পরাজয় আশঙ্কা করে শেষপর্যন্ত বাল্যবিবাহ চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজস্থানে ভোট চাইল বিজেপি৷ একটা পার্টি আদর্শগতভাবে কতটা দেউলিয়া হলে এমন প্রতিশ্রুতি দিতে পারে৷ দেশে এই কুপ্রথার শিকার হাজারো মেয়ের দুঃখ–কষ্ট দেখে স্বাধীনতা আন্দোলনের মনীষীরা তা বন্ধ করার জন্য পথে নেমেছিলেন৷ এদেশে একদিন এই কুপ্রথার বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ রামমোহন রায়৷ এই প্রথা বন্ধ করতে একসময় মানুষের দোরে দোরে ঘুরে বেড়িয়েছেন বিদ্যাসাগরের মতো মহান মনীষী৷ এর জন্য বহু বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাঁদের৷ সমাজপতিরা হুঁশিয়ারি দিয়েছে, বাল্যবিবাহের মতো দীর্ঘদিনের প্রচলিত ‘পবিত্র’ প্রথাকে হঠালে হিন্দু সমাজ অপবিত্র হয়ে যাবে৷ সেই কুপ্রথাকেই নির্বিঘ্ণে চালানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজস্থানের এক বিজেপি নেত্রী ভোট চাইলেন৷
রাজস্থানের মতো শিক্ষা–চিকিৎসা, দৈনন্দিন জীবনমানে পিছিয়ে থাকা রাজ্যে ভোট প্রচারে গিয়ে বিজেপি প্রার্থী যদি বলতেন, নারীশিক্ষার প্রসার ঘটাব, নারী নির্যাতন বন্ধ করব– সেটাই হত মানুষের যথার্থ কল্যাণ৷ তা না করে পুরনো বস্তাপচা সমস্ত অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, কুপ্রথাকে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কয়েক যুগ পিছিয়ে দিতে চাইছেন রাজ্য তথা দেশকে৷ দেশ জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে– আশার কথা এটাই৷
ন্যাশনাল কমিশন ফর প্রোটেকশন অব চাইল্ড রাইটস–এ প্রকাশিত রিপোর্ট বলছে, রাজস্থানে বাল্যবিবাহ সবচেয়ে বেশি৷ ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও বাল্যবিবাহ প্রথা চালু রয়েছে৷ কী বিজেপি, কী কংগ্রেস যে যখনই ক্ষমতায় থাক না কেন, ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার জাত কোনও কুপ্রথার বিরুদ্ধেই টুঁ শব্দটি করেনি, এগুলি টিকিয়ে রেখে ভোটব্যাঙ্ক তৈরির খেলাই খেলেছে৷ তাতে হাজার হাজার বালিকার জীবন নষ্ট হয়ে যাক, তাদের কিছুই যায় আসে না৷ রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশের মতো রাজ্যে অক্ষয় তৃতীয়ায় শত শত ছেলেমেয়ের গণবিবাহের যে আয়োজন বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনগুলি করে, তার পুরোটাই ১২–১৬ বছর বয়সীদের মধ্যে৷ এরকম বহু জায়গায় আয়োজিত বাল্যবিবাহের পৃষ্ঠপোষক শাসক দল কিংবা বিরোধী ক্ষমতাপিপাসু দলগুলি৷ সম্প্রতি ইউনিসেফের রিপোর্ট বলছে, ভারতে ১৫ লক্ষ মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় ১৮ বছরেরও কম বয়সে৷ এই সমস্ত বালক–বালিকাদের যে কী পরিমাণ দৈহিক এবং মানসিক ক্ষতি হয় তা পরবর্তী জীবনে এদের ধুঁকতে থাকা জীবনধারণ লক্ষ করলে যে কেউ বুঝতে পারবে৷ শুধু তাই নয়, অল্পবয়সে বিয়ে হওয়ায় প্রসবের সময় অনেকেরই শারীরিক জটিলতা সৃষ্টি হয়, এমনকী প্রাণসংশয় পর্যন্ত হয়ে থাকে৷
প্রহিবিশন অব চাইল্ড ম্যারেজ অ্যাক্ট–২০০৬ (বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ আইন) চালু রয়েছে৷ কিন্তু তাতেও দেখা যাচ্ছে, বাল্যবিবাহের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান৷ একদিকে দারিদ্র, অন্যদিকে শিক্ষার অভাব বাল্যবিবাহের মতো সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দেয় বহু সময়ই৷ আবার বর্তমান সময়ে মেয়েদের নিরাপত্তার অভাববোধ থেকে বহু অভিভাবক ভাবেন, মেয়েদের বিয়ে দিলে তারা সুরক্ষিত থাকবে৷ যদিও বিয়ের পরও মহিলারা গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হন৷
আধুনিক জীবন মানে যে শুধু আধুনিক গ্যাজেট, মোবাইল ফোন ব্যবহার নয়– উন্নত আধুনিক জীবনচর্চা এবং চিন্তাই যে জীবনের লক্ষ্য এ কথা দেশের ছেলেমেয়েদের শেখানোর কোনও চেষ্টাই ভোটবাজ দলগুলির নেই৷ ভোটের জন্য শুধু বাল্যবিবাহ কেন, কংগ্রেস–বিজেপি সতীদাহ, পণপ্রথার বিরুদ্ধেও কোনও কথা বলা দূরে থাক, বহু ক্ষেত্রে এসবেরও পৃষ্ঠপোষক৷
বাস্তবে আজ আর নারীর স্বাধীনতা কিংবা নারীমুক্তির ভাবনার প্রসার ঘটানো এই দলগুলির পক্ষে সম্ভব নয়৷ পচে যাওয়া পুঁজিবাদী সমাজের রক্ষক কোনও দলের পক্ষেই সম্ভব নয়৷