দিল্লি যখন জ্বলল, একের পর এক মৃত্যুর খবর এল, চলল অবাধ লুঠপাট, যখন হাজার হাজার মানুষ তাঁদের দোকান, সম্পত্তি এমনকি মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও হারাল, সেই সময় পুলিশ কী করল? হত্যালীলার গুজরাট মডেল অনুসরণ করে বিজেপি পরিচালিত পুলিশ বাহিনী হয় হাত গুটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল, না হয় সরাসরি নিধন যজ্ঞের অংশীদার হল। অসহায় মানুষ যখনআহতদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে গিয়ে দাঙ্গাকারীদের বাধা পেয়ে পুলিশের সাহায্য চাইল, পুলিশ তখনও নির্বিকার থাকল! সেই দুঃসময়ে অসহায় মানুষ কোনও সুরাহা না পেয়ে যদি ছুটে যায় কোনও হাইকোর্টের বিচারপতির বাসভবনে, আকুল আবেদন জানায় আহতদের রক্ষা করতে পুলিশকে নির্দেশ দিন! দায়িত্ববোধ সম্পন্ন কোনও বিচারকের কর্তব্য কী? তিনি কি নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশকে নির্দেশ দেবেন না, এই মানুষগুলিকে রক্ষার দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে?
ঠিক এই কাজটিই করেছিলেন দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি এস মুরলীধর। ২৪ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে তাঁর বাসভবনে ছুটে যাওয়া আক্রান্ত মানুষের রক্ষাকর্তা হয়ে উঠেছিলেন তিনি। রাত ১২টা থেকে ২টো পর্যন্ত শুনানি চালিয়ে তিনি পুলিশকে নির্দেশ দেন অবিলম্বে আহতদের উপযুক্ত হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তার পরের দিন হাইকোর্টের এজলাসে বসে তিনি কড়া নির্দেশ দেন, দিল্লিতে গণহত্যায় ইন্ধন দেওয়ার জন্য যারা বিদ্বেষ ছড়িয়েছে, সেই বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র, অনুরাগ ঠাকুর সহ সকলের বিরুদ্ধে ২৪ ঘন্টার মধ্যে পুলিশকে এফআইআর দায়ের করতে হবে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, পুলিশ কি দিল্লি পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার পর সক্রিয় হওয়ার সময় পাবে?
এর ফল কী দাঁড়িয়েছে তা দেশের মানুষের জানা। ২৫ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে বিচারপতি মুরলীধরের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল শাস্তিমূলক বদলির নির্দেশ। তাঁকে এমনভাবে পাঞ্জাব-হরিয়ানা হাইকোর্টে বদলি করা হল যাতে সিনিয়রিটি থাকলেও তিনি কোনও দিন সেখানকার প্রধান বিচারপতি হতে না পারেন। রাষ্ট্রপতি ভবন ও সরকারের এই মাঝরাতের অতি সক্রিয়তা কাদের বাঁচাতে তা নিয়ে দেশের মানুষের কোনও সন্দেহ নেই। দেশ আরও দেখেছে বিচারপতি মুরলিধরের মতো নিরপেক্ষ ও দৃঢ় বিচারকের অনুপস্থিতিতে পুলিশ কার্যত দাঙ্গার মূল চক্রান্তকারীদের বিরুদ্ধে এফআইআরের দায় থেকে রেহাই পেয়ে গেল। যাদের জন্য এই ভয়াবহ দাঙ্গায় প্রথম চারদিনেই ৪২ জনেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারালেন, শত শত মানুষ মারাত্মক আহত হলেন, সেই বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে এফআইআর করার নাকি পরিবেশই নেই! পুলিশের এই ছেঁদো যুক্তিকেই মান্যতা দিয়ে তাদের একমাস দেরি করার সুযোগ দিয়েছে দিল্লি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৮.০২.২০২০)। বিশিষ্ট আইনজীবী দুষ্মন্ত দাভে বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়াম সুপারিশ করলেও যে ভাষায় কোনও সময় না দিয়ে তাঁকে সরে যেতে বাধ্য করেছে সরকার তা বিশ্বাসঘাতকতার সামিল। এর মধ্য দিয়ে দিল্লি দাঙ্গার পিছনে ইন্ধন দাতাদের বিরুদ্ধে সঠিক তদন্ত এড়িয়ে যাওয়ার পথ করে নিল সরকার (ইকনমিক টাইমস ২৮.০২.২০২০)।
ভারতে বিচারবিভাগের স্বাধীনতা যে কতটা বিপন্ন তা এই ঘটনায় ফের প্রকটভাবে ফুটে ওঠে। ঠিক এই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন দিল্লি হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এপি শাহ। তাঁর উদ্বেগ, সরকার এবং প্রশাসনের সাথে এক হয়ে যাচ্ছে ভারতীয় বিচারব্যবস্থা। সম্প্রতি দিল্লিতে এল সি জৈন স্মারক বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আদালতের আত্মসমীক্ষা করা দরকার’। কাশ্মীরে মানুষের অধিকার খর্বের প্রশ্নে, অযোধ্যা রায় এবং সিএএ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেছেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের প্রথমিক পদক্ষেপ খুবই রক্ষণশীল। সুপ্রিম কোর্ট এমন ভাবে আচরণ করছে, যাতে তাকে সরকারের থেকে আলাদা করা যাচ্ছে না’ (আনন্দবাজার পত্রিকা ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২০)। তাঁর বক্তব্য, প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, আসামের ডিটেনশন শিবিরে মাত্র ৯০০ জন কেন, ‘এ কথা শোনার পরেও কি বিশ্বাস করা যায়, এই আদালত মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য?'(ওই)
এই পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্টের তৃতীয় সিনিয়র বিচারপতি অরুণ মিশ্র সুপ্রিম কোর্ট আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির স্তুতিতে বলেন, ‘আন্তর্জাতিকভাবে দূরদর্শী নেতা’, ‘যিনি বিশ্ব জুড়ে চিন্তা করেন, কাজ করেন দেশের জন্য’, ‘এমন এক বিশিষ্ট নরদেহধারী মানুষ’ (ডিগনিফায়েড হিউম্যান একজিস্টেন্স), ‘মহাপ্রতিভাধর’ ইত্যাদি। এই ‘অস্বাভাবিক’ প্রশংসাকে সঠিক বলে মানতে পারেন নি সুপ্রিম কোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশনও। তারা স্পষ্ট বলেছে, বিচারপতি মিশ্রের এই প্রশংসা স্বাভাবিক সৌজন্যকে ছাপিয়ে গেছে। সংগঠনের বক্তব্য, বহু মামলায় কেন্দ্রীয় সরকার বাদী বা বিবাদী পক্ষ হিসাবে সুপ্রিম কোর্টে লড়ে, সেখানে প্রশাসনের কর্তাদের প্রতি এমন ভক্তির প্রকাশ বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা এবং স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের বিশ্বাসকে টলিয়ে দেবে (টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ২৬.০২.২০২০)।
ভারতে আজ মানুষের প্রতিবাদের অধিকার, ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার, বাকস্বাধীনতার অধিকারের মতো নূ্যনতম গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি দেশজুড়ে চলা সিএএ বিরোধী আন্দোলনের প্রতি সরকারের দমন মূলক নীতি, প্রতিবাদকারীদের ‘দেশদ্রোহী’, ‘পাকিস্তানের দালাল’ বলে দাগিয়ে দেওয়ার কাজে কেন্দ্রীয় সরকারের সর্বোচ্চ নেতা থেকে শাসক দলের সমস্ত স্তরের নেতা কর্মীরা নিযুক্ত। বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠীই যে অশান্তি সৃষ্টিকারী, খোদ প্রধানমন্ত্রী পোশাক দেখেই তা চিহ্নিত করে ফেলছেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাহীন বাগের প্রতিবাদীদের কারেন্ট লাগিয়ে মারতে চাইছেন।
এই প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের একটি মন্তব্য। তিনি গুজরাটের একটি অনুষ্ঠানে বিরুদ্ধ মতের অধিকার রক্ষার কথা তুলে ধরে বলেন, ‘বিরোধিতা হল গণতন্ত্রের রক্ষাকবচ (সেফটি ভালভ)। বলেন, ‘গণতন্তে্র সংখ্যালঘুর কণ্ঠরোধ করা যায় না।’ ‘বৈধ সরকার রাজনৈতিক বিরোধিতার উপর নিষেধাজ্ঞা চাপায় না। বরং তাকে স্বাগত জানায়’। ‘বাকস্বাধীনতা রক্ষা করাই রাষ্ট্রযন্ত্রের কাজ হওয়া উচিত। ভীতি ছড়িয়ে বাকস্বাধীনতার অধিকার হরণের চেষ্টা করা হলে রাষ্ট্রযন্তে্রর উচিত সেই চেষ্টার বিরোধিতা করা’ (আনন্দবাজার পত্রিকা,১৬.০২.২০২০)। ওই একই দিনে সামনে আসে বম্বে হাইকোর্টের বিচারপতি টিভি নালাভাদে এবং এমজি শেউলিকরের ডিভিশন বেঞ্চের রায়। তাঁরা বলেছেন, ‘মনে রাখতে হবে আমরা গণতান্ত্রিক দেশে বাস করি। আমাদের সংবিধানে আইনের শাসনের কথা আছে, সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের কথা নেই।’ আরও বলেছেন, ‘সিএএ-র মতো আইন তৈরি হলে মুসলিমদের মতো কোনও একটি সম্প্রদায়ের মানুষ ভাবতেই পারেন যে, ওই আইন তাঁদের স্বার্থবিরোধী। তাই ওই আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা প্রয়োজন। সেটা সেই সম্প্রদায়ের ধারণা বা বিশ্বাসের প্রশ্ন। তা নিয়ে আদালত মাথা ঘামাবে না।’ বিচারপতিরা বলেছেন, কেউ সরকারের আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই তাঁকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বা ‘দেশদ্রোহী’ বলা যায় না। (এনডি টিভি, ১৫.০২.২০২০)।
কথাগুলি আজকের পরিস্থিতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এর প্রতিফলন সামগ্রিকভাবে বিচার বিভাগের কাজে দেখা যাচ্ছে কি? বিচারবিভাগ যে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারছে না এ কথা আজ আর অস্বীকার করা যাচ্ছে না।
২০১৬ সালের ১২ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন চার প্রবীণ বিচারপতি জে চেলমেশ্বর, রঞ্জন গগৈ, মদন লোকুর এবং কুরিয়েন জোসেফ নজিরবিহীন এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন, গণতন্তে্রর স্বার্থে বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা রক্ষা অত্যন্ত জরুরি। তাঁরা মুখ খুলতে বাধ্য হচ্ছেন, না হলে দেশের মানুষ বলবে সকলেই তাদের বিবেক বিক্রি করে দিয়েছে। তাঁরা প্রশ্ন তুলেছিলেন, যে মামলাগুলির রায় সরকারের বিপক্ষে গেলে সরকার অস্বস্তিতে পড়তে পারে, সেগুলিকে ‘বাছাই করা’ বিচারপতিদের এজলাসে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে কেন? সেদিন তাঁরা স্পষ্টই বলেছিলেন, সর্বোচ্চ আদালতের বিশ্বাসযোগ্যতাই ধাক্কা খাচ্ছে। (হিন্দু বিজনেস লাইন, ১২.০১.১৮)।
অতি সাম্প্রতিক কালে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিএএ নিয়ে আদালতের ভূমিকাতেও এই প্রশ্ন উঠেছে। সারা দেশে যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ এই আইনের বিরুদ্ধে রাস্তায় রাত জাগছে, মায়েরা শিশুসন্তান কোলে শীতের রাতে খোলা মাঠের অবস্থানে যোগ দিচ্ছেন, দিল্লির খোলা মাঠের ঠাণ্ডা সহ্য করতে না পেরে প্রতিবাদী মায়ের কোল খালি করে শিশু ঢলে পড়ছে মৃত্যুর করাল গ্রাসে, তবু মা অনড়– ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকদের আলাদা করতে দেব না এই দাবিতে। ইতিমধ্যে ৩১ জন মানুষের মৃত্যু ঘটেছে এই আন্দোলনের উপর পুলিশের আক্রমণে। দেশের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের উপর পুলিশ এবং বিজেপি-আরএসএস বাহিনী আক্রমণ চালিয়েছে। উত্তরপ্রদেশের কবি ইমরান প্রতাপগড়িকে ১ কোটি ৪ লক্ষ টাকা জরিমানা করেছে ওই রাজ্যের পুলিশ। তাঁর অপরাধ তিনি সিএএ-র বিরুদ্ধে মোরাদাবাদে শান্তিপূর্ণভাবে ধরনার ডাক দিয়েছিলেন। সারা দেশেই সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের এক অভূতপূর্ব জোয়ার উঠেছে। অর্থাৎ এটাই এই মুহূর্তে দেশের মানুষের সামনে প্রধান সমস্যা হিসাবে উঠে এসেছে। অথচ এই পরিস্থিতিতে সিএএ সংক্রান্ত ১৪৪টিরও বেশি আবেদন জরুরি ভিত্তিতে শুনতে চায়নি সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপতি বলে দিয়েছেন, আগে শান্তি ফিরুক তারপর এই মামলা শোনা যাবে। প্রশ্ন উঠেছে কোনও চিকিৎসক কি বলতে পারেন, আগে রক্তপাত থামুক তারপর আমি রোগী দেখব? অথচ এই আদালতই টাটা সনসের মালিকানার প্রশ্নে ন্যাশনাল কোম্পানি ল ট্রাইবুনালের রায়ের উপরে মাত্র কয়েক মিনিটে স্থগিতাদেশ দেওয়ার নজির রেখেছে।
দিল্লিতে জামিয়ার ছাত্রদের উপর পুলিশি নির্যাতনের প্রতিকার চেয়ে ছাত্ররা সুপ্রিম কোর্টে গেল তাদের কথা আদালত শুনতে রাজি হয়নি। অন্যদিকে একই সময়ে দিল্লি জুড়ে জননিরাপত্তা আইন (পিএসএ) জারি করে মানুষের প্রতিবাদের অধিকার, গ্রেপ্তার হলে ন্যায় বিচারের অধিকার, এমনকি জীবনের অধিকার সরকার কেড়ে নিলে কার্যত সুপ্রিম কোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ তাকেই সমর্থন করে বলেছে ‘তারা সরকারের হাত পা বেঁধে দিতে পারে না।’। জনগণের হাত বাঁধার সময় আদালত তা বলতে পারল না! (চলবে)