চিনের মানবতাবাদী সাহিত্যিক লু সুন এর একটি সুন্দর কথা আছে–সব ফুলই রঙিন কিন্তু সব রঙিন জিনিসই ফুল নয়, তেমন সব সাহিত্যই প্রচার কিন্তু সব প্রচার সাহিত্য নয়। ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ সিনেমাটা দেখতে বসে এই কথাটা যেন আবার স্পষ্ট হল।
কাশ্মীর ফাইলস দেখাতে বিজেপি এত ব্যগ্র কেন
বিবেক অগ্নিহোত্রী পরিচালিত ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ ছবিটিকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে বিজেপি’র নেতা-মন্ত্রীরা প্রথম থেকেই ছবিটি নিয়ে বিপুল উৎসাহ প্রকাশ করেছেন। গুজরাত-হরিয়ানা-কর্ণাটক-মধ্যপ্রদেশ সহ বেশ কিছু রাজ্যে ছবিটি ট্যাক্স-ফ্রি করে দেওয়া হয়েছে। এই সিনেমা দেখতে যাওয়ার জন্য সরকারি ছুটি মঞ্জুর করা হয়েছে, সিনেমা হল এর সমস্ত টিকিট কিনে নিয়ে, ফেসবুক-টুইটারে ঢালাও প্রশংসা করে মানুষকে উৎসাহিত করেছে কেন্দ্রের শাসক দল। এককথায় কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিজেপি তার যাবতীয় প্রচারযন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে ছবিটির পাবলিসিটির জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দরাজ সার্টিফিকেট দিয়ে বলেছেন, ‘এমন সিনেমার মাধ্যমে সাধারণ মানুষ প্রকৃত সত্য জানতে পারেন।’
কিন্তু কাশ্মীর ফাইলস সিনেমায় যা দেখানো হয়েছে তা কি যথার্থ ইতিহাস নাকি ইতিহাসের বিকৃতি? পরিচালক কি সত্যিই কোনও অজানা সত্য তুলে ধরেছেন? নব্বই এর দশকে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের হত্যা এবং তাদের উপত্যকা ছেড়ে চলে আসার সময়ের যথার্থ ছবি কি পরিচালক দেখিয়েছেন? সেই ঘটনার কোনও তথ্যনিষ্ঠ গবেষণার ছাপ আছে এই ছবিতে? সচেতন দর্শকের অভিজ্ঞতা বলছে, বাস্তবে এর কোনওটাই ঘটেনি ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’-এ। ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধ থাকা তো দুরের কথা, একটা ভুল জিনিস বাজে জিনিসকেও গল্পের মোড়কে বিশ্বাসযোগ্য করে উপস্থাপন করতে যেটুকু আড়াল-আবডাল দরকার তারও ধার ধারেননি পরিচালক। কাহিনী-চরিত্র-ঘটনাক্রম সর্বত্রই এত অসঙ্গতি এবং বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব ধরা পড়েছে যে সাদা চোখেই ছবিটিকে অত্যন্ত মোটা দাগের অপপ্রচার বলে ধরতে অসুবিধা হয় না। এটা কি শুধুমাত্র পরিচালকের খেয়ালখুশি এবং দক্ষতার অভাবের প্রশ্ন? তা হলে ছবিটি নিয়ে এত আলোচনার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু বাস্তব তা নয়।
শিল্পের কাজ অন্যায়ের স্বরূপ এবং যথার্থ কারণ চিনতে সাহায্য করা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষকে জাতিধর্ম নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ করা। ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ তার সম্পূর্ণ বিপরীতে ধর্মীয় আবেগে সুড়সুড়ি দিয়ে মানুষে মানুষে বিভেদ বিদ্বেষ তৈরি করতে চেয়েছে। বিবেক অগ্নিহোত্রী খুব স্পষ্ট কয়েকটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ছবিটি বানিয়েছেন। এক) নব্বই এর দশকে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের সাথে যে অন্যায় ঘটেছিল, তার একটা মিথ্যে ছবি তুলে ধরে ‘মুসলিম মানেই সন্ত্রাসবাদী’ এই ধারণাটিকে শক্তিশালী করা এবং ছবির পরতে পরতে উগ্র মুসলিম বিদ্বেষ ছড়িয়ে বিজেপি-আরএসএস এর হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের অ্যাজেন্ডাকে শক্তিশালী করা। দুই) কাশ্মীরের জনগণের উপর বছরের পর বছর ধরে সরকারি দলগুলির বিশ্বাসঘাতকতা এবং সামরিক বাহিনীর সাহায্যে দমন-পীড়নকে সম্পূর্ণ আড়াল করে কাশ্মীরের যাবতীয় সমস্যার জন্য সেখানকার সাধারণ মুসলমান ধর্মাবলম্বী নাগরিকদের দায়ী করা। যাতে কাশ্মীরের বুকে ৩৭০ ধারা বিলোপ এবং শ্বাসরোধকারী মিলিটারি শাসনকে সরকারের ন্যায়সঙ্গত বাধ্যতা বলে চালানো যায়। তিন) উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির যে কোনও বিরুদ্ধ স্বরকে, গণতান্ত্রিক চেতনাকে, বিশেষত বামপন্থাকে দেশের শত্রু হিসাবে তুলে ধরা। এককথায়, চলচ্চিত্রের মতো একটি শক্তিশালী শিল্পমাধ্যমের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে সরকারের কাশ্মীর নীতির ব্যর্থতাকে আড়াল করা এবং সংঘ পরিবারের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পালে বাতাস দেওয়ার একটি পরিকল্পিত উদ্যোগ ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’।
কী আছে এই ছবিতে? কাশ্মীরি পণ্ডিত পরিবারের একটি ছেলে, নাম কৃষ্ণ পণ্ডিত, তার ঠাকুরদার কাছে মানুষ হয়েছে এবং বর্তমানে ‘এএনইউ’ নামক একটি নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ছেলেটি যখন খুব ছোট, তার বাবা-মা-দাদা’কে সন্ত্রাসবাদীরা ১৯৯০-এর কাশ্মীরে নৃশংসভাবে হত্যা করে, কৃষ্ণ সে সব ঘটনার কিছুই জানে না। এক অধ্যাপিকা তাকে স্বাধীন কাশ্মীরের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভোটে সভাপতি পদে দাঁড় করাচ্ছেন। পরিচালকের ভাষ্য অনুযায়ী এএনইউ হচ্ছে জেএনইউ, সুতরাং সেখানকার এই প্রভাবশালী অধ্যাপিকা অবধারিতভাবে মিথ্যাবাদী, কুচক্রী, তিনি সন্ত্রাসবাদীদের সাহায্য করেন, নিজের স্বার্থে তিনি এই ছেলেটিকে ক্রমাগত ভুল বোঝান। প্রয়াত ঠাকুরদার শেষকৃত্যের জন্য ছেলেটি কাশ্মীর যায় এবং সেখানে পাঁচজন বয়স্ক মানুষের সাথে তার দেখা হয়। এঁরা প্রত্যেকেই কোনও না কোনওভাবে কৃষ্ণ’র ঠাকুরদাকে চিনতেন এবং এই পণ্ডিত পরিবারের সাথে হওয়া ভয়াবহ হত্যালীলার কথা জানেন। এঁদের কথা শুনে, বিশেষত এক অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসারের কাছে কিছু পুরনো কাগজপত্র, সংবাদপত্রের রিপোর্ট দেখে কৃষiর’র চোখ খুলে যায়। সে নিজের পরিবারের সাথে হওয়া অন্যায়ের কথা জানতে পারে এবং বুঝতে পারে যে ওই অধ্যাপিকা তাকে এতদিন ভুল বুঝিয়েছেন। কাশ্মীরের আসল সমস্যা হল সেখানকার মুসলিম জনগণ, এই মুসলিমরাই কাশ্মীরে বছরের পর বছর হিন্দুদের ওপর নারকীয় অত্যাচার করেছে পণ্ডিতদের বিতাড়ন করেছে ইত্যাদি। কাজেই, যারা কাশ্মীরের উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলেন তারা সবাই সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষক এবং দেশদ্রোহী। এই উপলব্ধির ভিত্তিতেই সে এএনইউ’তে ফিরে সে সমবেত ছাত্রদের সামনে ভাষণ দেয় এবং ওই অধ্যাপিকার মুখোশ খুলে দেওয়ার চেষ্টা করে। মোটামুটি এই হল ছবির কাহিনি।
ছবির বয়ানে অসঙ্গতি ও অযৌক্তিক ঘটনার সমাবেশ
প্রথমত, ছবির বয়ানে প্রচুর অসঙ্গতি এবং অযৌক্তিক ঘটনার সমাবেশ। কৃষ্ণ’র ঠাকুরদা পুষ্কর পণ্ডিত একজন শিক্ষক, নিজের ছেলে সহ সমগ্র পরিবারের নৃশংস মৃত্যুর সাক্ষী। ছবিতে তিনি একজন স্পষ্টবক্তা, পণ্ডিতদের জন্য সুবিচার চান, প্ল্যাকার্ড হাতে কাশ্মীরে ৩৭০ ধারার বিলোপ চেয়ে মিছিল করেন। অথচ তাঁর কাছেই বড় হওয়া নাতি কৃষ্ণকে তার যুবক বয়স পর্যন্ত তিনি কোনও দিন কিছুই বলেননি! কেন? ছবিতে তার কোনও উত্তর নেই। জেএনইউ’র মতো নামী প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পাওয়া একটি ছাত্রের কোনও নিজস্ব জানার জগৎ বা মতামত তৈরি হয়নি, তাকে অতি সহজেই যে কেউ যে কোনও কিছু বুঝিয়ে দলে টানতে পারে! বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে সেই প্রতিষ্ঠানের সমস্যা বা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার কোনও সমস্যা ইস্যু নয়, জেএনইউ’র নির্বাচনের একমাত্র বিষয় হচ্ছে কাশ্মীর সমস্যা! এমন হয় নাকি! ছবির বয়ান অনুযায়ী যে পাঁচজন কৃষ্ণ’কে সত্য জানাচ্ছেন বা বলা ভাল এতদিন লুকিয়ে রাখা সত্য ইতিহাস খুঁড়ে বের করে আনছেন, তাঁরা এতদিন কোথায় ছিলেন? নববই এর দশকে এই বিপন্ন পণ্ডিত ও তাঁর পরিবারের দুঃসময়ে তাঁরা পাশে দাঁড়ালেন না কেন? তারপরে দীর্ঘ তিরিশ বছর বা তাঁদের ভূমিকাই বা কী? এই ‘সত্যি’গুলো জানা সত্ত্বেও তাঁরা এতদিন কৃষ্ণকে বলেননি কেন? এমন অজস্র কেন-কী করে-কীভাবে’র উত্তর ছবিতে অনুপস্থিত। অনুপস্থিত, কারণ এই কৃষ্ণ চরিত্রটাকে এরকম অজ্ঞ, অপরিণত না বানালে পরিচালকের ইচ্ছেমতো জেএনইউ’র অধ্যাপিকাকে দিয়ে তার মগজধোলাই করানো যাবে না। আবার পরিবারের সব কথা তার থেকে গোপন না রাখলে লুকিয়ে রাখা ফাইলের রোমাঞ্চ তৈরির মালমশলায় ঘাটতি পড়বে। অধ্যাপিকা চরিত্রটি আনার একমাত্র উদ্দেশ্য যেহেতু বামপন্থাকে কাঠগড়ায় তোলা, সুতরাং এই মহিলার মুখ দিয়ে বাস্তবতার বালাই না রেখেই একেবারে খলনায়ক মার্কা কিছু সংলাপ বলাতে হবে। আসলে, কাশ্মীরি পণ্ডিতদের দুঃখ-যন্ত্রণার যথার্থ ছবি তুলে ধরা, তিন দশক ধরে ক্ষমতাসীন সরকারগুলো পণ্ডিতদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে পারল না কেন সেই প্রশ্ন তোলা, এমনকি ছবিটির ঘটনা পরম্পরাকে বৌদ্ধিকভাবে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার কোনও দায় পরিচালকের ছিল না। এ ছবির প্রতিটি ফ্রেম চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, পরিচালকের একমাত্র উদ্দেশ্য বিজেপি-আরএসএস ক্যাম্পের ভোটব্যাঙ্ক সংহত করা, তাতে ইতিহাসই বিকৃত হোক আর শিল্প চুলোয় যাক, কিছু এসে যায় না।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রাপ্তি এবং দেশভাগের সময় কাশ্মীর ছিল ডোগরা রাজাদের অধীনস্থ একটি স্বশাসিত রাজ্য, শাসক ছিলেন রাজা হরি সিং। ইতিহাস বলে হরি সিং নন, কাশ্মীরের ভারতভুক্তির চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য জাতিধর্মনির্বিশেষে কাশ্মীরের সাধারণ জনগণ এবং তাদের প্রতিনিধি দল ন্যাশনাল কনফারেন্স এবং তার অবিসংবাদী নেতা শেখ আবদুল্লা’র ভূমিকা ছিল প্রধান। দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রবক্তাদের রাজনীতির বিরুদ্ধে এটা ছিল ঐতিহাসিক জবাব। ধর্মীয় রাষ্ট্র পাকিস্তানের় বিপরীতে ভারতীয় সংবিধানের ‘ধর্মনিরপেক্ষতা এবং গণতন্ত্র’ তাঁদের আশা-আকাঙক্ষা-স্বাতন্ত্রের মর্যাদা দেবে এই স্বপ্ন নিয়েই শেখ আবদুল্লা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হতে চেয়েছিলেন। ভারতের অন্তর্ভুক্ত কাশ্মীরের স্বশাসন এবং বিশিষ্টতাকে মর্যাদা দিয়ে ভারতীয় সংবিধানে ৩৭০ ধারাটি যুক্ত হয়। যার বলে বিদেশনীতি, প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ–এই তিনটি বিষয় ছাড়া কাশ্মীরের যে কোনও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সেখানকার জনগণের নির্বাচিত সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এই ৩৭০ ধারার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে কাশ্মীরের জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করা এবং তার মাধ্যমে সঠিক বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়ায়, শুধু আইনি চুক্তিতে নয়, মানসিকভাবেও কাশ্মীরের মানুষের সাথে বাকি ভারতের একাত্মতা গড়ে তোলার বিষয়টিকে ত্বরাণ্বিত করা ছিল স্বাধীন ভারতের ক্ষমতাসীন সরকারের কর্তব্য। অথচ বাস্তবে ঘটে ঠিক এর উল্টো।
সংঘ পরিবার সহ বিভিন্ন বিভেদকামী সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং কংগ্রেস, বিজেপি সহ নানা দলের কেন্দ্রীয় সরকারের মিলিত উদ্যোগে একের পর এক অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ বাস্তবে ৩৭০ ধারার মর্যাদা ক্রমশ লঘু করে দেয়। কেন্দ্রীয় শাসকদলগুলির আচরণে কাশ্মীরের মানুষের মধ্যে ভারত সরকার সম্বন্ধে অবিশ্বাস বাড়তে থাকে। তাকে ব্যবহার করে আভ্যন্তরীণ বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলো তাদের পায়ের তলার মাটি শক্ত করে। ভারত সরকারের অগণতান্ত্রিক নীতি, রাজ্যের চরম অনুন্নয়ন, কর্মসংস্থানের কোনও সুযোগ গড়ে না তোলা, মানুষের জীবন জীবিকার প্রতি সরকারের চরম অবহেলা, ক্রমবর্ধমান দারিদ্র-বেকারি ইত্যাদির কারণে সরকারের উপর মানুষের চরম ক্ষোভ তৈরি হয়। কাশ্মীরের স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলি, যারা ভারতের সংসদীয় ব্যবস্থায় অংশ নিয়ে এমএলএ-এমপি হয়, তারা ক্ষমতার মধুভাণ্ডের ভাগ পেতে কেন্দ্রীয় শাকদলগুলির লেজুড়বৃত্তিই করতে থাকে। ফলে কাশ্মীরের জনগণের অসহায়তার সুযোগ নেয় সাম্রাজ্যবাদী নানা শক্তি ও পাকিস্তানের মদতপুষ্ট জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি। সে ক্ষেত্রেও এই সন্ত্রাসবাদীদের চিহ্নিত করে জনগণের থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করার জন্য রাজনৈতিক কর্মসূচির উদ্যোগ, জনগণের পূর্ণ সুরক্ষার দায়িত্ব নিয়ে কাশ্মীরের মানুষের ভরসা বিশ্বাস অর্জন করার বদলে ভারত সরকার তার মিলিটারির বন্দুকের জোরে কাশ্মীরকে শাসন করতে চায়। বছরের পর বছর কাশ্মীরের জনসাধারণ তাঁদের দ্বারা নির্বাচিত, তাঁদের কথা শুনবে এমন কোনও সিভিল প্রশাসনকে পায়নি। সামরিক তাকতই সেখানে একমাত্র প্রশাসন। ফলে নির্বচার গ্রেপ্তার, সন্দেহ হলেই গুলি, রাস্তায় বেরোলেই নানা হেনস্থা, কারফিউ, ফোন- ইন্টারনেট বন্ধ, যখন তখন বাড়িতে তল্লাশি, জঙ্গিদের ধরার নামে নিরীহ সাধারণ মানুষের বাড়িতে সামরিক বাহিনীর তাণ্ডব– এগুলোই যেন কাশ্মীরের স্বাভাবিক জীবন। বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার অসংখ্য পুরুষ নিখোঁজ, মহিলারা ধর্ষিতা, বিনা অপরাধে জেলবন্দী হয়ে সেনার পাশবিক অত্যাচারে মারা গেছেন অজস্র সাধারণ মানুষ। ২০১৯-এ বিজেপি শাসনে সংবিধানের ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার করে কাশ্মীরের স্বাধীনতা সম্পূর্ণ কেড়ে নেওয়ার পদক্ষেপ কাশ্মীর উপত্যকায় নির্বিচারে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালানোর পথ আরও প্রশস্ত করে। গদি মিডিয়ার খবরে বা বলিউডের মূলধারার উগ্র জাতীয়তাবাদে কাশ্মীরের মানুষের সাথে হওয়া বিশ্বাসঘাতকতা এবং প্রতিশ্রুতিভঙ্গের এই দীর্ঘ ইতিহাস জানা যাবে না। যদি ধরে নিই, বিজেপি ঘনিষ্ঠ পরিচালক কাশ্মীরের অতীত ইতিহাসের মধ্যে ঢুকতে চাননি, তার নিজস্ব এজেন্ডা অনুযায়ী শুধু পণ্ডিতদের ঘরছাড়ার ঘটনাটিকেই ফোকাস করেছেন, সেখানেও কি তিনি সত্য এবং তথ্যের প্রতি দায়বদ্ধ থেকেছেন? নাকি পণ্ডিত বিতাড়নের জন্য যে কোনও ভাবে মুসলিম ধর্ম এবং সেই ধর্মের মানুষকে দায়ী করতে হবে বলে মনগড়া গল্প সাজিয়েছেন?
বিতাড়িত পণ্ডিতদের সংখ্যা মোট পণ্ডিত সংখ্যার চেয়ে বেশি?
দেখা যাক, যে ছবি সত্য ইতিহাস তুলে এনে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের সুবিচার দেবে বলে বিজেপি’র নেতা-মন্ত্রীরা দাবি করছেন, সেই কাশ্মীর ফাইলস ইতিহাসের প্রতি কতটা সুবিচার করেছে। ছবিতে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ঘটনাকে বারবার ‘জেনোসাইড’ বা ‘গণহত্যা’ বলা হয়েছে। পরিচালক দেখাচ্ছেন, ওই সংঘর্ষের সময় থেকে ৪০০০ কাশ্মীরি পণ্ডিত খুন হয়েছেন এবং পাঁচ লক্ষ পণ্ডিত কাশ্মীর উপত্যকা উৎখাত হয়ে চলে গেছেন। অথচ সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী খুন হওয়া পণ্ডিতের সংখ্যা ২১৯। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের সংগঠন কেপিএস-এর একটি সমীক্ষা বলছে এই সংখ্যা ৩৯৯ থেকে ৬৫০ এর মধ্যে (সুত্রঃ স্ক্রোল.ইন, মার্চ ২০২২)। নানা সমাজতাত্ত্বিক গবেষণা ও সেন্সাস রিপোর্ট অনযায়ী ১৯৯০-এ কাশ্মীরে পণ্ডিতের সংখ্যাটা ১ লক্ষ ৬০ হাজার থেকে ১ লক্ষ ৭০ হাজার-এর মধ্যে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ইভান্সের মতে, ১৯৯০ সালে ৯৫ শতাংশ কাশ্মীরি পণ্ডিত উপত্যকা ছেড়ে চলে গিয়েছেন। অর্থাৎ ১ লক্ষ, ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষ ৬০ হাজার জন”(সুত্রঃ কাশ্মীর-ইতিহাসের পাতায় রক্তের দাগ, এপিডিআর)। অন্যান্য গবেষকদের মতে এই সংখ্যা আরও কম। জম্মু-কাশ্মীরের সরকারি ওয়েবসাইট বলছে ওই সময় ৬০ হাজার কাশ্মীরি হিন্দু পরিবার উপত্যকা ছেড়ে চলে যান। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সংখ্যা নিয়ে মতানৈক্য যাই থাক, কোনও তথ্যই কাশ্মীর ফাইলস এর মনগড়া সংখ্যাকে সমর্থন করছে না।
এ তো গেল পরিসংখ্যানের কথা। বিবেক অগ্নিহোত্রীর বর্ণনায় ধর্মীয় তকমাই মানুষের একমাত্র পরিচয়। তাই পণ্ডিতরা সন্ত্রাসবাদের স্বীকার কাশ্মীরের অসংখ্য সাধারণ মানুষের অংশ নন, তাদের মূল পরিচয় তারা হিন্দু। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের ওপর হত্যালীলা চালানো সন্ত্রাসবাদীদের এটাই পরিচয়– তারা মুসলমান। ছবিতে কোথাও একটিও মানবিক মুসলমান চরিত্র নেই। সিনেমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুসলিম মানেই বর্বর, মিথ্যেবাদী, ধর্ষকাম, নিষ্ঠুর। পণ্ডিতদের মেরেছিল যারা তারা সন্ত্রাসবাদী, এটা পরিচালকের কাছে গৌণ, আসল উদ্দেশ্য সমস্ত মুসলিমকেই সন্ত্রাসবাদী প্রমাণ করা। এটা করার ক্ষেত্রে তিনি এতটাই বেপরোয়া, যে কাশ্মীরের মুসলমান শিশুদেরও তিনি রেয়াত করেননি। তার ‘সত্যানুসন্ধানী’ চিত্রনাট্যে মুসলমান পরিবারের শিশুরা পণ্ডিত তাড়ানোর স্লোগান দেয় আর পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলে, মুসলিম স্কুলশিক্ষক ছাত্রদের সাম্প্রদায়িক হিংসা শেখায়। কয়েকজন মুসলমান একটি হিন্দু পরিবারের বাচ্চাকে জোর করে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলায়। পুষ্কর পণ্ডিতের ‘ওম নমঃ শিবায়’ এর উত্তরে তাঁর প্রাক্তন ছাত্র ছবির মূল ভিলেন সন্ত্রাসবাদী বিট্টা বলে ‘কাশ্মীরে থাকতে হলে আল্লাহ আকবর বলতে হবে’। এভাবেই প্রায় প্রতিটি দৃশ্যে, সংলাপে, ঘটনায় পরিচালক ব্যক্তিমানুষের ধর্মপরিচয়কেই প্রধান করে দেখিয়েছেন। এমনকি পণ্ডিতদের প্রতিবেশী মুসলিমরাও প্রত্যেকেই ধূর্ত, শঠ, প্রতারক, চরিত্রহীন। এক মুসলমান প্রতিবেশী একটি পণ্ডিত পরিবারকে নিরাপদ জায়গায় চলে যেতে বলছেন এবং তারপরেই সন্ত্রাসবাদীদের কাছে তারা কোথায় আশ্রয় নিয়েছে সেটা ফাঁস করে দিচ্ছেন। আর একজন মুসলমান, পরিচিত পণ্ডিত মহিলাকে সুরক্ষা দেওয়ার বিনিময়ে কুপ্রস্তাব দিচ্ছেন। অর্থাৎ কোনও রাখঢাক না করেই বিবেক অগ্নিহোত্রী তার মুসলিমবিদ্বেষ এর অ্যাজেন্ডা চরিতার্থ করতে চেয়েছেন। আর একটি আশ্চর্যের বিষয়, যে দেশ এবং রাজ্যের বুকে পণ্ডিতরা এ ভাবে অত্যাচারিত হলেন, তাদের সুবিচার চাইতে বসে পরিচালক একটিবারের জন্যও তৎকালীন সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলার প্রয়োজন মনে করলেন না! পণ্ডিতদের চলে যাওয়া আটকানো বা তাদের সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে তৎকালীন সরকারের ভূমিকা কী ছিল? সন্ত্রাসবাদীরা কি শুধু বেছে বেছে হিন্দু পণ্ডিতদের খুন করেছিল, নাকি অন্য ধর্মের মানুষও সেই তালিকায় ছিলেন? কাশ্মীরের সাধারণ মুসলমান নাগরিকরা কি পণ্ডিতদের ওপর এই আক্রমণ সমর্থন করেছিলেন? সচেতন দর্শকের মনে স্বভাবতই এই প্রশ্নগুলো উঠবে।
রাজ্যপাল জগমোহনের পণ্ডিত বিতাড়নী ভূমিকা
১৯৮৯-এর ডিসেম্বর থেকে বিজেপি সমর্থিত জনতা দল ছিল কেন্দ্রের ক্ষমতায়, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ভি পি সিং। বিজেপি তখন লালকৃষ্ণ আদবানির নেতৃত্বে রথযাত্রার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, যা ভারতবর্ষের মাটিতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আরেকটি কলঙ্কিত অধ্যায়। এই সময় কুখ্যাত মুসলিমবিদ্বেষী জগমোহনকে দ্বিতীয় বারের জন্য কাশ্মীরের রাজ্যপাল করে পাঠানো হয়। এই জগমোহন আগে কংগ্রেস নেত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতিনিধি হিসাবে ১৯৮৪ থেকে ‘৮৭ পর্যন্ত কাশ্মীর শাসন করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়িয়েছেন। কংগ্রেস সবসময়েই কাশ্মীরে সাম্প্রদায়িক উত্তজনাকে জিইয়ে রাখাতে চেয়েছে। ইন্দিরা গান্ধীর প্রতিনিধি জে এম শাহ ১৯৮৩-‘৮৪ সালে জম্মুতে মন্দিরের মধ্যে মসজিদ তৈরির মতো উস্কানিমূলক কর্মসূচি নিয়ে দাঙ্গায় উৎসাহ দেন। ১৯৮৭-তে কংগ্রেস নিজেদের মনমতো সরকার বসানোর জন্য কাশ্মীরের নির্বাচনে খোলামেলা রিগিং করার জন্য যুবকদের হাতে অত্যাধুনিক রাইফেল পর্যন্ত তুলে দেয়। এদিকে দিল্লির পুতুল সরকার জনগণ মেনে নিতে পারেনি। তার সুযোগ নেয় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। কংগ্রেসের দেওয়া অস্ত্রই তখন তাদের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। উল্লেখ্য এই কংগ্রেস সর্বভারতীয় স্তরে এবং জম্মু-কাশ্মীরের ক্ষেত্রে বারবার আরএসএসের সমর্থন লাভ করেছে।
দ্বিতীয়বার রাজ্যপাল হয়ে এসে প্রথম দিন থেকেই জগমোহন কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের ওপর সংগঠিত রাষ্ট্রীয় মদতে সন্ত্রাস নামিয়ে আনেন। নিরাপত্তা বাহিনী নামিয়ে মুসলিমদের বাড়ি খানাতল্লাশি, মহিলাদের সাথে দুর্ব্যবহার, বহু যুবককে বিনা অভিযোগে গ্রেপ্তার করা কোনওটাই বাদ যায়নি। এর প্রতিবাদে এবং জনজীবনের নানা দাবি নিয়েমানুষ পথে নামলে মিলিটারি সেই নিরস্ত্র মানুষগুলোর ওপর গুলি চালিয়ে ৫২ জনকে হত্যা করে (মানবাধিকার সংগঠনগুলির মতে ৩০০ জন) এবং ২৫০ জন মারাত্মকভাবে আহত হন। ১৯৯০ এর ২১ জানুয়ারির এই ঘটনা গাওকদল হত্যাকাণ্ড নামে কুখ্যাত। এই মিছিলের সাথে যে গণতান্ত্রিক দাবিগুলি ছিল তাকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার পারত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে। তার মধ্য দিয়ে জনগণের থেকে সন্ত্রাসবাদী-বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আলাদা করা যেত। কিন্তু দমনের পথে গিয়ে সরকার বিচ্ছন্নতাবাদীদের হাতই শক্ত করল। পণ্ডিতরা যখন সন্ত্রাসবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেন, তখন মুসলিম এবং পণ্ডিত নাগরিকদের পক্ষ থেকে যুগ্মভাবে জগমোহনের কাছে পণ্ডিতদের সুরক্ষা এবং সন্ত্রাসবাদীদের গ্রেপ্তার করার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়। কিন্তু তিনি এবং কেন্দ্রীয় সরকার ও তার শরিক বিজেপি বেশি আগ্রহী ছিল পণ্ডিতদের উপত্যকা ছাড়ার ঘটনাকে প্রচার দিয়ে কাশ্মীরে সামরিক তাকত বাড়ানোয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সুমিত গাঙ্গুলি বলেছেন– জগমোহন ঘোষণা করেন, ‘যদি কেউ উপত্যকায় থেকে যেতে চায়, তার নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের নয়।’ কাশ্মীরের পরিস্থিতি বিচার না করে, সেখানকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সাথে কথা না বলে, একটি মুসলিম প্রধান অঞ্চলে একজন মুসলমানবিদ্বেষী প্রশাসক পাঠিয়ে এবং সাধারণ মানুষের ওপর একতরফা দমনপীড়ন কায়েম করে কেন্দ্রের সরকার অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক তাস খেলেছিল। দু’জন প্রথিতযশা বিচারপতি রাজিন্দর সাচার এবং ভি এম তারকুন্ডে এবং দু’জন শিক্ষাবিদ বলরাজ পুরি ও অমৃত সিং কাশ্মীর পরিস্থিতি খতিয়ে দেখার জন্য ১৯৯০ এর মার্চ-এপ্রিল মাসে কাশ্মীরে যান। তদন্তের শেষে তাঁরা বলেন যে, পণ্ডিত বিতাড়নের দায় সরকার এবং জঙ্গিগোষ্ঠী উভয়ের উপরেই বর্তায়। এসব কোনও কিছুই আলোচ্য কাশ্মীর ফাইলসে নেই, কারণ সরকারের ওই ন্যক্কারজনক ভূমিকা সামনে এলে সেটা স্পষ্টতই বিজেপি-আরএসএস-এর বিপক্ষে যাবে। একই ভাবে পরিচালক এ সত্যও সম্পূর্ণ আড়াল করে গেছেন যে, শুধু হিন্দু পণ্ডিতরাই নন, বহু মুসলমান নাগরিকও ওই সময় সন্ত্রাসবাদীদের হাতে খুন হন। বাস্তবে, নিহত মুসলিমদের সংখ্যা ছিল পণ্ডিতদের চেয়ে বেশি। সন্ত্রাসবাদীরা স্বভাবতই এক্ষেত্রে কোনও ধর্মবিচার করত না। সেইসময়ের সংবাদপত্র, বিভিন্ন রিপোর্ট, মন্তব্য এমনকি জঙ্গিগোষ্ঠীর স্বীকারোক্তিতেও এর সমর্থন পাওয়া যায়। ‘একটি বিষয় হল, ১৯৯০ থেকে কাশ্মীরি পণ্ডিতরাই খুনের একমাত্র লক্ষ্য নন। নানা জঙ্গি গ্রুপের আদর্শ থেকে যে কাশ্মীরি মুসলমানরা নিজেদের সরিয়ে নিয়েছিলেন, পণ্ডিতদের মতো তাঁদেরও ধারাবাহিক ভাবে খুন হতে হয়েছে (লেখিকা মৃদু রাই-এর সাক্ষাতকার)।’ ১৯৯০ এর ২১ মে সর্বজনশ্রদ্ধেয় ধর্মীয় নেতা মীরওয়াইজ মৌলভি ফারুক সন্ত্রাসবাদীদের হাতে নিহত হন। প্রশাসক হিসেবে এই হত্যাকে নিন্দা করা বা শোকার্ত মানুষকে সংহতি জানানো তো দুরের কথা, জগমোহনের নির্দেশে পুলিশ তাঁর শবযাত্রায় গুলি চালিয়ে ৪৭ জন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে। এহেন জগমোহনকে কেন ২০১৬ তে বিজেপি সরকার পদ্মবিভূষণ দিয়েছিল আর কাশ্মীর ফাইলসের ‘সাহসী’ পরিচালক কেন তাঁকে সম্পূর্ণ আড়াল করে গেছেন, তা বুঝতে কষ্ট হয় না। সন্ত্রাসবাদীরা যেমন নীলকান্ত গঞ্জু, টিকালাল টাপলু, লাসা কউল’কে মেরেছে, তেমনই তারা হত্যা করেছে মহম্মদ শাহবান উকিল, মৌলানা মসুদী, কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মশিরুল সাহেব এবং তাঁর ব্যক্তিগত সচিব অব্দুল গণিকে, ন্যাশনাল কনফারেন্সের নেতা মহম্মদ ইউসুফ হাওয়াইকে। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সাধারণ মানুষের মতোই কাশ্মীরের মুসলমান নাগরিকরা সেদিন নিজেদের বিপন্ন অবস্থার মধ্যেও সীমিত শক্তিতে পণ্ডিতদের চলে যাওয়া আটকাতে চেয়েছেন এবং আজও কাশ্মীরের মুসলমান নাগরিকরা পণ্ডিতদের এই চলে যাওয়াকে ঘিরে গভীর মনোকষ্টে ভোগেন। প্রাক্তন আইবি অফিসার এবং ‘র'( রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং) এর অধিকর্তা এএস দৌলত সেইসময় কাশ্মীরে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি একটি সাম্প্রতিক মন্তব্যে এই সৌহার্দে্যর উল্লেখ করে বলেছেন, পণ্ডিতদের নিশ্চয়ই নিশানা করা হয়েছে, কিন্তু আরও বেশি সংখ্যায় আক্রান্ত হয়েছেন মুসলিমরা। যে পণ্ডিতরা থেকে গেছিলেন, মুসলিমরা তাঁদের সুরক্ষা দিয়েছেন সাহায্য করেছেন।
‘পণ্ডিত মুসলিম ভাই ভাই‘ ভারতীয় ফৌজ কাঁহাসে আয়ি
মজার ব্যাপার হল আজ পর্যন্ত কোনও সরকারই পণ্ডিতদের পুনর্বাসনের জন্য কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়নি। তথ্যের অধিকার আইনের একটি সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, কাশ্মীরে জঙ্গি অভ্যুত্থানের সময় থেকে সন্ত্রাসবাদীদের হাতে ১৭২৪ জন খুন হয়েছেন, যার মধ্যে ৮৯ জন কাশ্মীরি পণ্ডিত (সুত্র মাউন্টেন ইঙ্ক, মার্চ ২০২২)। সাগরিকা কিসসুর একটি লেখায় কিছু কাশ্মীরি পণ্ডিতের বয়ান পাওয়া যায়। পুলওয়ামার কাছে তাহাব গ্রামের বাসিন্দা কাশ্মীরি পণ্ডিত এবং মুসলমানরা আজও দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখ ভাগ করে নিয়ে একসাথে আছেন। এমনই একজন পণ্ডিত অজয় রায়না বলছেন, ‘প্রত্যেক বছর আমি আমার স্ত্রী এবং তাঁর পরিবারের সাথে দেখা করতে কাশ্মীর আসি। আমরা কোনও দিন কোনও হুমকির সম্মুখীন হইনি। আমি প্রায় সব দেশ ঘুরেছি এবং আমি এখনও এটাই বলব যে কাশ্মীর হচ্ছে স্বর্গ। … হ্যাঁ এটা ঠিক যে কিছু যুবক জঙ্গি গোষ্ঠীতে যোগ দিচ্ছে, কিন্তু কাশ্মীর সম্পর্কে মিথ্যে কুৎসা রটানোর ক্ষেত্রে মিডিয়া একটা বিরাট ভূমিকা নিয়েছে।’ (সুত্রঃ নিউজ ক্লিক, জুন ২০২২)। প্রদীপ ম্যাগাজিন তাঁর ‘নট জাস্ট ক্রিকেট’ বইতে নিজের অভিজ্ঞতা এবং বন্ধু বিবেক রায়নার মুখে শোনা তৎকালীন কাশ্মীরের কথা লিখেছেন। বিবেকের পরিবারও সেইসময় কাশ্মীর ছেড়ে চলে আসেন। সেই বইতে প্রদীপ লিখছেন, ‘আমি যতবার কাশ্মীরে গেছি, কাশ্মীরি পণ্ডিত হিসাবে সেখানে ঢুকতে বা মুসলমান নাগরিকদের সাথে মেলামেশা করতে আমার কোনও দিন অসুবিধা হয়নি।’ এই বইতে বিবেক রায়নার স্মৃতি উদ্ধৃত করে লেখক বলেছেন, যখন অশান্তি শুরু হল, দু-এক জন পণ্ডিত এবং মুসলিম জঙ্গিদের হাতে খুন হলেন, তখনও সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে পণ্ডিতদের আশ্বস্ত করে স্লোগান দিয়েছেন – ‘পণ্ডিত মুসলিম ভাই ভাই, ভারতিয় ফউজ কাঁহা সে আয়ি’ (পণ্ডিত মুসলিমরা পরস্পরের ভাই, এর মধ্যে ভারতীয় ফৌজ কোথা থেকে এল)। জনগণের নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত এই ভারতীয় ফৌজ কাশ্মীরের জনগণকে কি দৃষ্টিতে দেখত এবং কেমন সুরক্ষা দিত, তার জ্বলন্ত প্রমাণ বিবেকের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতায় গাওকদল হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা – ‘একদিন, ওদের তিনতলা বাড়ির বারান্দা থেকে বিবেক দেখল, হাজারখানেক লোক শ্রীনগরের গাওকদল ব্রিজের উপর মিছিল করছে। হঠাৎ তারা ভয়ে দৌড়াতে শুরু করল। জনতাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সিআরপিএফ গুলি চালাতে শুরু করল, অন্তত আঠাশ জন মারা গেল ( যদিও এই সংখ্যা নিয়ে মতভেদ আছে, কারও কারও মতে নিহতের সংখ্যা প্রায় ৩০০)। একটু পরে, বিবেকের কাকা, যিনি বাড়ির একতলায় থাকতেন তিনি দুধ কিনতে বেরোন এবং একজন সিআরপিএফ জওয়ান তাঁকে আটকায়। তিনি যখন বললেন, তিনি একজন কাশ্মীরি পণ্ডিত, তখন জওয়ানটি তাঁকে মেরে বলল– ‘কাশ্মীর কা কুত্তা ভি পাকিস্তানি হ্যায় (কাশ্মীরের কুকুরও পাকিস্তানি)।’ পণ্ডিতদের খুনের দৃশ্য যথাসম্ভব বিস্তারিত এবং পাশবিকভাবে দেখানোর জন্য বিবেক অগ্নিহোত্রী সাল-তারিখ নিয়েও তেমন মাথা ঘামাননি। যেমন, ২০০৩ সালে বাজপেয়ী সরকারের আমলে হওয়া নাদিমার্গ হত্যাকাণ্ড’কে তিনি অনায়াসে ৯০ এর দশকে জুড়ে দিয়েছেন। স্বভাবতই হরিদ্বার বা রায়পুরের ধর্মসংসদ থেকে মুসলিমদের গণহত্যার ডাক ওঠায় ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ভারতের যে প্রধানমন্ত্রী আপত্তি করেননি, তিনি এই ছবির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।
কাশ্মীরি পণ্ডিতদের নিয়ে ‘শিকারা‘ ছবি সরকারি আনুকুল্য পায়নি
‘কাশ্মীর ফাইলস’ কে ট্যা’ ফ্রি করার প্রসঙ্গে গুজরাট দাঙ্গার ওপর নির্মিত দুটি ছবির কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন অনেকেই। সেন্সর বোর্ডের অনুমতি থাকা সত্বেও রাহুল ঢোলাকিয়ার ‘পারজানিয়া’ (২০০৫) এবং নন্দিতা দাসের ‘ফিরাক’ (২০০৮) এই দুটি ছবিই গুজরাটে নিষিদ্ধ করা হয়, সিনেমা হলের মালিকরা ছবি দেখাতে অস্বীকার করে। এমনকি হাল আমলে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের নিয়েই নির্মিত আরেকটি ছবি ‘শিকারা’ও সরকারের এমন স্নেহধন্য হয়নি, কারণ পরিচালক সেখানে তাঁর মতো করে একটা মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পণ্ডিতদের ঘটনার নানা দিক তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন, হিন্দু-মুসলমান বৈরিতা তৈরি করে ঘৃণা ছড়াতে বসেননি। খুব সম্প্রতি এই ঘরছাড়া কাশ্মীরি পণ্ডিতদের নিয়েই ‘ঘর কা পতা’ নামে একটি শর্ট ফিল্ম মুক্তি পেয়েছে। পরিচালক মধুলিকা জালালি কাশ্মীরি পণ্ডিতকন্যা। নববই এর অশান্ত কাশ্মীর থেকে যখন মধুলিকা’র পরিবার চলে আসে, তিনি তখন খুব ছোট। কাশ্মীর তার কাছে ধরা দেয় মা-বাবা-দিদি’র স্মৃতিচারণে, টুকরো লেখালিখি, চিঠিপত্র, পুরনো পারিবারিক অ্যালবামে। এমন সব টুকরো স্মৃতি জড়ো করে কাশ্মীরে আসেন মধুলিকা ও তার বোনেরা, দেখা হয় ফেলে আসা পথঘাট, শহর আর সেই শহরের ফেলে আসা মানুষদের সঙ্গে। মধুলিকার বাবার মৃত্যুসংবাদ শুনে বৃদ্ধ মুসলমান প্রতিবেশী কেঁদে ফেলেন, তাঁর স্ত্রী বুকে জড়িয়ে ধরেন দুই বোনকে। পণ্ডিত-মুসলিম শত্রুতার চেনা ছকের বাইরে এই ছবি ভালোবাসা আর সম্প্রীতির কথা বলতে চেয়েছে। কাজেই ‘কাশ্মীর ফাইলস’ এর পৃষ্ঠপোষকদের পছন্দের তালিকায় এ ছবি জায়গা পায়নি। কাশ্মীরি পণ্ডিত পরিচালক সঞ্জয় কাক ছবিটির প্রশংসা করে বলেছেন, ‘আজকের ভারতে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের নিয়ে স্রেফ এক ধাঁচের আখ্যানই প্রাণপণে প্রচার করা হচ্ছে। সম্প্রীতি, সৌহার্দে্যর কথা বলার জন্য মূল ধারার ছবি ‘শিকারা’ও দক্ষিণপন্থীদের চক্ষুশূল। এখন ‘কাশ্মীর ফাইলস’ দিয়ে সার্বিক ভাবে কাশ্মীরি মুসলিমদের নিশানা করা হচ্ছে।’ মধুলিকার নিজের বক্তব্য, ‘‘কাশ্মীরের সত্যির মধ্যে অনেক পরত। কোনও সরকারই পণ্ডিতদের সুবিচার দিতে কিচ্ছু করেনি। ৩৭০ ধারা রদ করার পরেও পরিস্থিতি পাল্টায়নি।”
কাশ্মীর ফাইলস এর উগ্র সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা বা সমালোচনা যারা করেছেন, ‘গণতান্ত্রিক’ বিজেপি সরকার একেবারে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই তাদের জবাব দিয়েছে। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিংহ টুইট করে বলেছেন, সরকারের উচিত আইন প্রণয়ন করে কাশ্মীর ফাইল ছবিটি দেখা বাধ্যতামূলক করা। যারা ছবিটি দেখবেন না, তাদের জেল হওয়া উচিত এবং ছবিটির সমালোচনা করার শাস্তি হওয়া উচিত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। মধ্যপ্রদেশের আইএএস অফিসার নিয়াজ খান বলেছিলেন, ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ ছবিতে ব্রাহ্মণদের দুঃখ-যন্ত্রণা দেখানো হয়েছে। তাঁদের সসম্মানে এবং নিরাপদে কাশ্মীরে থাকতে দেওয়া উচিত। কিন্তু সারা ভারতবর্ষ জুড়ে যে বিরাট সংখ্যক মুসলিম খুন হচ্ছেন, তা নিয়েও প্রযোজকের সিনেমা বানানো উচিত। মুসলিমরা পোকামাকড় নন, তাঁরাও মানুষ এবং এই দেশের নাগরিক।’ এ কথা বলার জন্য নিয়াজ খান’কে শো-কজ নোটিশ ধরিয়েছে বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। অন্য দিকে রাজস্থানের আলোয়াড়ে এক দলিত যুবক প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উপর অত্যাচার দেখানো হয়েছে বলে ছবিটি করমুক্ত করা হয়েছে। অত্যাচার তো দলিত এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের উপরেও হয়। তাহলে ‘জয় ভীম’ (দলিত নিপীড়নের উপর নির্মিত একটি সাম্প্রতিক ছবি) এর মতো ছবিকে করমুক্ত করা হয় না কেন?’
কাশ্মীর ফাইলস বিভেদ তৈরির হাতিয়ার
কিছু মানুষ হয়ত প্রকৃত ইতিহাস না জেনে ভুল বুঝেছেন, আবার সিনেমার নামে শিল্পের নামে একটি সম্প্রদায়ের মানুষের বিরুদ্ধে এই ঘৃণার বেসাতি সচেতন মানুষ মেনে নেননি। তাঁরা প্রশ্ন করেছেন, কলম ধরেছেন। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের জন্য যারা সত্যিই সুবিচার চান, তাঁদের বুঝতে হবে এই পণ্ডিত বিতাড়ন কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। স্বাধীনতার সময় থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত কাশ্মীরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ভ্রান্ত সরকারি নীতি এবং তার পরিণতিতে শান্তিপূর্ণ উপত্যকার বুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর উত্থানের ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সহ কাশ্মীরের হাজার হাজার নাগরিকদের মতোই পণ্ডিতরাও পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন। সেদিনও যেমন ক্ষমতাসীন সরকার নিজের স্বার্থে এই ঘটনাকে হিন্দু-মুসলিম সংঘাতের চেহারা দিতে চেয়েছিল, আজও বুর্জোয়া শ্রেণির আশীর্বাদধন্য হয়ে তাদের তাঁবেদার যে দলই ক্ষমতায় বসুক, তারা পণ্ডিতদের পুনর্বাসন বা কাশ্মীর সমস্যার প্রকৃত সমাধান চাইবে না। সমস্যা বিভেদ জিইয়ে রেখে সামরিক দমনপীড়ন আরও বাড়াবে, অন্য দিকে নিজেদের ভোটবা’ ভরাতে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনে উস্কানি দেবে। আজ গুজরাটে ভয়ানক ধর্মীয় বৈষম্যের স্বীকার ৬০০ মুসলমান মৎস্যজীবী আদালতের কাছে স্বেচ্ছামৃত্যুর আর্জি জানিয়েছেন। আবার ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার আশায় পাকিস্তান থেকে আসা ৮০০ হিন্দু পরিবার ভারত সরকারের কাছ থেকে কোনও সহযোগিতা না পেয়ে নিঃস্ব হয়ে পাকিস্তানে ফিরে গেছেন।
হিন্দু-মুসলমান-শিখ-পণ্ডিত যাই হোক না কেন, এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার রক্ষক দলগুলোর কাছে সাধারণ মানুষের চোখের জলের কোনও মূল্য নেই। আর্থিক শোষণে নিষ্পেষিত মানুষ যখন ক্ষোভে ফেটে পডে, মাথা তুলে দাঁড়াতে চায় তখন জাতপাত ধর্মের জিগির তুলে সাধারণ মানুষকে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দিয়ে শাসক সেই ক্ষোভ চাপা দিতে চায়। মানুষ গড়ে ওঠার পথেই বাধা সৃষ্টি করতে চায়। বিজেপি সরকারের অচ্ছে দিনে’র কল্যাণে নাভিশ্বাস ওঠা ভারতবাসীর সামনে ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ও এমনই একটি বিভেদ তৈরির হাতিয়ার।