এমন একটা সময় ভারতের প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল যাতে কিছু প্রশ্ন দেখা দিতে বাধ্য৷ একদিকে নির্বাচনী প্রচার চলছে দেশ জুড়ে, অন্যদিকে রাফাল বিমান কেলেঙ্কারি নিয়ে মামলার নথিপত্র নতুন করে আদালত চেয়ে পাঠিয়েছে৷ তার সাথে আছে নরেন্দ্র মোদির বায়োপিক নিয়ে মামলা, অযোধ্যা জমি মামলা, আসামের এনআরসি মামলা ইত্যাদি৷ এর সাথে দাবি উঠছে সমঝোতা এক্সপ্রেস বিস্ফোরণ, মালেগাঁও বিস্ফোরণ মামলায় সঠিক তদন্তের জন্য সর্বোচ্চ আদালত হস্তক্ষেপ করুক৷ গুজরাট দাঙ্গার একটি মাত্র মামলায় ক্ষতিগ্রস্ত বিলকিস বানো দৃষ্টান্তমূলক রায় পেয়েছেন, ফলে অন্য মামলাগুলিরও গতি পাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়ছে৷ গুজরাটে ভুয়ো সংঘর্ষে হত্যার মামলাও (যাতে নাম জড়িয়ে আছে বিজেপি সভাপতির) নতুন করে উঠে আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে৷ এইরকম এক সময়ে দাঁড়িয়ে দুটি অভিযোগ এ দেশের বিচারব্যবস্থাকে তোলপাড় করে দিল৷
সুপ্রিম কোর্টের এক ছাঁটাই হওয়া মহিলা জুনিয়ার কোর্ট অ্যাসিস্ট্যান্ট অভিযোগ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি তাঁকে যৌন হেনস্থা করেছেন৷ অভিযোগ অনুযায়ী, ঘটনাটি ঘটেছে ২০১৮ সালের অক্টোবরে বিচারপতি রঞ্জন গগৈ প্রধান বিচারপতি হিসাবে শপথ নেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই৷ অভিযোগকারিনী ২২ জন বিচারপতিকে চিঠি দিয়ে এবং হলফনামার মাধ্যমে তাঁর অভিযোগ দায়ের করেছেন৷ ঠিক একই সাথে আর একটি মারাত্মক অভিযোগ সামনে এসেছে৷ উৎসব সিং বাইনস নামে এক আইনজীবী হলফনামা দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের কাছে অভিযোগ করেছেন, গভীর ষড়যন্ত্র করে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে এই অভিযোগ সাজানো হয়েছে৷ বিশেষ একটি বৃহৎ ভারতীয় কর্পোরেট গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে ঘা পড়ার আশঙ্কায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাইছে যাতে প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন৷ তিনি বলেছেন, এই অভিযোগ সাজানোর জন্য তাঁকে দেড় কোটি টাকার টোপ দেওয়া হয়েছিল৷ তিনি অভিযোগ তুলেছেন, বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার জন্য ষড়যন্ত্রের জাল বহু দূর বিস্তৃত৷ রাজনৈতিক নেতা, বৃহৎ পুঁজিপতি থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক মাফিয়াদের নাম পর্যন্ত এই অভিযোগে উঠে এসেছে৷ অভিযোগ এসেছে, জায়গামতো টাকা ঢাললে যে কোনও রায় বদলে দেওয়া যায়৷
মহিলা কর্মীর যৌন হেনস্থার অভিযোগের তদন্তের জন্য বিচারপতি বোবদের নেতৃত্বে তিন বিচারপতিকে নিয়ে অভ্যন্তরীণ কমিটি (ইন হাউস কমিটি) গড়েছে সুপ্রিম কোর্ট৷ একই সাথে উৎসব সিংহের গভীর ষড়যন্ত্র সংক্রান্ত অভিযোগের তদন্তের জন্যপ্রাক্তন বিচারপতি এ কে পট্টনায়েককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে৷ সিবিআই, আইবি এবং দিল্লি পুলিশের প্রধানদের ডেকে বিচারপতি অরুণ মিশ্রের নেতৃত্বাধীন তিন বিচারপতির বিশেষ বেঞ্চ তাঁদের নির্দেশ দিয়েছে বিচারপতি পট্টনায়েককে সাহায্য করতে৷ যদিও প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে ওঠা যৌন হেনস্থা মামলার ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত বিচারপতি পট্টনায়েক তাঁর তদন্তের কাজ শুরু না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন৷ যৌন হেনস্থা মামলার সত্য–মিথ্যা নির্ধারণের কাজ তদন্ত কমিটির৷ কিন্তু এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে গভীর ষড়যন্ত্র সংক্রান্ত অভিযোগটি৷
বিচারপতি অরুণ মিশ্র আদালতে বসেই যে উদ্বেগ ব্যক্ত করেছেন তা সারা দেশের পক্ষেই অত্যন্ত উদ্বেগের৷ তিনি বলেছেন, ধনী এবং ক্ষমতাশালীরা মনে করছে তারা সুপ্রিম কোর্টকে ইচ্ছামতো চালাতে পারে, ব্ল্যাকমেল করে নতজানু করতে পারে৷ প্রবল ক্ষোভের সাথে তিনি বলেছেন, টাকার থলি আর রাজনৈতিক শক্তির অঙ্গুলিহেলনে সুপ্রিম কোর্টকে চালানোর চেষ্টা হচ্ছে৷ যারাই বিচার ব্যবস্থাকে স্বচ্ছ করতে চাইছেন, তাঁদের অনেককে খুন করা হচ্ছে, না হলে তাঁদের চরিত্র হনন করা হচ্ছে৷ এসব চলতে দেওয়া যায় না৷ আরও বলেছেন, বিচার ব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করার চেষ্টায় দেশের ক্ষমতাশালীরা আগুন নিয়ে খেলছেন (দ্য হিন্দু ২৬.০৪.২০১৯)৷ সুপ্রিম কোর্টের একজন গুরুত্বপূর্ণ বিচারপতির এমন মন্তব্য বুঝিয়ে দেয় যে, এ দেশের বিচার ব্যবস্থার অভ্যন্তরে কী পরিস্থিতি চলছে৷ গত বছর জানুয়ারিতে বর্তমান প্রধান বিচারপতি সহ চারজন বিচারপতির নজিরবিহীন সাংবাদিক সম্মেলন বিষয়টিকে অনেকটাই জনসমক্ষে এনে দিয়েছিল৷
সেদিনই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতার কফিনে শেষ পেরেকটা পুঁতে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে বিজেপি৷ নিজেদের পছন্দমতো লোক না পেলে বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়াকেই আটকে রাখা, বারবার সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়ামের কাজে হস্তক্ষেপ, এসব তো তারা করছেই, এমনকী বিচার বিভাগের অভ্যন্তরে কোন বিচারক কোন মামলা শুনবেন তাতেও সরকারি হস্তক্ষেপের চেষ্টার ইঙ্গিত প্রবীণ চার বিচারপতির সাংবাদিক সম্মেলনের মধ্যেই ছিল৷ কিন্তু তারপরেও সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়ামের সুপারিশের ফাইলটির উপর সরকার চেপে বসেই থেকেছে৷ এর বেশিরভাগই কার্যকরি করতে তারা বাধা দিয়ে চলেছে৷ গুজরাট দাঙ্গা, গুজরাটের ভুয়ো সংঘর্ষ মামলাগুলিকে অকার্যকরী করে দিতে বিচার বিভাগকে প্রভাবিত করা হয়েছে৷ বিজেপি সভাপতির বিরুদ্ধে রায় দেওয়া বিচারকের অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে তদন্ত ধামাচাপা দেওয়া হয়েছে৷ সিবিআই, এনআইএ–র মতো তদন্ত সংস্থাগুলির এখন একমাত্র কাজ হয়েছে নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহদের মতো বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে তদন্তগুলিকে বিপথগামী করে দিয়ে তাঁদের যাবতীয় অপরাধ থেকে ছাড় পাইয়ে দেওয়া৷ মালেগাঁও, হায়দরাবাদের মক্কা মসজিদ, সমঝোতা এক্সপ্রেস বিস্ফোরণ মামলাগুলির বিচারকে পুরোপুরি প্রহসনে পরিণত করতে সরকার সরাসরি আসরে নেমেছে৷ স্বামী অসীমানন্দকে ছেড়ে দিতে হওয়ায় বিচারক হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, সব বুঝতে পারলেও তদন্তকারীদের অসহযোগিতায় কিছুই করা গেল না৷ বিজেপি প্রার্থী প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরকে বিস্ফোরণ মামলায় এনআইএ ক্লিনচিট দিয়েছে শুনে খোদ বিশেষ আদালতের বিচারক বলেছেন, এমন কোনও এক্তিয়ারই তাদের নেই৷ অথচ তারপরেও সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে অভিযুক্ত সাধ্বী প্রজ্ঞার প্রার্থীপদ খারিজ হয়নি৷ সরকারি সংস্থা ওএনজিসির তেল–গ্যাসের খনিতে রিলায়েন্স ডাকাতি চালালেও আম্বানিদের বাঁচাতে বিচার বিভাগের গলা টিপে ধরেছে বিজেপি সরকার৷
রাফাল বিমান কেনায় দুর্নীতি সহ গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলি শোনার ঠিক আগেই প্রধান বিচারপতি সহ গোটা সুপ্রিম কোর্টকে এমন একটি বিতর্কের আবর্তে ফেলে দিয়ে সবকিছু ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে কি না সে প্রশ্ন ওঠা খুবই স্বাভাবিক৷ বিচারপতি অরুণ মিশ্র যে গুরুতর অভিযোগগুলি তুলেছেন, সেগুলির গভীরে অবশ্যই যাওয়া দরকার৷ কারণ এ দেশে গণতন্ত্রের যে ঠাটবাটটুকু অন্তত টিকে আছে তাকে রক্ষা করাটা দেশের মানুষের জন্যই দরকার৷ এর আগেও ২০১৭ সালে ভুয়ো মেডিকেল কলেজের অনুমোদন সংক্রান্ত মামলায় প্রাক্তন প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে পর্যন্ত দুর্নীতিতে মদত দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে৷ এক হাইকোর্ট বিচারপতি এই মামলায় ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তারও হয়েছেন৷ বিচারপতি মিশ্র নিজে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন, যেখানে সুপ্রিম কোর্টের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের ঘুষ দিয়ে বিচারকের দেওয়া রায়টিকেই বদলে লেখা হয়েছে৷ নিম্ন আদালত থেকে শুরু করে একেবারে সর্বোচ্চ আদালতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কান পাতলেই এমন অসংখ্য ঘটনা শুনতে পাওয়া যায়৷ কিন্তু এই দুর্নীতি বন্ধ করবে কে? প্রশাসনের কর্তা, পুলিশ থেকে শুরু করে বহু ক্ষেত্রে বিচারকের চেম্বার পর্যন্ত যে এই দুর্নীতিবাজদের হাত বিস্তৃত তা কি অস্বীকার করা যাবে? রাজ্যে রাজ্যে শাসকদলের নেতাদের বিরুদ্ধে পুলিশ কিংবা নিম্ন আদালত কোনও অভিযোগই নেয় না৷ ক’টা মানুষের সাধ্য থাকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত গিয়ে বিচার চাওয়ার? একেবারে অতি সাধারণ মানুষের বিচার পাওয়ার এই অধিকার রক্ষার জন্য কি সর্বোচ্চ বিচারালয়ের দায় থাকবে না?
নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি কেন্দ্রীয় সরকারে বসেই সমস্ত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে পুরোপুরি দলের কবজায় আনার কাজ শুরু করেছে৷ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের স্বশাসনকে প্রহসনে পরিণত করেছে বিজেপি৷ বিজেপির শীর্ষ নেতাদের মনমতো না চলায় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পরপর দুজন গভর্নরকে অকালে সরতে বাধ্য করা হয়েছে৷ সিবিআইয়ের ডিরেক্টর রাফাল বিমান কেনার কেলেঙ্কারির তদন্ত নিয়ে এগোতে চাওয়া মাত্রই তাঁকে মাঝরাতে বরখাস্ত করে নিজের লোক বসিয়েছে বিজেপি সরকার৷ ইডি, এনআইএ ইত্যাদি তদন্ত সংস্থাগুলির নিরপেক্ষতা পুরোপুরি ধ্বংস করা হয়েছে৷ ভোটে বিজেপির বিরোধী প্রার্থীদের হয়রান করার কাজে আয়কর দপ্তরকে ব্যবহার করা হচ্ছে এই অভিযোগকে কিছুটা মান্যতা দিতে নির্বাচন কমিশনও বাধ্য হয়েছে৷ যদিও প্রধানমন্ত্রী বা বিজেপি সভাপতির বিরুদ্ধে সামান্য অভিযোগের তদন্ত করার মতো মেরুদণ্ডটাও কমিশন কর্তারা খুঁজে পাচ্ছেন না৷
যে সংসদকে প্রণাম করে নরেন্দ্র মোদি ২০১৪তে সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি ভক্তিরসে আপ্লুত হওয়ার ঢং করেছিলেন, সেই সংসদকে বিজেপি প্রায় অকেজোই করে দিয়েছে৷ লোকসভায় নিজেদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা থাকলেও রাজ্যসভায় যেহেতু তারা দুর্বল তাই জমি অধিগ্রহণ বিল সহ বেশিরভাগ বিল নিয়ে আলোচনাই হতে দেয়নি বিজেপি৷ এই সরকার অর্ডিন্যান্স জারি করায় রেকর্ড করেছে৷ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা পর্যন্ত তার সমস্ত গুরুত্ব হারিয়েছে৷ রাফাল চুক্তি পরিবর্তন থেকে শুরু করে নোট বাতিল পর্যন্ত সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা জানতেই পারেননি৷ পুরোটাই নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী, বিজেপি সভাপতি, প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা আর এক–দু’জন আমলার দ্বারা৷ সরকার পরিচালনার গণতান্ত্রিক সমস্ত রীতি–নীতিকেই কবরে পাঠিয়েছে বিজেপি সরকার৷ এরপর সুপ্রিম কোর্টে এই সংকট সরকারকে আরও সুবিধা করে দিচ্ছে বিচারব্যবস্থাকে পুরোপুরি নিজেদের পকেটে পোরার৷ যদিও কংগ্রেস আমলেই বিচারব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করার চেষ্টার শুরু৷ ইন্দিরা গান্ধী স্লোগানই তুলেছিলেন, ‘কমিটেড জুডিশিয়ারি’৷ অর্থাৎ বিচারব্যবস্থাকে সরকারের তালে তাল মিলিয়ে চলতে হবে৷ ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে বিচারপতিদের মধ্যে একমাত্র আর পি খান্না মুখ খুলেছিলেন৷ সেই অপরাধে সিনিয়রিটি এবং সমস্ত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কংগ্রেস সরকার তাঁকে প্রধান বিচারপতি হতে দেয়নি৷ এরকম উদাহরণ অজস্র আছে৷ বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে সরকারি হস্তক্ষেপ, প্রমোশন, অবসরের পর নানা সরকারি কমিটিতে বিচারপতিদের রাখা ইত্যাদি কাজে নিরপেক্ষতার বালাই রাখেনি কংগ্রেসও৷ এই দিয়েই তারা বিচারপতিদের নিজেদের কবজায় রাখার চেষ্টা করে গেছে৷ বিজেপি এসে সেই চেষ্টাকে একেবারে সীমাহীন নগ্নতায় নিয়ে গেছে৷
বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা সম্বন্ধে একটা মহান গরিমার ছবি বুর্জোয়া রাষ্ট্রের কর্ণধাররা প্রচার করতেন কিছুদিন আগেও৷ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার লাগামহীন শোষণ–শাসনে সৃষ্ট জনমানসের ক্ষতে প্রলেপ দিতে বুর্জোয়া রাষ্ট্রেরই একটা বিশেষ অঙ্গ হিসাবে আদালতকে রাষ্ট্র–কর্তারা এভাবেই ব্যবহার করার চেষ্টা করতেন৷ দিন যত গড়িয়েছে, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে গণতন্ত্র ক্রমাগত অন্তর্ধান করেছে৷ আমলাতন্ত্র আর পুলিশ–মিলিটারির পেশির জোরেই মূলত বুর্জোয়া গণতন্ত্র টিকে আছে৷ সংসদীয় গণতন্ত্রের খোলসটুকুকে এই ব্যবস্থা ধরে রেখেছে শুধুমাত্র জনগণের চোখে ধোঁকা দেওয়ার জন্য৷ একদিন যে গণতন্ত্রের ঝান্ডা তুলে আব্রাহাম লিঙ্কন ঘোষণা করেছিলেন, ‘গভর্নমেন্ট অফ দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল’ (জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা এবং জনগণে জন্য) বুর্জোয়া গণতন্ত্র আজ তার থেকে বহু দূরে৷ জনগণের সমস্ত আশা–আকাঙক্ষা–অধিকার দুপায়ে দলে পিষে মুষ্টিমেয় ধনকুবেরের মুনাফা অর্জনকে নিশ্চিত করাই আজ বুর্জোয়া গণতন্ত্রের একমাত্র লক্ষ্য–উদ্দেশ্য৷ স্বাভাবিকভাবেই বুর্জোয়া রাষ্ট্রেরই অঙ্গ বিচারব্যস্থার আপাত স্বাধীনতা, তার নিরপেক্ষতা এগুলি দিনে দিনে অন্তর্ধানের পথেই গেছে৷ ভারতও এর বাইরে নয়৷ কোন দল ভোটে জিতবে থেকে শুরু করে, কোন মন্ত্রকে কোন মন্ত্রী–আমলা বসবে, সামরিক বাহিনী কোন বিমান বা অস্ত্র কিনবে ইত্যাদি, এমনকী বিচারব্যবস্থার প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় টাকার থলির মালিকদের নির্দেশেই নিয়ন্ত্রিত হয়৷ যে দল যখন শাসন ক্ষমতায় থাকে তারা এই বিষয়গুলিকে তাদের সংকীর্ণ স্বার্থে কাজে লাগায়৷ আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত বুর্জোয়া ব্যবস্থার রক্ষক রাজনৈতিক দলগুলি যেভাবে ধনকুবেরদের টাকার থলির কাছে সমস্ত নীতি–নৈতিকতাকে বিকিয়ে দিয়েছে, এ ব্যবস্থার সর্বত্রই তার ছাপ পড়েছে৷ বুর্জোয়া গণতন্ত্রের কোনও প্রতিষ্ঠানেই আজ গণতন্ত্রের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে৷ এই ব্যবস্থার রক্ষকরা একটা সংকট সামাল দিতে না দিতেই আবার এমন গভীর সংকটে পড়েছে যে, গণতন্ত্রের আব্রুটুকু বাঁচিয়ে চলাই তার পক্ষে অসম্ভব হয়ে উঠেছে৷ নির্লজ্জ গণতন্ত্রহরণ আর লুঠপাট–দুর্নীতিই আজ শাসকদের ভরসা৷ বিচারালয়েও এর লক্ষণ প্রকট হয়ে ফুটে বেরিয়েছে৷
কিন্তু একটা বিষয় উল্লেখ না করলে চলে না, বিচারপতি মিশ্র নিজেই বলেছেন, বিচারালয় বিচারপতিদের নয়, দেশের সাধারণ মানুষের সম্পত্তি৷ বিচারপতিরা আসেন–যান, দেশের মানুষ কিন্তু টিকে থাকে৷ এই আদালতকে সত্যিই কি দেশের অগণিত খেটেখাওয়া নিপীড়িত মানুষ নিজেদের বিচারালয় মনে করতে পারে সেখানে টাকার থলির দাপট কি শুধু দুর্নীতির হাত ধরে খিড়কির দরজাতেই কাজ করছে? আদালতের সদর দরজাতেও কি অর্থবান–ধনবানদের জয়জয়কারই চলছে না অতীতে এ দেশ পেয়েছে বিচারপতি ভি আর কৃষ্ণ আয়ারের মতো বিচারপতিদের৷ যাঁরা ছিলেন দেশের খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি যথার্থ দরদি৷ তাঁদের চেষ্টা ছিল যতদূর সম্ভব শ্রমিক–কৃষক–সাধারণ মানুষের ন্যায্য গণতান্ত্রিক অধিকারকে আইনি রক্ষাকবচ দেওয়া৷ ধীরে ধীরে দরিদ্র–খেটেখাওয়া মানুষের প্রতি সেটুকু সমবেদনার বাষ্পও বিচারালয় থেকে কবেই উবে গেছে৷ বিশ্বায়ন–উদারিকরণের যুগে বিচার বিভাগও বেসরকারিকরণ, শিক্ষায় ম্যানেজমেন্ট কোটা, ক্যাপিটেশন ফি ইত্যাদির পক্ষেই অবস্থান নিয়ে চলছে৷ এখন প্রতিবাদ, ধর্মঘট সহ অত্যাচারের বিরুদ্ধে মানুষের যে কোনও রকম রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টার উপরই আদালত খড়গহস্ত৷ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সংকট মোচনের স্বার্থে বিচারালয় যত বেশি করে জনস্বার্থ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ধনকুবেরদের স্বার্থরক্ষায় নিয়োজিত হচ্ছে, ততই তার নিজের আপাত স্বাধীনতাও ক্রমাগত খর্ব হচ্ছে রাজনৈতিক–প্রশাসন দাপটের সামনে৷
আদালতকে টাকার থলি আর রাজনৈতিক দাপট থেকে রক্ষা করার আর্জি আজ উঠে আসছে দেশের শীর্ষ আদালতের বিচারপতির মুখে৷ এই পরিস্থিতিই দেখিয়ে দেয়, গণতান্ত্রিক সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে কী মারাত্মক খেলায় নেমেছে বিজেপি সরকার৷ একে রুখতে হলে ভোটের বাক্সের দিকে তাকিয়ে থাকলে হবে না, দেশের খেটে–খাওয়া মানুষের অধিকার রক্ষায় শক্তিশালী গণআন্দোলনের শক্তিতেই কেবল এই অপচেষ্টাকে রোখা সম্ভব৷