বিচারবিভাগের স্বাধীনতা শাসক দলের, সরকারের হস্তক্ষেপ মুক্ত বিচারব্যবস্থা এগুলি যে আজ পুরোপুরি অতীতের বিষয়, তা আবার প্রকট হয়ে উঠল৷
বিচারপতি নিয়োগের জন্য সুপ্রিম কোর্টের সব থেকে প্রবীণ পাঁচ বিচারপতিকে নিয়ে তৈরি কলেজিয়ামের সুপারিশকে বাজে কাগজের ঝুড়িতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার৷ উত্তরাখণ্ড হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি কে এম জোসেফকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি পদে নিয়োগের সুপারিশকে সরকার বাতিল করে দিয়েছে৷ এই সুপারিশ ফেরত পাঠানোর আগে প্রধান বিচারপতির মত নেওয়ার মতো সৌজন্যটুকুও দেখায়নি বিজেপি সরকার৷ আইন অনুসারে বিচারপতি নিয়োগের ব্যাপারে কলেজিয়ামের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত৷ এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকার তার মত সুপ্রিম কোর্টের উপর চাপিয়ে দিতে পারে না৷
এই ঘটনার কিছুদিন আগে সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ দুই বিচারপতি জে চেলমেশ্বর এবং কুরিয়েন জোসেফ আলাদা আলাদা চিঠিতে প্রধান বিচারপতিকে বলেছিলেন, সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়ামের সুপারিশ চার মাস ফেলে রেখেছে সরকার৷ বিচারপতি কুরিয়েন জোসেফ এমনও বলেছিলেন, বিচারবিভাগের স্বাধীনতা এতটাই রোগগ্রস্ত যে এখনই তার চিকিৎসা না হলে অচিরেই তার মৃত্যু ঘটবে৷ দেখা যাচ্ছে সে কথাই সত্য হল৷
কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার গণতন্ত্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠানের উপর যেমন খবরদারি চালাচ্ছে তেমন করেই সুপ্রিম কোর্টকেও পুরোপুরি নিজেদের জো হুজুরে পরিণত করতে বদ্ধপরিকর৷ ফলি নরিম্যানের মতো দেশের প্রথিতযশা আইন বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি কে এম লোধার মতো আইনজ্ঞরা বলেছেন এর প্রতিবাদ হওয়া দরকার৷ বিচার বিভাগকে পুরোপুরি তাঁবেদারে পরিণত করার জন্য সরকার তাদের অপছন্দের লোককে কোনওমতে বিচারপতির আসনে দেখতে চায় না৷ বিজেপি কেন্দ্রীয় সরকারে বসার পর উত্তরাখণ্ডে জারি করা রাষ্ট্রপতি শাসনকে বেআইনি বলে রায় দিয়েছিলেন বিচারপতি কে এম জোসেফ৷ সেই কারণেই তাঁর নিয়োগকে এভাবে আটকে দিল সরকার৷
কেন্দ্রীয় সরকার তাদের কাজের সাফাই গেয়ে বলেছে বিচারপতি জোসেফের থেকে আরও সিনিয়ার বিচারপতি থাকায় এবং কেরালা থেকে আরও একজন বিচারপতি সুপ্রিম কোর্টে আছেন বলেই তাঁকে নেওয়া যাচ্ছে না৷ অথচ সংবিধান ও আইন বিশেষজ্ঞরা একযোগে বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের মতো প্রতিষ্ঠানে বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে একমাত্র বিচার্য বিষয় যোগ্যতা৷ সিনিয়ারিটি, রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব, ধর্ম জাত–পাত ইত্যাদি যেন কোনও মতেই যোগ্যতার মাপকাঠিকে ছাপিয়ে না যায়৷ সারা দেশে ২৪টি হাইকোর্টে ৪০০ বিচারপতির পদ খালি৷ নিম্ন আদালতে প্রায় ৬ হাজার বিচারক পদ খালি৷ বিচারকের অভাবে ২ কোটি ৬১ লক্ষ মামলা ঝুলে আছে৷ অথচ বিচারপতি নিয়োগে এতটুকু তৎপরতা নেই কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের৷
বিচারপতি নিয়োগের ব্যাপারে এর আগেও কলেজিয়ামের সুপারিশকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেছে বিজেপি সরকার৷ পাঞ্জাব–হরিয়ানা হাইকোর্টের অস্থায়ী বিচারপতি রামেন্দ্র জৈনকে স্থায়ী করা এবং তাঁকে কর্নাটক হাইকোর্টে বদলির সুপারিশ করেছিল সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়াম৷ বিচারপতি জৈনকে স্থায়ী করার বদলে ছ’মাসের এক্সটেনশন দিয়েই কাজ সেরেছে তারা৷ তাঁর বদলির বিষয়টি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করেছে৷ এমনকী তারা যে সুপারিশ মানছে না, সেটুকু পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টকে জানায়নি সরকার৷ ২০১৭ সালে সেপ্টেম্বরে কলেজিয়ামের সুপারিশকে একইভাবে পায়ে মাড়িয়ে বিচারপতি জয়ন্ত প্যাটেলকে কর্ণাটক হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হতে দেয়নি বিজেপি সরকার৷
গুজরাটের নারোদা পাটিয়া গণহত্যা মামলায় ৯৭ জন মানুষকে হত্যার দায়ে সাজা পেয়েছিলেন বিজেপির প্রাক্তন মন্ত্রী মায়াবেন কোডনানি৷ তাঁর শাস্তি নিয়ে অ্যাপিল মামলায় হাইকোর্টের সাত জন বিচারপতি মামলা থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন৷ একাধিক বিচারপতি প্রাণনাশের হুমকির কথা বলেছেন৷ শেষ পর্যন্ত ২০ এপ্রিল গুজরাট হাইকোর্ট সেশন কোর্টে সাজাপ্রাপ্ত হয়েও জামিনে ঘুরে বেড়ানো বিজেপির প্রাক্তন মন্ত্রী মায়া কোডনানিকে মুক্তি দিয়েছে৷ হাইকোর্ট বলেছে তাঁর বিরুদ্ধে কিছু প্রমাণের চেষ্টাই করেনি গুজরাট পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল ‘সিট’৷ বেশ কয়েকজন সাক্ষী, প্রত্যক্ষদর্শী পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দেওয়া সত্ত্বেও ‘সিট’ নীরব থেকেছে, যাতে ‘বেনিফিট অফ ডাউট’–এর জন্য কোডনানি ছাড়া পান৷ একইভাবে এনআইএ আদালতে হায়দরাবাদে মক্কা মসজিদে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নরহত্যার অপরাধে অভিযুক্ত বিজেপি ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে কিছু প্রমাণ করার চেষ্টাই করেনি কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএ৷
প্রায় একই সময় বিচারপতি ব্রিজগোপাল হরকিষেণ লোয়ার মৃত্যু নিয়ে আর কোনও তদন্ত হবে না, বলে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ৷ প্রধান বিচারপতি এবং তাঁর সঙ্গী অন্য দুই বিচারপতি এই বিষয়ে জনস্বার্থ মামলার আবেদনকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত আখ্যা দিয়ে বলেছেন, রাজনৈতিক লড়াই রাজনীতির ক্ষেত্রে মেটানোই ভাল৷ কিন্তু যে প্রশ্নগুলি বিচারপতি লোয়ার মৃত্যু নিয়ে উঠেছে তার সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতাধরদের প্রশ্ন এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে সেগুলিকে বাদ দিয়ে এই প্রশ্নটির উত্থাপনই মুশকিল৷ বিচারপতি লোয়ার মৃত্যু নিয়ে যে প্রশ্নগুলি উঠেছিল তার কোনও উত্তর দেশের মানুষ পেল না৷ সর্বোচ্চ আদালতে কোনও মামলার বিচার হওয়া মানে সেই বিচারাধীন বিষয়ে সন্দেহাতীতভাবে সিদ্ধান্ত হবে, এটাই যে কোনও গণতন্ত্রে মানুষের আশা থাকে৷ কিন্তু এই রায় কোনও সন্দেহকেই সন্দেহাতীতভাবে নাকচ করতে পারেনি৷
বিচারপতি লোয়ার মৃত্যু সংক্রান্ত মামলা সুপ্রিম কোর্টে আনতে চাননি প্রবীণ আইনজীবীরা৷ আগেই একাধিক সিনিয়ার আইনজীবী প্রধান বিচারপতিকে চিঠি দিয়ে বলেছিলেন, এই মৃত্যু নিয়ে বম্বে হাইকোর্টে যে মামলা চলছে এবং সিবিআই আদালতে যে তদন্ত চলছে তা শেষ না করে সুপ্রিম কোর্টে মামলা হওয়া উচিত নয়৷ সাক্ষ্য গ্রহণ, প্রমাণ সংগ্রহ এবং তা প্রতিষ্ঠা করার কাজ সেশন কোর্ট স্তরের আদালতেই হয়৷ হাইকোর্ট–সুপ্রিম কোর্ট সেই প্রমাণকে যাচাই করে মাত্র৷ ফলে সিবিআই আদালতকে টপকে সোজা সুপ্রিম কোর্টে মামলা গেলে কোনও কিছু প্রমাণ হওয়া মুশকিল৷ তাই সুপ্রিম কোর্টে এই জনস্বার্থ মামলা এখনই না শোনা ভাল৷ ১২ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের চারজন সবচেয়ে প্রবীণ বিচারপতি (জে চেলমেশ্বর, রঞ্জন গগৈ, মদন লোকুর এবং কুরিয়েন জোসেফ) তাঁদের নজিরবিহীন বিদ্রোহী সাংবাদিক সম্মেলনের আগে প্রধান বিচারপতিকে ঠিক একই কথা জানিয়েছিলেন৷ সেক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের আরও সতর্ক থাকা দরকার ছিল৷ প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ সন্দেহগুলিকে যাচাই করার জন্য পুলিশি তদন্ত শেষ হওয়ার অপেক্ষাই করল না৷ তদন্ত করে উত্থাপিত প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে সরকারকে বাধ্য করল না, বরং বিচারপতি লোয়ার সঙ্গী চার বিচারপতির কথাকেই শিরোধার্য করে নিয়ে সব তদন্তে ইতি টেনে দিল৷ বিচারপতি লোয়ার পরিবারের সদস্যরা হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, অতি ক্ষুদ্র সাধারণ মানুষ হিসাবে আমাদের আর কোনও জায়গায় এ নিয়ে যাবার উপায় রইল না৷ এই সমস্ত রায় নিয়ে বিজেপি যেমন উল্লসিত তেমনই হতাশ সোলি সোরাবজির মতো বহু বিশিষ্ট আইনজীবী থেকে শুরু করে একেবারে সাধারণ মানুষ৷ এবিষয়ে একটি তথ্য খুব গুরুত্বপূর্ণ, লোয়া মামলাকে সুপ্রিম কোর্টে টেনে নিয়ে যাওয়া এবং সব আপত্তি উড়িয়ে দিয়ে তার অতিদ্রুত শুনানির জন্য অত্যন্ত সক্রিয় ছিল আরএসএস৷ তাদের নেতা ভাইয়াজি জোশী চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন যাতে সিবিআই আদালতের তদন্ত এগোনোর আগেই সুপ্রিম কোর্টে বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়ে যায়৷ এটা কি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত নয়?
২০০৫ সালে সোহরাবুদ্দিন সেখকে ভুয়ো সংঘর্ষে হত্যা করে গুজরাট পুলিশ৷ ওই রাজ্যে বিজেপি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হরেন পাণ্ডিয়ার হত্যার প্রমাণ লোপাট করতেই এই হত্যা৷ হরেন পাণ্ডিয়ার হত্যা বিজেপির অনেক নেতার পথের কাঁটা সরিয়ে দিয়েছিল৷ অমিত শাহ সে সময়েই রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন৷ সোহরাবুদ্দিন হত্যার প্রায় এক বছর পর এটি যে পরিকল্পিত ‘এনকাউন্টার’ তা সামনে আসে৷ সুপ্রিম কোর্টে গুজরাটের আইজি (সিআইডি) গীতা জোহরীর বয়ানে উঠে আসে অমিত শাহের নাম৷ আদালত সিবিআই তদন্তের আদেশ দেয়৷ গুজরাট পুলিশের তৎকালীন ডিআইজি ডি জি বানজারা যিনি ‘মোদি মাই গড’ বলে নরেন্দ্র মোদির স্তুতি করতেন, তিনি সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে এই মামলায় কিছুদিন জেল খাটেন৷ ২০১৩ সালে জামিন পেয়ে এক চিঠিতে এই খুনের সাথে বিজেপি সরকারের ‘উচ্চমহলের’ যোগসাজশের কথা বলেন বানজারা৷ ২০১২ সালে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেয় এই মামলা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একজন বিচারপতিই শুনবেন৷ কিন্তু ২০১৪ তে বিজেপি কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় বসেই প্রভাব খাটাতে থাকে৷ বিশেষ সিবিআই কোর্টের বিচারপতি জে এস উটপট অমিত শাহকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে ছাড় দিতে অস্বীকার করার পরেই তাঁকে দ্রুত বদলি করে দেয় বিজেপি সরকার৷ দায়িত্ব নেন বিচারপতি লোয়া৷ তিনিও শমন পেয়েও অমিত শাহ হাজিরা না দেওয়ায় কড়া মন্তব্য করেন এবং অমিত শাহকে মামলার পরবর্তী তারিখে অবশ্যই হাজির হতে নির্দেশ দেন৷ এর কয়েকদিনের মধ্যেই নাগপুরে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে লোয়ার আকস্মিক মৃত্যু ঘটে৷ পরবর্তী বিচারক তাঁর নিয়োগের ২০ দিনের মধ্যে অমিত শাহকে খালাস দিয়ে দেন৷
বিচার ব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টি নিজেদের হাতে নিতে ২০১৪ সালের আগস্টে বিজেপি সরকার পার্লামেন্টে বিল আনে৷ ২০১৫ সালের অক্টোবরে সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চ তাকে অসাংবিধানিক বলে রায় দেয়৷ ফলে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং চারজন সবচেয়ে প্রবীণ বিচারপতিদের নিয়ে গঠিত কলেজিয়ামের হাতেই থেকে যায় বিচারপতি নিয়োগের ক্ষমতা৷ কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের অভ্যন্তরে সরকার যে কলকাঠি নাড়ছে তা বোঝা যায় ২০১৭ সালের অক্টোবরে আর পি লুথরা বনাম ভারত সরকার মামলায়৷ এই মামলায় বিচারপতি আদর্শ কুমার গোয়েল এবং বিচারপতি উদয় উমেশ বলেছিলেন, বিচারপতি নিয়োগের জন্য গঠিত কলেজিয়াম কী মাপকাঠিতে বিচার করবে তার পদ্ধতি (মেমোরেন্ডাম অফ প্রসিডিওর) ঠিক করতে দেরি করা চলবে না৷ তাঁরা অ্যাটর্নি জেনারেলকে আদালতে এসে সরকারের বক্তব্য জানাতে বলেছিলেন৷ কিন্তু এই বিচার চলার মধ্যেই প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র তাঁর সাথে অন্য আরও দুই বিচারপতিকে নিয়ে একটি বেঞ্চ গঠন করে দুই বিচারপতির বক্তব্য খারিজ করে দেন৷ প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ বলে, এগুলি আদালতের বিচার্যই নয়৷ কিন্তু কেন নয় তার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি৷ প্রধান বিচারপতির সিদ্ধান্ত বাস্তবে বিচারবিভাগের উপর সরকারের অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী হস্তক্ষেপেরই সুবিধা করে দেবে বলে চার প্রবীণতম বিচারপতি ১২ জানুয়ারির সাংবাদিক সম্মেলনে যে অভিমত দিয়েছিলেন আজ তা প্রমাণিত হচ্ছে৷
বিচার ব্যবস্থার অবক্ষয় আজ সারা বিশ্বে সমস্ত পুঁজিবাদী দেশগুলিতে প্রকট৷ ক্ষমতাসীন সরকার, সমাজের প্রভাবশালী মুষ্টিমেয় অংশ, বৃহৎ পুঁজিপতিদের স্বার্থ ইত্যাদির পায়ে সাধারণ মানুষের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেওয়ার প্রবণতা ভারতের বিচার ব্যবস্থায় মারাত্মক আকার নিচ্ছে৷ কংগ্রেস আমলেও বিচার ব্যবস্থাকে সরকারের তাঁবেদারে পরিণত করার চেষ্টা সব সময় হয়েছে৷ কংগ্রেস নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী চালু করেছিলেন ‘কমিটেড জুডিশিয়ারি’ শব্দবন্ধটি৷ অর্থাৎ বিচারবিভাগের টিকি বাঁধা থাকবে দিল্লির সাউথ ব্লকের কর্তাদের হাতে৷ সব সরকারই সেই পথেই বিচার বিভাগকে বেঁধে রাখতে চেয়েছে৷ কিন্তু বিজেপি আমলে তা আরও ব্যাপক আকার নিয়েছে৷
ইতিমধ্যে সাতটি বিরোধী দলের আনা প্রধান বিচারপতিকে ‘ইম্পিচ’ করার প্রস্তাবকেও বিজেপির অন্যতম নেতা তথা উপরাষ্ট্রপতি বেঙ্কাইয়া নাইডু বাতিল করে দিয়েছেন৷ অর্থাৎ এই নিয়ে গণতান্ত্রিক পথে আলোচনার কোনও সুযোগ রইল না৷ দেশের মানুষের কাছে বিচার বিভাগের এই অবক্ষয় গভীর উদ্বেগের৷ বিদ্রোহী চার বিচারপতির সাংবাদিক সম্মেলনের পর প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে পুরনো কিছু অভিযোগ সামনে এসেছিল৷ অভিযোগ, তিনি আইনজীবী থাকাকালীন তথ্যে কারচুপি করে ভূমিহীনদের জন্য বরাদ্দ জমি সরকারের থেকে ব্যক্তিগতভাবে নিয়েছিলেন, পরে কটকের জেলাশাসক আবেদনপত্রে এই কারচুপি ধরে ফেলে জমি বণ্টন বাতিল করেন৷ সিবিআই তদন্তেও বিষয়টি উঠে আসে৷ অরুণাচলের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কালিখো পুলের সুইসাইড নোটেও তাঁর নাম ছিল৷ যদিও এ নিয়ে কোনও তদন্ত হয়নি৷ ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে লখনউয়ের প্রসাদ ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্স সহ ৪৬টি প্রতিষ্ঠানের অনৈতিক কাজের বিরুদ্ধে মামলায় ওড়িশা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি আইএম কুদ্দুসি ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন৷ সুপ্রিম কোর্টে শুনানির মাঝপথে হঠাৎ করে অন্য বিচারপতিদের কাছ থেকে এই মামলা প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে নিয়ে যাওয়া হয়৷
খ্যাতনামা আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ বলেন, প্রধান বিচারপতি ওড়িশা হাইকোর্টে কর্মরত থাকার সময় এই মামলার শুনানিতে যুক্ত ছিলেন, তাই সুপ্রিম কোর্টে তাঁর এই মামলা শোনা উচিত নয়৷ পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত হয় যে, আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণকে নিরাপত্তা রক্ষী দিয়ে আদালত থেকে বার করে দেওয়া হয়৷ সম্প্রতি সিবিআইয়ের হাতে আসা একটি ফোনের রেকর্ড ফাঁস হতে জানা যাচ্ছে মেডিকেল কলেজের মামলা ‘ম্যানেজ’ করার জন্য এলাহাবাদ, ওড়িশা এবং দিল্লির কোন কোন ‘মন্দিরে’ ‘প্রসাদ’ চড়াতে হবে তা নিয়ে কুদ্দুসি এবং এক দালালের সাথে কথা বলেছেন অভিযুক্ত মেডিকেল কলেজের কর্তারা৷ স্বাভাবিকভাবেই এসব ঘটনায় ব্যাপকভাবে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষ এবং ন্যায়বিচারের ভাবমূর্তি৷
এ দেশের বুর্জোয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থার অন্যতম রক্ষক বিচারব্যবস্থার তথাকথিত পবিত্রতার মুখোশ ছিঁড়ে তার প্রকৃত দশা যেভাবে বে–আব্রু হয়ে পড়েছে তা হওয়ারই ছিল৷ গোটা ব্যবস্থাটা যখন পচে, গলে মরতে বসেছে তখন সেই ব্যবস্থার অন্যতম স্তম্ভ বিচারব্যবস্থা অকলঙ্কিত থাকবে তা হয় না৷ এই পরিস্থিতিতে জনসাধারণকে তার আইনি, সাংবিধানিক অধিকারগুলিকেও রক্ষা করার জন্য গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথেই অধিকার বুঝে নিতে হবে৷
লোয়াকে খুন, বলে দিলেন বিচারপতি
সংবাদ সংস্থা, দিল্লি, ৩ মে জীবনের আশঙ্কায় ভুগছেন৷ সাফ জানালেন বম্বে হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি বি জি কোলসে পাটিল৷ ইনিই সুপ্রিম কোর্টের লোয়া মামলায় রায়ের সমালোচনা করেছিলেন৷ রবিবার ‘অ্যালায়েন্স ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিস’ আয়োজিত এক সম্মেলনে বলছিলেন পাটিল৷ তিনি দাবি করেন, বিচারপতি লোয়ার মৃত্যু স্বাভাবিক নয়৷ সোহরাবুদ্দিন শেখের নকল–সংঘর্ষ মামলার এই বিচারকের মৃত্যু রহস্যজনক৷ যদিও সুপ্রিম কোর্টের রায় ছিল ঠিক উল্টোটাই৷ বিচারক পাটিলের দাবি, শুধু লোয়া নন, শ্রীকান্ত খণ্ডলকর এবং অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি প্রকাশ থোম্বরে, তাঁর দুই বিশ্বস্ত অ্যাডভোকেটকেও হত্যা করা হয়েছে৷ তাই পাটিলের আশঙ্কা, এরপর তাঁর পালা হলেও হতে পারে৷ তিনি অবিচারের বিরুদ্ধে রায় দিতে না পারলেও সরব হয়েছেন৷ কাজেই তাঁর মুখ বন্ধ করারও চেষ্টা হবে৷ তবে তিনি সত্যভাষণ থেকে পিছিয়ে আসবেন না ভয়ে৷ …. আজকাল, ৪ মে, ২০১৮ |
(৭০ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা ২৭ এপ্রিল, ২০১৮)