বাসভাড়া নিয়ে রাজ্য সরকার যে কৌশলী ভূমিকা নিয়ে চলেছে তাকে চরম নিন্দনীয় ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। সাধারণ মানুষকে রুজির সন্ধানে প্রতিদিন বাড়ির বাইরে বের হতে হচ্ছে। লোকাল ট্রেন বন্ধ। বাসই একমাত্র পরিবহণ। এদিকে তেলের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। বাসমালিকরা বাড়তি ভাড়া দাবি করছেন। সরকার ভাড়া না বাড়ানোর কথা জানিয়ে দিয়েছে। এই চিত্রনাট্যের আড়ালে কী ঘটছে তা জানেন বাসমালিক আর সাধারণ যাত্রীরা, সরকার নাকি তারপর আর কিছু জানে না। মালিকরা ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করছে। যাত্রীদের সাথে বাস কন্ডাক্টরদের বচসা লেগেই আছে। প্রথম স্টেজের ৭ টাকা ভাড়া ১০ টাকা, দ্বিতীয় স্টেজের ৯ টাকার ভাড়া এখন ১৫ টাকা। তারপরের স্টেজগুলি মালিকদের ইচ্ছামতো। যাঁরা দূর থেকে লোকাল ট্রেনে যাতায়াত করতেন তাঁদের একাধিক বাস পাল্টে গন্তব্যে পৌঁছতে হচ্ছে। ফলে ছোট সংস্থায় কাজ করা নিম্নআয়ের কর্মচারীদের যাতায়াতের জন্য যা খরচ করতে হচ্ছে তা প্রায় তাঁর দৈনিক মজুরির কাছাকাছি।
ভাড়াবৃদ্ধির খাঁড়া যখন মানুষকে প্রতিদিন এ ভাবে রক্তাক্ত করছে তখন রাজ্য সরকারের ভূমিকা কী? পরিবহণ মন্ত্রী বলেছেন, কেউ ভাড়া বেশি নিলে যাত্রীরা যেন বর্ধিত ভাড়ার টিকিট নিয়ে গিয়ে থানায় এফআইআর করেন। তা হলেই প্রশাসন বাসমালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। কী ভয়ানক কড়া প্রশাসন! কিন্তু ‘কেউ বেশি ভাড়া নিলে’ কেন? সব বাসেই যে বেশি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে তা কি মন্ত্রী কিংবা পরিবহণ দপ্তরের অজানা?
আর যদি তাই হয়, তবে তো দপ্তরটি এবং সেই দপ্তরের মন্ত্রীর থাকার আর বিশেষ প্রয়োজন নেই। দ্বিতীয়ত, বাসমালিকরা কত ভাড়া নিচ্ছে সে খবরটুকু রাখারও ক্ষমতা যে প্রশাসনের নেই, সেই প্রশাসনের কাছে যাত্রীরা অভিযোগ জানিয়ে সুরাহা আশা করতে পারে? আসলে সরকার চোরকে বলছে চুরি করতে, আর গৃহস্থকে বলছে সজাগ থাকতে!
এস ইউ সি আই (কমিউনিস্ট) অনেক আগেই রাজ্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছিল, সরকারি প্রতিনিধি, বাসমালিকদের প্রতিনিধি, বিশেষজ্ঞ এবং যাত্রী কমিটির প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কমিটি গড়া হোক। কমিটি বাস পরিষেবার আয়-ব্যয়ের হিসেব করে জনসমক্ষে রাখুক এবং সেই অনুযায়ী সরকার ভাড়া নির্ধারণ করুক। কিন্তু রাজ্য সরকার মূক এবং বধিরের ভূমিকায় অভিনয় করতে থাকল। তার বোঝা বইতে হচ্ছে রাজ্যের সাধারণ যাত্রীদের।
এ কথা ঠিক তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এত দাম বাড়ার কারণ কী? বিজেপি নেতা-মন্ত্রীরা বলছেন আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দাম বাড়াই এর কারণ। অথচ এটি একটি ডাহা মিথ্যে কথা। গত বছর লকডাউনের সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম শূন্যেরও নিচে চলে গিয়েছিল। সেই সময় ভারত সরকার বিপুল পরিমাণ তেল মজুত করে রেখেছিল। তা ছাড়াও গত বছর এপ্রিলে ব্যারেল প্রতি ১৯.৯০ ডলারে কিনেছে তেল। ২০১৪-তে অশোধিত তেল ছিল ব্যারেল পিছু ১৪০ ডলার। এ মাসের শুরুতে তা ৭০ ডলারেরও নিচে নেমে এসেছে। ফলে দেশে তেলের দামবৃদ্ধির কারণ হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারের দামের অজুহাত খাটে না। বাস্তবে এই দামবৃদ্ধির মূল কারণ, তেলের ওপর কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ও রাজ্যের তৃণমূল সরকারের চাপানো বিপুল কর ও সেস এবং তেল কোম্পানিগুলির বিপুল মুনাফা। ২০১৪ সালে পেট্রল ও ডিজেল থেকে কর বাবদ কেন্দ্রীয় সরকারের আয় ছিল গোটা কর বাবদ মোট রাজস্ব আয়ের ৫.৪ শতাংশ। এখন তা হয়েছে ১২.২ শতাংশ। গত অর্থবর্ষে তেলের শুল্ক খাতে সরকারের আয় হয়েছে ৩.৩৫ লক্ষ কোটি টাকা, যা এক বছর আগে ছিল ১.৭৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ তেলের উপর কর থেকে আয় বেড়েছে ৮৮ শতাংশ।
এ বার দেখা যাক বিজেপি সরকার তেলের উপর ট্যাক্স কী পরিমাণে বাড়িয়েছে। ২০১৪ সালে কেন্দ্রীয় সরকার পেট্রলে ট্যাক্স নিত ৯ টাকা ৪৮ পয়সা, ডিজেলে নিত ৩ টাকা ৫৬ পয়সা। ২০২১-এ নিচ্ছে যথাক্রমে ৩২ টাকা ৯০ পয়সা ও ৩১ টাকা ৮০ পয়সা।
পেট্রলে মোট ট্যাক্সের কেন্দ্র পায় ৬৩ শতাংশ এবং রাজ্য পায় ৩৭ শতাংশ। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকারের মতো না হলেও রাজ্য সরকারও ট্যাক্স হিসাবে কম টাকা রোজগার করে না। যতই তেলের দাম বাড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের মতো রাজ্য সরকারের প্রাপ্যও ততই বেড়ে চলে। তাই শুধু তৃণমূল সরকারই নয়, কোনও রাজ্য সরকারকেই তেলের দাম বৃদ্ধির বিরোধিতা করতে দেখা যায় না।
যে প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তা হল, রাজ্য সরকার জনসাধারণকে এই ভাড়াবৃদ্ধির বোঝা থেকে রেহাই দিতে চায় কি না। চাইলে নিজেরা যেমন তেলের উপর চাপানো ট্যাক্স কমাত, তেমনই যে কোনও উপায়ে কেন্দ্রীয় সরকারকেও বাধ্য করত ট্যাক্স কমাতে। তা ছাড়া অন্যান্য নানা উপায়ে বাসমালিকদের উপর থেকে আর্থিক চাপ কমিয়েও ভাড়ার তালিকাকে স্থির রাখা যেত। পাশাপাশি ভরতুকি দিয়েও ভাড়া সঙ্কট সমাধান করা যেত। কিন্তু যাত্রীস্বার্থ অপেক্ষা বাসমালিকদের স্বার্থকে রাজ্য সরকার বড় করে দেখে বলেই এমন মূক ও বধিরের ভূমিকায় অভিনয় করে চলেছে।