তদন্তকারী অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার ভিএল সোলাঙ্কি বলেছিলেন, ‘ভারতে কোনও বিচার নেই'(দ্য ক্যারাভ্যান ম্যাগাজিন, ২১.০৯.২০১৮)। (চলবে)