বাস মালিকরা কি সরকারের থেকেও শক্তিশালী? অন্তত পশ্চিমবঙ্গে বাস নিয়ে যে টালবাহানা চলছে তা দেখে এ কথাই মনে হয়৷ সরকার বেসরকারি বাস মালিকদের কাছে প্রায় কাকুতি মিনতি করছে অথচ আইনি ক্ষমতা প্রয়োগ করে বাস অধিগ্রহণ করে তা চালাতে বাধ্য করতে পারছে না৷ ১ জুন থেকে শুরু হয়েছে আনলক–ওয়ান পর্ব৷ ধাপে ধাপে অফিস, দোকান বাজার সমস্ত খুলে গেছে৷ কলকাতা সহ জেলায় জেলায় মানুষ করোনা মহামারির সমস্ত স্বাস্থ্যবিধি শিকেয় তুলে রেখে বাধ্য হচ্ছেন বাদুড়ঝোলা হয়ে বাসে যাতায়াত করতে৷ এর ফলে যে মারাত্মক হারে করোনা মহামারি বেড়ে যেতে পারে তা সকলেই বলছেন৷ সরকার ক’দিন আগেই রাস্তায় চকের গণ্ডি কেটে কেটে পরস্পরের মধ্যে শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা প্রচার করছিল৷ এখন দমবন্ধ ভিড়ে কী করে দূরত্ব রক্ষা হবে সেই প্রেসক্রিপশনটা যদি তারা দিত তবে মানুষের বড় উপকার হত৷
সরকার প্রথমে বলেছিল বাসে কুড়ি জন করে যাত্রী তোলা যাবে৷ ভাড়া ঠিক করতে বলেছিল বাস মালিকদেরই৷ এই রকম ব্ল্যাঙ্ক চেক হাতে পেয়ে মওকা বুঝে বিপুল লাভের রাস্তা খোলার জন্য বাস মালিকরা যে অঙ্কের ভাড়া নির্ধারণ করেছিল তাতে মানুষের চোখ কপালে ওঠার জোগাড়৷ এস ইউ সি আই (সি) তখনই এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলে, সরকার দরকার হলে ভরতুকি দিয়ে, না হলে বাস অধিগ্রহণ করে জনস্বার্থে বাস চালাক৷ এরপর গণবিক্ষোভের আশঙ্কায় ভাড়া বাড়াতে না পেরে বাস মালিকদের চাপে সরকার বলে দিল যত সিট তত যাত্রী৷ এতে কী করে শারীরিক দূরত্ব বজায় থাকবে, সরকার আর সে প্রসঙ্গ তোলেনি৷ মুখ্যমন্ত্রী বলে দিলেন, সিটে কাগজ পেতে বসুন৷ তাতেই নাকি দূরত্ব বিধি মানা হয়ে যাবে কিন্তু এত কিছু করেও মন পাওয়া যায়নি বাস মালিকদের৷ তাঁরা জেদ ধরে বসে আছেন ভাড়া বাড়াতেই হবে, না হলে নাকি তাঁদের ক্ষতি হবে৷ সরকার আবার তাদের কিছু না বলে কিছু এসি, নন–এসি লাক্সারি বাসকে বাড়তি ভাড়া নিয়ে সরকারি তত্ত্বাবধানেই চলার ব্যবস্থা করে দিয়েছে৷ কিন্তু বাস মালিকরা উদ্ধতভাবে বলেই চলেছেন ব্যাপক হারে ভাড়া না বাড়িয়ে তাঁরা বাস চালাবেন না৷ করোনা মহামারিতে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষকে কার্যত ব্ল্যাকমেইল করছে বাস মালিকরা৷ জনগণের আন্দোলন দেখলে যে সরকার তা ভাঙতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তারাই মালিকদের এই ব্ল্যাকমেইলের বিরুদ্ধে যেন সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছে৷
কর্মক্ষেত্রে যেতে মানুষকে বেরোতেই হচ্ছে, তাদের দুর্ভোগের শেষ নেই৷ ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করে যদি বা একটা বাস পাওয়া যাচ্ছে তাতে বসার সিট দূরে থাক তিলধারণের স্থান নেই৷ কিন্তু সত্যিই কি ভাড়াতে পোষাতে না পেরেই মালিকরা বাস চালাতে পারছেন না? প্রথমত, আজকের এই মহামারির পরিস্থিতি সমাজের বড় অংশের মানুষের জীবনকে স্তব্ধ করে দিয়েছে৷ এরকম নয় যে একা বাসমালিকরাই এই তিনমাস কোনও রোজগার করতে পারেননি৷ ফুটপাথের হকার, গৃহপরিচারিকা, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক, ছোট দোকানদার, বেসরকারি অফিসের নিম্নস্তরের কর্মচারী ইত্যাদি কারও পেটের ভাত জোগাড়ের সংস্থান নেই৷ তাই লকডাউন শিথিল হতেই তাঁরা কাজে ফিরতে মরিয়া৷ সেখানে সুযোগ পেয়েও বাস মালিকরা গাড়ি বসিয়ে রাখার বিলাসিতা দেখাচ্ছেন, অর্থাৎ এমন পেটের দায় তাঁদের যে নেই, তা পরিষ্কার৷ তার উপর বর্তমান বাস ভাড়ার হার সরকার নির্ধারণ করেছিল বাস পিছু সিট সংখ্যার ভিত্তিতেই৷ বাস মালিকদেরই দেওয়া হিসাব অনুসারে তাতেই তাদের লাভ থাকার কথা৷ কিন্তু লকডাউনের আগে পর্যন্ত বাস কি সারাদিন শুধু সিটে বসা যাত্রী নিয়ে চলেছে? দাঁড়ানো যাত্রীদের থেকে কি ভাড়া নেওয়া হয়নি? তেলের দাম তখন যা ছিল তারপর বেশ কয়েকবার তা কমেছে৷ এখনও সেই সময়ের থেকে তেলের দাম কমই আছে৷ এ কথা ঠিক বিশ্ববাজারে তেলের দাম একেবারে তলানিতে পৌঁছে গেলেও তেল কোম্পানির ধনকুবের মালিক ও সরকারের মন্ত্রী–আমলাদের আমিরির রসদ জোগাড়ের স্বার্থে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ভারতে তেলের দাম খুব বেশি কমতে দেয়নি৷ কিন্তু রাজ্য সরকারও এ নিয়ে খুব বেশি উচ্চবাচ্য করেনি৷ কারণ তারাও তেলের উপর থেকে বিপুল রাজস্ব তোলে৷ কিন্তু সেই ভার করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত জনগণের ঘাড়ে চাপানো হবে কেন? এখন মানুষের হাতে টাকা দেওয়ার বদলে সরকার নিজেই বাড়তি ভাড়ায় বাস চালিয়ে কর্মহীন, অন্নহীন মানুষেরই পকেট কাটার পথে হাঁটছে৷ আর যে বাস মালিকরা সিট অনুসারে যাত্রীর বদলে ঠাসা ভিড় নিয়েই বাস চালাচ্ছেন তারা রোগ ছড়াতে সাহায্য করে যে মারাত্মক অপরাধ করছেন, তার শাস্তি হবে না কেন?
গণপরিবহণকে কোনও সভ্য দেশের সরকার মুনাফার দৃষ্টিতে দেখতে পারে না৷ দেখলে সে দেশকে আর যাই হোক না কেন, জনকল্যাণকামী এমনকি যথার্থ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রও বলা চলে না৷ জনজীবনের জন্য পরিবহণএকটি অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা৷ মানুষকে খেয়ে পরে বাঁচার ন্যূনতম সুযোগ করে দিতে হলেও বিনামূল্যে অথবা সস্তায় যথাসম্ভব আরামদায়ক পরিবহণ আজ আবশ্যিক শর্ত৷ দেখা দরকার কর্মক্ষেত্রে পৌঁছনোর আগেই শ্রমিকের প্রাণশক্তি ট্রেন–বাসের দমবন্ধ ভিড়ই যেন শুষে না নেয়৷ আজ করোনা মহামারির পরিস্থিতিতে তা আরও বেশি দরকার৷ কলকাতা এবং শহরতলির বাস পরিষেবা বিগত পনেরো দিনে যে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, তাতে অতি দ্রুত কলকাতার লক্ষ লক্ষ মানুষের করোনায় সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা আছে৷ সরকার বাস মালিকদের কাছে নতি স্বীকার করে গোটা রাজ্যের মানুষকে বিপদে ঠেলে দিচ্ছে৷ এখন ২০ জনের বেশি বাসে তোলা এমনিতেই জনস্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্মক৷ কিন্তু তাই বলে মালিকদের মুনাফা পুষিয়ে দেওয়ার দায় তো রোজগার হারানো আধপেটা খেয়ে দিন চালানো মানুষের ঘাড়ে চাপানো চলে না প্রয়োজনে সরকার তেলের রাজস্ব, রোড ট্যাক্স ইত্যাদি থেকে বাসের খরচে ভর্তুকি দিক৷ কেন্দ্রীয় সরকারেরও এ বিষয়ে দায় আছে৷ তারা লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা তেলের রাজস্ব থেকে তোলে, ফলে তারাও গণপরিবহণে পুরো ভরতুকির ব্যবস্থা করুক৷ জনসাধারণের থেকেই এই দাবি আজ উঠছে৷
প্রয়োজনে আন্দোলন করেই এই দাবি আদায় করতে হবে