অবান্তর কথা কাকে বলে, তা বুঝতে এখন বোধহয় নরেন্দ্র মোদির মুখ-নিঃসৃত বাক্যচ্ছটাই যথেষ্ট! কেন? সম্প্রতি তাঁর একটি কাজ নিয়ে দেশ জুড়ে সমালোচনার উত্তরে তিনি যে সব কথা বলেছেন তাকে অবান্তর ছাড়া কিছুই যে বলা যায় না! তিনি গণেশ আরতির জন্য খোদ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির বাড়িটিকেই খুঁজে পেয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই বিশিষ্ট আইনজ্ঞ ও গণতান্ত্রিক বোধসম্পন্ন মানুষ তার সমালোচনা করেছেন। সেই সমালোচনার মোকাবিলা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বিরোধীরা গণেশকে ভক্তি করে না তাই সমালোচনা করছে। তিনি বাল গঙ্গাধর তিলকের প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, ‘ব্রিটিশের ফতোয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তিলক মহারাষ্টে্র গণেশ পুজো করেছিলেন, তাই আমিও করেছি, এতে দোষ কোথায়’?
কূটকৌশলী রাজনীতিতে মোদিজির দক্ষতার কথা না জানলে তাঁর এই বালখিল্যসুলভ ‘যুক্তি’ দেখে হয়তো বলাই যেত যে, বিষয়টি বোঝার মতো বোধটিই তাঁর নেই। কিন্তু তাঁর কর্মকৌশল সম্বন্ধে সামান্য জ্ঞান যাঁর আছে তিনিই বুঝবেন যে বিষয়টি সুপরিকল্পিত। তিনি আসলে একই ঢিলে একাধিক পাখি মারতে চেয়েছেন। প্রথমত, তিনি দেশের প্রধান বিচারপতির পাশে দাঁড়িয়ে ভক্তি-গদগদ একটি ছবি প্রচার করে সরকার এবং বিচারবিভাগের মধ্যেকার ভেদরেখাটি মুছে দিতে চেয়েছেন। যদিও গণতন্ত্রে তা অবশ্য পালনীয়। তিনি দেখাতে চেয়েছেন, দেশের সমস্ত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মতো বিচারবিভাগও সরকারের আজ্ঞাবহে পরিণত হতে চলেছে। এর সাথে এ দেশের রাষ্ট্র কাঠামোয় যতটুকু ধর্মনিরপেক্ষতার অস্তিত্ব টিকে আছে তাকেও আঘাত করতে চেয়েছেন তিনি।
যদিও বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর গণেশের পুজো করা নিয়ে নয়। তিনি গণেশ ভক্ত কি না এটা তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। গণতান্ত্রিক রাষ্টে্র যে কোনও মানুষের ধর্মাচরণ করা বা না করা সবটাই ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু নরেন্দ্র মোদি এবং ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় এঁরা তো দুই ‘গণেশ ভক্ত’ সাধারণ মানুষ নন! একজন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, অপর জন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। অর্থাৎ ভারত রাষ্ট্রের দুটি স্তম্ভের দুই প্রধান তাঁরা। যে অনুষ্ঠানে তাঁরা একযোগে অংশ নিয়েছেন সেটা কোনও সরকারি অনুষ্ঠান নয়। প্রধান বিচারপতির ব্যক্তিগত ধর্মাচরণের অনুষ্ঠান। সংবিধান, আইন ইত্যাদি সম্বন্ধে ন্যূনতম জ্ঞান যাঁদের আছে তাঁরা জানেন, সরকার এবং প্রশাসনিক ক্ষমতার অধিকারীদের থেকে বিচারবিভাগের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের দূরত্ব রাখাটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। এটা বিচারবিভাগের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতার প্রশ্নের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে। এ জন্যই প্রশ্ন উঠছে, ক্যামেরাম্যান সাথে নিয়ে প্রধান বিচারপতির বাড়িতেই প্রধানমন্ত্রীকে পুজো করতে যেতে হল কেন? প্রধান বিচারপতি যদি তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকেন, সেটাই বা কেন? আর সেই অনুষ্ঠান এত ফলাও করে প্রধানমন্ত্রীর তরফে প্রচারই বা করা হল কেন? আপত্তিটা এখানেই।
বুর্জোয়া পার্লামেন্টারি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তম্ভগুলির আপাত স্বাধীনতা এবং তাদের ক্ষমতার বিভাজন স্বীকার করা হয়েছিল এই ব্যবস্থার উদ্ভবের সময়কালেই। ১৭৪৮-এ ফরাসি দার্শনিক ও বিচারক মন্তেস্কু তাঁর ‘স্পিরিট অফ ল’ গ্রন্থে দেখিয়েছিলেন, ‘বিচারকের ক্ষমতাকে আইনসভা ও প্রশাসকদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক রাখতে না পারলে তার স্বতন্ত্রতা এবং স্বাধীনতা কোনওটাই থাকবে না’। ব্রিটেন আমেরিকা সহ বিশ্বের সমস্ত আধুনিক বুর্জোয়া রাষ্ট্র তাদের সংবিধানে এই নীতিকে মান্যতা দিয়েছে। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অন্যতম দাবি হিসাবে এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সরকার-প্রশাসন, সংসদীয় ফোরাম এবং বিচারবিভাগের প্রত্যেকের স্বতন্ত্র কর্মপরিসর ও স্বাধীন অবস্থান বুর্জোয়া সংসদীয় গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত। কিন্তু যত বুর্জোয়া ব্যবস্থার সংকট বাড়ছে, পুঁজি যত কেন্দ্রীভূত হচ্ছে তত ক্ষমতা কুক্ষিগত হচ্ছে মুষ্টিমেয় প্রশাসনিক কর্তাদের হাতেই। নাগরিকদের কণ্ঠস্বর দমন করতে পুলিশ-মিলিটারির অস্ত্রের জোর ও প্রশাসনের স্বৈরাচারী পদক্ষেপের ওপর বুর্জোয়া রাষ্ট্রের নির্ভরতা যত বেড়ে চলেছে তত খর্ব হচ্ছে বিচারবিভাগের স্বাধীনতা। উদাহরণ অজস্র। দিল্লি দাঙ্গায় সরকারবিরোধী রায় দেওয়ায় সেদিনই মধ্যরাতে হাইকোর্টের বিচারপতিকে বদলির আদেশ জারি, সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়ামের অসংখ্য সিদ্ধান্তকে সরকারের নস্যাৎ করে দেওয়া, কলেজিয়ামের ক্ষমতা ছেঁটে ফেলে সরকারের সিদ্ধান্তেই বিচারপতি নিয়োগের চেষ্টা, নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের কমিটি থেকে প্রধান বিচারপতিকে বাদ দেওয়া, অপছন্দের বিচারপতিকে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ আদালতে বদলি, হাইকোর্টের নিরপেক্ষ বিচারপতিদের সুপ্রিম কোর্টে প্রমোশনে বাধা সৃষ্টি করা ইত্যাদি বহু নজির এ প্রসঙ্গে দেওয়া যায়।
কংগ্রেস নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী খোলাখুলি চেয়েছিলেন ‘কমিটেড জুডিশিয়ারি’, অর্থাৎ সরকারের নির্দেশে চলা বিচারবিভাগ। বর্তমানে নরেন্দ্র মোদি জমানায় বিচারবিভাগকে এই জায়গায় নামিয়ে আনার সর্বব্যাপক প্রচেষ্টা চলছে। এর জন্য শাস্তি এবং পুরস্কার দুই ব্যবস্থাই আছে। সরকারের পছন্দের তালিকায় থাকলেই অবসরের পর প্রাইজ পোস্টিংয়ের উদাহরণ কম নয়। বাবরি মসজিদ ভাঙার মামলায় অন্ধবিশ্বাসকে যুক্তি-বিজ্ঞান-সত্য এবং প্রমাণের ওপরে স্থান দেওয়ার নজিরবিহীন রায় দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের যে বেঞ্চ, তার প্রধান ছিলেন বিচারপতি রঞ্জন গগৈ। সেই গগৈ অবসর নেওয়া মাত্র সরকারি দল মনোনীত সাংসদ হয়ে গেছেন। এ ভাবেই সরকারের সুনজরে থাকার পুরস্কার হিসেবে একাধিক বিচারপতি অবসরের পর কেউ সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যপাল হয়েছেন, কেউ গুরুত্বপূর্ণ কমিশনের প্রধান হয়ে গেছেন ইত্যাদি নানা অভিযোগ আছে।
প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতির একত্রে গণেশ আরাধনার ছবি দেখে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিং সহ অন্যেরা বলেছেন, সরকার ও বিচারবিভাগের মধ্যে সুস্পষ্ট ভাগের রেখা দুর্বল হয়ে যেতে পারে এমন কোনও কিছু অভিপ্রেত নয়। বিচারকের নিরপেক্ষ থাকাটাই যথেষ্ট নয়, তাঁদের নিরপেক্ষতার সুস্পষ্ট প্রমাণ প্রতি মুহূর্তে রাখতে হয়। ন্যায়বিচারের এটা সর্বজনগ্রাহ্য একটি নীতি। সারা দুনিয়ার আইন বিশেষজ্ঞরা একে মান্যতা দেন।
আরও একটি দিক থেকে এই ঘটনা অনভিপ্রেত। আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিং এক প্রবন্ধে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, সুপ্রিম কোর্ট ১৯৯৪-এ এস আর বোম্মাই বনাম ইউনিয়ন অফ ইন্ডিয়া মামলায় সুস্পষ্টভাবে বলেছিল, রাষ্ট্র কোনও ধর্মবিশ্বাসকে সমর্থন, প্রতিষ্ঠা বা পালন করতে পারে না। ব্যক্তি হিসাবে কেউ যে কোনও ধর্মীয় আচরণ করতে পারেন। সেই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরাম্যান সাথে নিয়ে এই পুজো অনুষ্ঠানটি প্রচারের ব্যবস্থা করেছেন। ব্যক্তি হিসাবে একান্ত নিজস্ব পরিসরে তাঁরা থাকেননি। তাই এই ঘটনা কোনও মতেই গ্রহণযোগ্য নয় (১৩ সেপ্টেম্বর, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস)।
এই প্রসঙ্গে মনে করিয়ে দেওয়া যাক, এ দেশের এক মহান সন্তান নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসাবে কী আচরণ করতেন। ১৯৪৩-এ সিঙ্গাপুরের চেট্টিয়ার সম্প্রদায়ের মন্দির কর্তৃপক্ষ আজাদ হিন্দ বাহিনীর জন্য অর্থ সাহায্য গ্রহণ করতে তাঁদের মন্দিরে যেতে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। নেতাজি গিয়েছিলেন তাঁর বাহিনীর সমস্ত জেনারেলদের নিয়ে, যাঁদের মধ্যে একাধিক জন ছিলেন মুসলিম এবং ক্রিশ্চান। তাঁর মত ছিল, আজাদ হিন্দ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক কোনও ধর্মের অনুগামী হতে পারেন না। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু যে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের লক্ষ্যে লড়াই করেছিলেন, আজকের ভারতের শাসকরা সেই ধর্মনিরপেক্ষতার কী দশা করেছেন, তা রাষ্ট্রের কর্ণধারদের আচরণেই স্পষ্ট।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই পুজোটা জরুরি ছিল– কারণ সামনে মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচন। এই সময় মারাঠি টুপি পরে গণেশ আরাধনার ছবি প্রচারে তাঁর আগ্রহ প্রবল থাকারই কথা। আর তা যদি একেবারে প্রধান বিচারপতির পাশে দাঁড়িয়ে করা যায়, তা হলে তো সোনায় সোহাগা! মহারাষ্ট্রকে বঞ্চিত করে সমস্ত প্রকল্প গুজরাটে টেনে নিয়ে যাওয়া, বদলাপুরের শিশু ধর্ষণে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ন্যূনতম ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশ এবং বিজেপি জোট সরকারের চরম অপদার্থতাকে ঢেকে হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্ন ফেরি করবার লোভে কাজটি তাঁর দরকার ছিল। কিন্তু তাঁর এই আচরণ ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোটির যে ক্ষতি সাধন করল তা পূরণ হবে কী দিয়ে? বিজেপি তথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভোটের স্বার্থে কত নিচে নামতে পারেন তা গুজরাট, দিল্লি সহ ভারতের নানা স্থানের দাঙ্গাপীড়িত মানুষ জানেন। কিন্তু এর জন্য বিচারবিভাগের মর্যাদাকেও খাটো করে তাকে সাম্প্রদায়িক প্রচারের স্বার্থে কাজে লাগানোর যে অপচেষ্টা তিনি করলেন তা চরম নিন্দনীয়। বিজেপি নেতারা এখন বিপাকে পড়ে কংগ্রেস, তৃণমূল ইত্যাদি দলের মুখ্যমন্ত্রী সহ অন্যান্য মন্ত্রী-নেতাদের কখনও নমাজে হাজির হওয়া কখনও পুজোর কার্নিভাল করার কথা তুলছেন। তাঁদের কাজটাও সমান নিন্দনীয়। কিন্তু তার জন্য নরেন্দ্র মোদির দোষ কি কমে যায়?
প্রধানমন্ত্রী লোকমান্য তিলকের উদাহরণ দিয়েছেন। এ উদাহরণ কি তাঁর আচরণের সমর্থনে গ্রহণীয়! ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের একটা ধারার মধ্যে যেহেতু ধর্মীয় চিন্তা খাদ হয়ে মিশে ছিল, বহু ক্ষেত্রে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য অনেক ক্ষেত্রে স্বাধীনতা সংগ্রামীরা ধর্মীয় উৎসবকে জনজাগরণের কাজে ব্যবহার করতে চেয়েছেন। তিলকের গণপতি উৎসবকে সেই দৃষ্টিতেই দেখতে হবে। অন্য দিকে তিলক বলছেন, ‘স্বাধীনতা আমার জন্মগত অধিকার’, ‘স্বরাজ আমার জন্মগত অধিকার’। আর নরেন্দ্র মোদি যাঁর শিষ্য সেই আরএসএসের গুরু গোলওয়ালকর ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনকে স্বাধীনতার লড়াই বলে মানতেই রাজি ছিলেন না। তিলক তো ব্রিটিশের বিরুদ্ধেই লড়েছিলেন। এ দিকে আরএসএস ব্রিটিশবিরোধী লড়াইকে স্বাধীনতা সংগ্রাম বলেই মনে করত না। মোদিজির দলের আইটি সেল আর হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয় কি সে খবর রাখে? তিলককে মানলে যে আরএসএসকে মানা যায় না, নরেন্দ্র মোদিজি কি তা জানেন না?
পার্লামেন্টারি ঠাটবাটের খোলসটা বজায় রেখেই ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচার কায়েমের চেষ্টা দীর্ঘ দিন ধরে ভারতীয় শাসকরা চালিয়ে যাচ্ছে। যে কারণে বিচারবিভাগের স্বাধীন অবস্থান ইতিমধ্যেই বিপদের মুখে পড়েছে। প্রধান বিচারপতির বাড়িতে প্রধানমন্ত্রীর আরতি সেই বিপদকে অনেকটাই বাড়িয়ে দিল।