২০২৩-‘২৪ সালের কেন্দ্রীয় বাজেট সম্পর্কে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ১ ফেব্রুয়ারি এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট)-এর সাধারণ সম্পাদক কমরেড প্রভাস ঘোষ বলেন,
দেশে ক্রমাগত বাড়তে থাকা তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কটে জর্জরিত, দারিদ্রের অতলে তলিয়ে যেতে থাকা লক্ষ লক্ষ মানুষের দুরবস্থার কোনও প্রতিফলনই ২০২৩-এর কেন্দ্রীয় বাজেটে খুঁজে পাওয়া গেল না। কয়েকটি ক্ষেত্রে সামান্য বরাদ্দ বৃদ্ধি কিংবা ব্যক্তিগত করে প্রতীকী ছাড় অথবা আগামী এক বছর ধরে ৮০ কোটি মানুষকে বিনামূল্যে রেশন দিয়ে যাওয়ার সগর্ব ঘোষণা– এ সবগুলিই আসলে উৎকৃষ্ট প্রতারণা। কারণ, এই বরাদ্দ বৃদ্ধি মূল্যবৃদ্ধির হারের তুলনায় অনেক কম। গত চার বছরে মূল্যবৃদ্ধির হার ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে এই সামান্য বরাদ্দ বৃদ্ধি জনগণকে সুরাহা দেওয়ার বদলে তাদের যন্ত্রণা বাড়াবে। বস্তুত, বিনামূল্যে রেশনের এই ঘোষণা থেকেই দেশের বিপুল সংখ্যক দরিদ্র মানুষের অস্তিত্ব স্পষ্ট হয়।
বাজেট ভাষণে কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের অর্থমন্ত্রী আগামী দিন সম্পর্কে বহু ফাঁকা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ‘হতে পারে’, ‘করা যেতে পারে’ ইত্যাদি নানা গতানুগতিক লব্জ আউড়েছেন। সরকারি প্রকল্পগুলির অযথা নতুন হিন্দি নামকরণ করেছেন এবং বিনিয়োগ শক্তিশালী করা ও পরিকাঠামো জোরদার করার অজুহাতে একচেটিয়া পুঁজিগোষ্ঠীগুলিকে আগের মতোই আরও বেশি করে সুযোগ-সুবিধা পাইয়ে দিয়েছেন। নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী যে সমস্ত বড় বড় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সযত্নে সেগুলির প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছেন অর্থমন্ত্রী। বাইরের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে তিনি ভারতীয় অর্থনীতির প্রতিরোধ ক্ষমতার গুণগান করেছেন। কিন্তু কী সেই ক্ষমতা তার কোনও প্রমাণ মেলেনি।
ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি ও তার সঙ্গে বাড়তে থাকা অর্থনৈতিক মন্দা, ছাঁটাই ও কল-কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার দরুণ বিপুল বেকারত্বের সমস্যার কোনও উল্লেখই বাজেটে নেই। যেমন নেই ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, কৃত্রিম ভাবে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে একচেটিয়া পুঁজিগোষ্ঠীগুলির ঠগবাজি, ব্যাঙ্কগুলিতে বিপুল পরিমাণ অনাদায়ী সম্পদ (এনপিএ)– এসবের কোনও উল্লেখ। এশিয়ার সমস্ত দেশের মুদ্রার তুলনায় আজ যে ভারতীয় টাকার শক্তি সবচেয়ে দুর্বল, অর্থমন্ত্রী তাও উল্লেখ করেননি।
দেশে ভোগব্যয় বৃদ্ধির যে দাবি বাজেটে করা হয়েছে, তা সঠিক নয়। কারণ প্রকাশিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে কেবল উচ্চ আয়ের কিছু মানুষেরই ভোগব্যয় বেড়েছে। এর উপর ব্যক্তিগত সঞ্চয়ের পরিমাণ হ্রাস এবং ব্যাঙ্ক-গ্রাহকদের ঋণের পরিমাণ বেড়ে ৮৩ লক্ষ ৫০ হাজার কোটি ( ৮৩.৫ ট্রিলিয়ন) টাকায় পৌঁছে যাওয়া থেকে স্পষ্ট যে, মাঝারি ও কম আয়ের পরিবারগুলি তাদের নিত্যপ্রয়োজন মেটাতে টাকা ধার করতে বাধ্য হচ্ছে যাকে বলা হয় ঋণ-তাড়িত বৃদ্ধি। সাধারণ মানুষের রোজগারের রাস্তাগুলি ক্রমশ বন্ধ হয়ে যাওয়াই এর কারণ। দেখা গেল, বাজেট-ঘাটতি মেটাতে সরকার ১৫ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি বিদেশি ঋণের উপর ভরসা করেই বসে আছে। জানা যাচ্ছে বর্তমানে দেশের মোট ঋণের পরিমাণ ১৫৫.৩১ লক্ষ কোটি টাকা। অর্থাৎ দেশের প্রত্যেক নাগরিকের কাঁধে রয়েছে ১ লক্ষ ৯ হাজার ৩৭৩ টাকার ঋণের বোঝা। সাম্প্রতিক একটি রিপোর্ট দেখিয়েছে, ২০১৭ থেকে ২০২১-এর মধ্যে মাত্র একজন বহুকোটিপতি গৌতম আদানির ঘুরপথে মুনাফা (আনরিয়ালাইজড গেন)-এর উপর কর বসালেই ১.৭৯ লক্ষ কোটি টাকা আদায় করা সম্ভব। দেশের ১০ জন সবচেয়ে ধনী বহুকোটিপতির উপর একবারের জন্য মাত্র ৫ শতাংশ কর বসালেই ১.৩ লক্ষ কোটি টাকা সংগ্রহ করা যেতে পারে।
বাজেটে কর থেকে আসা রাজস্ব বৃদ্ধি নিয়ে ঢাক পেটানো হয়েছে। অথচ দেখা যাচ্ছে, ২০২১-‘২২-এর জিএসটি বাবদ মোট ১৪.৮৩ লক্ষ কোটি টাকার ৬৪ শতাংশই এসেছে দেশের জনগণের সবচেয়ে নিচে থাকা ৫০ শতাংশের কাছ থেকে এবং সবচেয়ে ধনী ১০ শতাংশ মানুষ দিয়েছে এর মাত্র ৩ শতাংশ। অনেক বৃহৎ পুঁজিপতিই জিএসটি ফেরতের সুবিধা (ক্রেডিট ইনপুট বেনিফিট) শেষ ধাপের ক্রেতাদের না দিয়ে নিজেদের পকেটে পুরেছে। তা সত্ত্বেও এই বৃহৎ পুঁজিপতিদের জন্য আরও অনেক ছাড়ের কথা ঘোষণা হতে বাকি আছে।
ফলে এ কথা স্পষ্ট যে, বাজেট পেশের এই বাৎসরিক অনুষ্ঠান বাস্তবিকই একটি প্রহসনে পরিণত হয়েছে। জনগণের জীবনের কোনও সমস্যাই বাজেটের আলোচ্য বিষয় নয়। প্রধানমন্ত্রীর প্রশস্তির প্লাবন, জটিল অর্থনৈতিক পরিভাষা ও গালভরা ভাষণের আড়ালে শাসক একচেটিয়া পুঁজিপতি শ্রেণির সেবাদাস এবং জনস্বার্থের সম্পূর্ণ বিরোধী বিজেপি সরকারের চরম অপদার্থতাকে আড়াল করার চেষ্টা করার দলিল হল এই কেন্দ্রীয় বাজেট।