সাম্প্রতিক সময়ে একটা বিতর্ক গোটা পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে চলছে। সৌজন্যে– সিপিআই(এম) দলের ২৮ ফেব্রুয়ারি ব্রিগেড সমাবেশের প্রচার উপলক্ষে প্রকাশিত একটি চটুল গানের প্যারডি ‘এই টুম্পা ব্রিগেড চল’ শীর্ষক অডিও-ভিডিও।
গানটি নিয়ে হইহই চলছে। এই নিয়ে একটা আড়াআড়ি বিভাজনও হয়ে গেছে। বিভাজনটা যে শুধু বাইরে ঘটেছে তা নয়, সিপিআই(এম) দলের অভ্যন্তরেও বিভাজনটা খুব স্পষ্ট। সমাজমাধ্যমে চোখ রাখলেই তা বোঝা যায়। সেখানে দেখা যাচ্ছে, যারা এই ‘মহত্তম রচনা’র পক্ষে বলছেন তাদের বলা হচ্ছে ‘প্রগতিশীল’, আর যারা এর বিপক্ষে তাদের দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘জ্যাঠামশাই’ বলে। অন্তত সৃষ্টিকর্তারা এমনটাই ঠাওরেছেন। নিজের বিবেক, বোধ, শিক্ষা, রুচি, চেতনা ইত্যাদি যা কিছু এই ৩০ বছরের বেড়ে ওঠায় সযত্নে লালিত পালিত হয়ে একটা কাঠামো পেয়েছে তার নিরিখে বিষয়টা একটু বিবেচনা করা যাক।
বামপন্থা, লাল পতাকা, লাল তারা, কাস্তে হাতুড়ি, সমাজতন্ত্র, লাল সেলাম, কমরেড ইত্যাদি শব্দগুলির সাথে প্রাথমিকভাবে গভীর যত্নের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন যিনি, তিনি আমার বাবা এবং যিনি এখনও একজন সিপিআইএম কর্মী। বাবার হাত ধরেই প্রথম শ্রমজীবী মানুষের মিছিলে হেঁটেছি। তখন কিছুই বুঝতাম না। কিন্তু একটা আকর্ষণ টানত খুব। দুই সারির মিছিলে বাবা মাঝে থেকে স্লোগান দিচ্ছে ‘কাস্তে হাতুড়ি কাস্তে, তারা হাতুড়ি বাঁচতে’ আর বাবার পাশে আমিও হাঁটছি। মিছিল শেষ হচ্ছে যেখানে সেখানে তখন বক্সে বাজছে ‘আহবান শোনো আহবান… আসে মাঠঘাট…..’– কেমন যেন একটা দোলা লাগত। কিন্তু বয়সের নিরিখে তা উপলব্ধি করার স্তরে তখনও পৌঁছাইনি। কিন্তু গহীন মনে তা একটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে নিয়েছিল। কোনও এক সকালে চা খেতে খেতে বাবা লেনিনের সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে দিয়েছিলেন নিজের গলায় ‘ভেদি অনশন মৃত্যু তুষার তুফান….’ গাইতে গাইতে। মনের ভিতরের জমিটা এভাবেই লাল টুকটুকে হয়েছে।
২০০১ সালে ষষ্ঠ বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আমাদের ‘ভাটিয়া বাড়ির ছাদে’ তার ‘বিজয় উৎসব’ পালন করা হয়েছিল। সেখানে বাবার দলের একজন অতি উৎসাহী কমরেড একটি জনপ্রিয় বাংলা ছায়াছবির চটুল গান বক্সে বাজিয়ে দিয়েছিলেন। তা শোনামাত্র বাবা তা বন্ধ করে দিয়ে তাকে কড়া সুরে শুনিয়েছিল, ‘আমরা বামপন্থী, আমাদের একটা রুচি আছে। সবকিছুকে গুলিয়ে ফেলো না’– বাবার এহেন আচরণ সেদিন রুচির একটা ধারণা তৈরি করতে সাহায্য করেছিল বৈকি।
সময়ের পরিবর্তনে বামপন্থী রাজনীতির সাথে নিজেও জড়িয়েছি। সেই বামপন্থী রাজনীতি শিখিয়েছে রাজনীতি একটি উচ্চ হৃদয়বৃত্তি, আর বিপ্লবী রাজনীতি উচ্চতর হৃদয়বৃত্তি’। ফলে কোনও কিছু সম্পর্কে বিচার প্রক্রিয়াতে এই দৃষ্টিভঙ্গিকেই পাথেয় করি। সবসময় যে পারি বা পেরেছি তা নয়। কিন্তু দিক নির্দেশনার ক্ষেত্রে এটাই কম্পাস।
কয়েক বছর আগে ফেসবুকে একটি গ্রুপে রাজনৈতিক বিতর্কের নামে গালাগালি চলছিল। সেখানে একটা সময় ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে এবং নিজেও প্রতিপক্ষকে কটূক্তি সহকারে আক্রমণ করে বসি। সঙ্গে সঙ্গে আমার ইনবক্সে এক কমরেড দাদার একটি টেক্সট মেসেজ ঢোকে। তিনি লিখেছিলেন, ‘বামপন্থা কোনও কৌশল নয়, বামপন্থা একটা সংস্কৃতি। তাকে প্রতি মুহূর্তে লালন করতে হয়।’ ব্যাস। ওইটুকুই সেদিন ছিল বার্তা। বোঝার স্তর পেরিয়ে কতটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছি তা সময় বলবে।
স্মৃতি এবং অভিজ্ঞতা কখনও বিশ্বাসঘাতকতা করে না। বরং সাহায্যই করে দুঃসময়ে। সময়টা দুঃসময়-ই। ‘এই টুম্পা ব্রিগেড চল’ থেকে ‘হাতে হাত’ রেখে ‘ভাইজানের দোস্তি’, সবটা মিলে ঘোর দুঃসময়। কিন্তু সত্যের পক্ষে যে অবস্থান নিতেই হবে। সস্তায় জনপ্রিয়তা অর্জন সহজভাবেই করা যায়। কিন্তু সেটা সস্তাই থাকে। যুগের তালে তাল মেলাতে গিয়ে প্রগতিশীলতার দোহাই পেড়ে যারা সস্তার জিনিস নিয়ে ফেসবুকের দেওয়াল থেকে রাস্তার মোড়ে হরবখত ঢক্কানিনাদ করছেন, তারা আর যাই হোক বামপন্থার প্রচার করছেন না। বরং তার সর্বনাশই করছেন। তাই সোচ্চারেই বলতে হবে… ‘বামপন্থা কোনও কৌশল নয়, বামপন্থা একটা সংস্কৃতি’।
সৌপ্তিক পাল, কলকাতা-৫