এবারের বাজেটে শিক্ষা খাতে ৬.১৩ শতাংশ বরাদ্দ কমিয়ে দিল কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকার। টাকার অঙ্কে কমল ৬০৮৮ কোটি টাকা, যার মধ্যে স্কুলশিক্ষায় ৪৯৭১ কোটি ও উচ্চশিক্ষায় ১১১৫ কোটি টাকা কমানো হয়েছে।
শিক্ষার উপর এই বাজেট গভীর আঘাত করেছে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে তারা স্বপ্ন দেখিয়েছিল, শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়বে, সরকার শিক্ষার জন্য জিডিপি-র ৬ শতাংশ খরচ করবে। তার পরিবর্তে এই বাজেটে শুধু বরাদ্দ কমানো হয়েছে তাই নয়, জাতীয় শিক্ষানীতির মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থার খোলনলচে পাল্টে নতুন করে সাজানোর নামে তাকে সম্পূর্ণভাবে পুঁজিমালিকদের হাতে তুলে দেওয়ার সুচতুর পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ঘটানো হয়েছে। পরিকাঠামো উন্নয়নের গালভরা কথা বলেও আর্থিক দায়িত্বের কথা উঠতেই সরকার নিজের দায়িত্ব ছেড়ে বেসরকারি মালিক ও ‘স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের’ ধুয়ো তুলেছে।
এই বাজেটের পর ‘শিক্ষার অধিকার’ কথাটি আরও বেশি অর্থহীন হয়ে পড়ল। কারণ এই বরাদ্দের মধ্যে শিক্ষক নিয়োগ, পরিকাঠামো উন্নয়ন– কোনও কিছুই সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী ঢাক পেটান– ‘বেটি পড়াও’। কত বরাদ্দ তাতে? ‘ন্যাশনাল স্কিম ফর ইনসেনটিভ টু গার্লস’-এর জন্য বরাদ্দ মাত্র ১ কোটি টাকা (২৫৬ কোটি ছিল ২০১৮-১৯-এ)। প্রসঙ্গত, ২০১৬-‘১৭ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমাদের দেশের ১ লক্ষ ৮ হাজারের বেশি স্কুলে একজন করে শিক্ষক আছেন।
এগুলির মধ্যে ৮৫,৭৪৩টি প্রাইমারি স্কুল। দেশের মাত্র ৫৪ শতাংশ স্কুলে শৌচাগার ও পানীয় জলের সুবিধা রয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি যথাযথ বজায় রাখার জন্য প্রয়োজন ছিল সমস্ত স্কুলে পানীয় জল, শৌচাগার সহ অন্যান্য ব্যবস্থা করার। অথচ সরকার তা করেনি। তারা এমনকি গত বাজেটের বরাদ্দ ১৪ হাজার ২২৩ কোটি টাকা খরচও করতে পারেনি!
স্কুলশিক্ষায় বরাদ্দ মাত্র ৫৪,৮৭৪ কোটি টাকা। দেশের ১০ লক্ষ ৮৩ হাজার ৬৭৮ টি স্কুলের মধ্যে (১৪-০৯-২০২০ লোকসভায় প্রদত্ত তথ্য) অর্থমন্ত্রী মাত্র ১৫,০০০ টির পরিকাঠামো উন্নয়নের কথা বলেছেন। কিন্তু তার জন্য কোনও অর্থ বরাদ্দ করেননি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ১০০টি সৈনিক স্কুল খোলার প্রস্তাব রাখা হয়েছে বাজেটে। তবে এই স্কুলগুলি চলবে ব্যক্তিমালিক এবং এনজিও-র সাথে অংশীদারিত্বে। অর্থাৎ জনগণের অর্থে নির্মিত স্কুলে অবাধ মুনাফা লুট করার অধিকার দেওয়া হচ্ছে বেসরকারি মালিকদের।
স্কুল পূর্ববর্তী শিক্ষা বা ‘প্রি-স্কুল এডুকেশন’ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এই বাজেটে। তাতে প্রযুক্তিনির্ভর ‘আর্লি চাইল্ডহুড কেয়ার অ্যান্ড এডুকেশন’ (ইসিসিই)-র নিদান দেওয়া হয়েছে। অথচ এই প্রযুক্তিনির্ভর উন্নত শিশু শিক্ষা দিতে পারার পরিকাঠামো তৈরি করার বরাদ্দ নেই বাজেটে। তাহলে এগুলি গড়তে পারবে কারা? ইতিমধ্যেই প্রি-স্কুলে বিনিয়োগ করা কর্পোরেট কোম্পানিগুলিই নয় কি? সরকার জাতীয় শিক্ষানীতিতে গ্রামীণ ‘প্রি-স্কুল’ শিক্ষার জন্য অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের কথা বলেছিল। কিন্তু বাজেটে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলির নূ্যনতম পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য কিছুই ঘোষণা করা হয়নি। ফলে নিঃসন্দেহেই প্রি-স্কুল শিশুশিক্ষা পুরোপুরি বেসরকারি মালিকদের হাতের মুঠোতেই আবদ্ধ হবে। আদিবাসী এলাকায় পূর্ণাঙ্গ স্কুলের বদলে এক শিক্ষকের ‘একলব্য’ স্কুল হবে। ফলে পিছিয়ে পড়া এলাকার ছাত্রদের শিক্ষা কার্যত প্রহসনে পরিণত হতে চলেছে। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০-র সুপারিশ অনুযায়ী অনলাইন শিক্ষায় জোর দিতে ‘ডিজিটাল এডুকেশন আর্কিটেকচার’ তৈরির কথা বলা হয়েছে। শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কমিয়ে শিক্ষাকে ‘ডিজিটালাইজ’ করার প্রচেষ্টা শিক্ষার বেসরকারিকরণেরই একটি পদক্ষেপ মাত্র। এর ফলে অনলাইন শিক্ষা-বেচা কর্পোরেট কেম্পানি ও জিও-র মতো টেলিকম কোম্পানিগুলির বিপুল লাভ হবে। কিন্তু গরিব ঘরের ছাত্রছাত্রীরা ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, ল্যাপটপের খরচ জোগাতে না পেরে শিক্ষা থেকে দূরে চলে যাবে।
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মাত্র ৩৮,৩৭১ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে বাজেটে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বাজেটে প্রস্তাব করেছেন, এই ঘাটতি মিটবে শিক্ষায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ এবং বিদেশি প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে। গবেষণার ক্ষেত্রে ‘ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন’ গড়ে সরকারই ঠিক করে দেবে কোন গবেষণা হবে, কোনটা নয়। সমস্ত ধরনের গবেষণার হাত-পা বেঁধে ফেলা হচ্ছে, যাতে গবেষণাকেও মালিক শ্রেণির মুনাফা লাভের স্বার্থে ব্যবহার করা যায়। গবেষণার নামে ঐতিহ্যবাদ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন কূপমণ্ডুক চিন্তা, বিজ্ঞানের নামে কল্পবিজ্ঞানকে জায়গা করে দেওয়া হচ্ছে।
জাতীয় শিক্ষানীতির মিষ্টি কথার আড়ালে আসলে যে রয়েছে বিজেপি সরকারের শিক্ষাকে ধ্বংস করার সার্বিক বেসরকারিকরণ ও কর্পোরেটকরণের গোপন অভিপ্রায়। এই কেন্দ্রীয় বাজেট এটাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।