পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিয়মেই ভারতের বিভিন্ন উৎপাদন ক্ষেত্রে এখন মুষ্টিমেয় বৃহৎ পুঁজিপতিরই একাধিপত্য। গাড়ি শিল্পের কথাই ধরা যাক। এই বাজারে আধিপত্য কায়েম করেছে– মারুতি-সুজুকি এবং হুন্ডাই। দুটিরই মালিকানা বিদেশি। দেশে প্রতি ১০টা গাড়ি বিক্রির মধ্যে ৬টিই এই দুই সংস্থার। ভারতের সর্ববৃহৎ অটোমোবাইল সংস্থা টাটা মোটর। এই তিনটি পুঁজিগোষ্ঠী ভারতের গাড়ি বাজারের প্রায় ৭০ শতাংশ কব্জা করে রেখেছে।
একই চিত্র দেখা যাচ্ছে টু-হুইলারের ক্ষেত্রে। এখানেও তিনটি কোম্পানি পুরো বাজারের তিন চতুর্থাংশ কব্জা করে রেখেছে। হিরো, হোন্ডা এবং টিভিএস মোটর। এর মধ্যে হিরো এবং টিভিএস এর মালিকানা ভারতীয়, হোন্ডার মালিকানা জাপানি।
যন্ত্রাংশ উৎপাদনেও একচেটিয়া আধিপত্য অল্প কিছু কোম্পানির। ভারতের মোবাইল ফোন শিল্পেও চিনা আধিপত্য– চিনের কোম্পানি জিয়াওমি, ভিভো, রিয়ালস, ওপো, ওয়ানপ্লাস ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে ফেলেছে। এর সাথে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার সংস্থা স্যামসাং। এই কোম্পানিগুলি ২০২২ সালের মধ্যে মোবাইল ফোন বাজারের ৭০ শতাংশ দখল নিয়েছে। স্মার্ট টিভির বাজারে আধিপত্য কায়েম হয়েছে জিয়োমি, স্যামাসাং এবং এল জি-র।
ভারতীয় পুঁজিপতিদের আধিপত্য কায়েম রয়েছে কোর ইন্ডাস্ট্রিতে। যেমন স্টিল। এখানে জেএসডব্লু স্টিল, সেইল, টাটা স্টিল এবং জেএসপিএল অর্ধেকের বেশি বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এর মধ্যে তিনটিই ব্যক্তি মালিকানাধীন, একটি সরকারি। স্টিলের মতোই সিমেন্ট শিল্পেও চারটি ভারতীয় সংস্থার দখলে অর্ধেক বাজার। অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রেও একই ভাবে একচেটিয়াকরণ হয়েছে।
পরিষেবা ক্ষেত্রেও কায়েম হয়েছে কোনও কোনও কোম্পানির একচ্ছত্র দখলদারি। এর মধ্যে অনলাইন পরিষেবার একচেটিয়া প্রভাব কায়েম রয়েছে বিপুল পুঁজির অধিকারী বিদেশি কোম্পানিগুলির। টেলিকম ক্ষেত্রটির দখল নিয়েছে দু’টি সংস্থা জিও এবং এয়ারটেল। টেলিকম মার্কেটের দুই তৃতীয়াংশ এই দু’টি সংস্থার দখলে। বিমান পরিবহণেও দু’টি সংস্থা– ইন্ডিগো এবং টাটা। এরা অভ্যন্তরীণ বাজারের ৮০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। বেসরকারি ব্যাঙ্কের ক্ষেত্রেও– এইচডিএফসি, আইসিআইসিআই, অ্যাক্সিস ব্যাঙ্ক, যাদের মালিকানার ভাল অংশ বিদেশি নিয়ন্ত্রণে, এদের প্রভাব দেখা যাচ্ছে। খুচরো ব্যবসাতে একই চিত্র। এখানে অ্যামাজন এবং ফ্লিপকার্ট একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছে। পেমেন্ট মার্কেটে আধিপত্য ফোন পে, গুগল পে-এর, ফুড ডেলিভারিতে জোম্যাটো এবং সুইগির, যাত্রী পরিবহণে ওলা এবং উবেরের।
অর্থনীতিতে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েমের পরিণামে প্রতিযোগিতা অল্প কয়েকজন বিক্রেতার বা কোম্পানির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এই একচেটিয়া মালিকদের হাতেই থাকে বাজারে পণ্যের দাম যেমন খুশি বাড়ানোর ক্ষমতা। এই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েই তারা পণ্যের দাম বাড়িয়ে সুপার প্রফিট করে। অনেক সময় এই কোম্পানিগুলি নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে সবাই একসঙ্গে একই হারে দাম বাড়ায়। ফলে ক্রেতাদের কাছে কোনও বিকল্প থাকে না। এতে বিপন্ন হয় ক্রেতাস্বার্থ। বিপুল পুঁজির অধিকারী এই একচেটিয়া মালিকরা শ্রমিক স্বার্থকেও বিপন্ন করে। পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সাপেক্ষে মজুরি বৃদ্ধি না করে, এরা শ্রমিককে দুঃসহ অবস্থায় ফেলে দেয়। এই একচেটিয়া মালিকরা বহু ক্ষেত্রে কাজের সময় বাড়িয়ে দিয়ে শ্রমিকের মজুরি আনুপাতিক হারে কমায়। এই একচেটিয়াকরণ পুঁজিবাদী অর্থনীতিরই স্বাভাবিক নিয়ম। ফলে পুঁজিবাদ, যার উপরই দাঁড়িয়ে থাকে একচেটিয়া পুঁজিবাদ, তা সাধারণ মানুষের জীবনে আর্থিক সংকট বাড়িয়ে দেয়।
অর্থনীতিতে এর উল্টো প্রভাবও লক্ষণীয়। সুপার প্রফিট করতে গিয়ে যে পরিমাণে বা যে মাত্রায় শ্রমিক বা ক্রেতা শোষণ পুজিপতিরা চালায়, সেই পরিমাণে বাজার সংকট দেখা দেয়। অর্থনীতিতে বাজার সংকট মানেই নতুন নতুন শ্রমনিবিড় শিল্প না হওয়া। পাশাপাশি বহু শিল্পেই লালবাতি জ্বলা। এই হল পুঁজিবাদী অর্থনীতি যে সুপার প্রফিট না করে বাঁচতে পারে না। আবার সুপার প্রফিট করতে গিয়ে অর্থনীতির সামনে সংকট তৈরি করে। পুঁজিবাদী অর্থনীতি এভাবেই অনিরসনীয় সংকটের জালে আটকে গেছে। এখান থেকে অর্থনীতিকে আরও গভীর সংকটে ফেলছে। পুঁজিবাদী অর্থনীতির আসন্ন মৃত্যু সংকেত এই সংকটের গভীরেই দেখা যাচ্ছে।
(তথ্যসূত্রঃ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১৭ এপ্রিল২০২৩)