মাঝেরহাট ব্রিজ ভাঙার রেশ কাটতে না কাটতেই আবার এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড এবং তা নিয়ে দায় ঠেলাঠেলির পর্ব চলছে৷ চার দিন ধরে জ্বলতে থাকা কলকাতার বড়বাজারের বাগড়ি মার্কেটের আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমশিম খেয়েছে দমকল বাহিনী৷ এই অগ্নিকাণ্ডে সরাসরি কোনও প্রাণহানির খবর না থাকলেও প্রায় এক হাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, বেশ কয়েক হাজার দোকান কর্মচারী, মুটে–মজদুর তাঁদের রুজি–রোজগার হারিয়েছেন৷ ঠেলাঠেলির পর্বে এবার অবশ্য একটু নতুনত্ব আছে৷ রাজ্য সরকারেরই পূর্তমন্ত্রী অন্য এক মন্ত্রীর হাতে থাকা দমকল দফতর এবং কলকাতা পৌরসভার গাফিলতির দিকে আঙুল তুলেছেন৷ কিন্তু এতবড় একটা ঘটনার চারদিন পরেও বাজারের মালিকপক্ষের কেউ গ্রেপ্তার হওয়া দূরে থাক, পুলিশ যতক্ষণে তাঁদের খোঁজার চেষ্টা শুরু করার কথা ভেবেছে ততক্ষণে তাঁরা উধাও৷এমনকী প্রধান মালিক ইউরোপে পালিয়েছেন বলেও শোনা যাচ্ছে৷
আগুন লাগার পর থেকে যত সময় এগিয়েছে, ততই প্রকট হয়েছে দমকল, পুলিশ, সাধারণ প্রশাসনের মধ্যে বোঝাপড়ার চূড়ান্ত অভাব৷ তার সাথে প্রকট হয়ে উঠেছে সরকারের শোচনীয় সিদ্ধান্তহীনতা৷ মুখ্যমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে যাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ছিল সেই মন্ত্রীগোষ্ঠী দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া, প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর সাহায্য নেওয়া এসব দূরে থাক, আগুন লাগার পর প্রথম কয়েক ঘন্টার সবচেয়ে মূল্যবান সময়েই দিশাহীনভাবে এলোমেলো কথা বলতেই ব্যস্ত ছিলেন৷ এমনকী মাথার উপরে থাকা তারের জাল কেটে দমকলের আধুনিক মই লাগানোর জন্য সিইএসসি–র সাথে সমন্বয়টুকু করাও কি বিরাট কোনও বিষয় ছিল? এটার জন্যও নাকি সিদ্ধান্ত নেওয়ার লোক ছিল না!
প্রশ্ন উঠছে, বাগড়ি মার্কেট যে কার্যত জতুগৃহ হয়ে রয়েছে তা কি সরকারি কর্তারা জানতে পারলেন আগুন লাগার পর নাহলে ঠিক দু’মাস আগে তাঁরা বাগড়ি মার্কেটকে ‘শর্তসাপেক্ষে’ ছাড়পত্র দিলেন কী করে? জানা কথা, সাধারণ মানুষ যে অনিয়ম খালি চোখেই দেখতে পান, বিশেষ বিশেষ কিছু কারণে সরকারি আধিকারিকরা তার কিছুই দেখতে পান না যদিও এক্ষেত্রে তাঁরা নাকি দেখেওছিলেন যে বাগড়ি মার্কেটে আগুন থেকে বাঁচার সুরক্ষা ব্যবস্থা আদৌ নেই৷ তাঁদের নিশ্চয়ই একথাও জানা ছিল, এই বাজারে প্রসাধনী, ডিওডোরেন্ট, ওষুধ, প্লাস্টিক ইত্যাদির প্রচুর দোকান আছে৷ এই বস্তুগুলি কতটা দাহ্য তাও তাঁদের অজানা থাকার কথা নয় তবু কোনও এক অদৃশ্য কারণে এক বছরের মধ্যে সুরক্ষা ব্যবস্থা হবে এই ‘শর্তসাপেক্ষে’ তাঁরা বাগড়ি মার্কেটের মালিকপক্ষের প্রতি ‘অগাধ বিশ্বাসে’ এই বাজারে ট্রেড লাইসেন্স নবীকরণ, নতুন ব্যবসা শুরু করার ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছিলেন৷ যদিও আইন অনুসারে আগুন থেকে সুরক্ষার ব্যবস্থা না করলে একদিনের জন্যও ছাড়পত্র দেওয়া যায় না৷ কলকাতার ৩৭টি বাজার নাকি এভাবেই ছাড়পত্র পেয়ে গেছে৷সরকারি আমলা এবং কর্পোরেশনের আধিকারিক ও মন্ত্রীরা আইনকে বুড়ো আঙুল দেখাতে এত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন কেন? তার অন্যতম কারণ যে টেবিলের তলার লেনদেন তা বলে দিতে হয় না৷ সেই লেনদেনের আশীর্বাদ যে সরকারের সব স্তরে পৌঁছায়, তাও সুবিদিত৷
মুখ্যমন্ত্রী বিদেশ থেকে ব্যবসায়ীদের ‘গুন্ডা’ বলে দায় সেরেছেন৷ কিন্তু তাঁর সরকারের দমকল দপ্তর, পূর্ত দপ্তর, পুলিশ, তাঁর দল পরিচালিত কলকাতা কর্পোরেশন একটা গুরুত্বপূর্ণ বাজারে এমন মারাত্মক জতুগৃহ–দশা দেখেও এক বছর ঘুমিয়ে থাকতে পারে কী করে, যারা এমন বেআইনি ছাড়পত্র দিল, তাদের শাস্তির কী হবে? বেআইনিভাবে তলার পর তলা বাড়ানো হয়েছে, সিঁড়ি, ল্যান্ডিং স্পেস থেকে শুরু করে শৌচাগার পর্যন্ত ভাড়ায় দিয়ে বাজারের মালিকপক্ষ যথেচ্ছ মুনাফা লুটেছে৷ এগুলি কী করে সরকারের অগোচরে ঘটে, বিশেষত যেখানে কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র এবং দমকল মন্ত্রী একই ব্যক্তি?
আগুন লাগার পর দেখা গেছে বাগড়ি মার্কেটের রিজার্ভারে আদৌ জল নেই৷ অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র, ফায়ার অ্যালার্মের সাথে যুক্ত জল ছড়ানোর স্প্রিঙ্কলার, হোসপাইপ এগুলি কোনওটিই কাজ করেনি৷ অথচ এগুলির জন্য বাজারের মালিকগোষ্ঠী প্রত্যেক দোকানদারের কাছ থেকে প্রচুর টাকা নিয়েছে মাসের পর মাস৷ এই ব্যবস্থাগুলি কেজো না অকেজো তা দমকল কোনওদিন খুঁটিয়ে পরীক্ষা করারও প্রয়োজন বোধ করেনি কেন? কাদের স্বার্থ এক্ষেত্রে দেখা হয়েছে, তা সরকার জনগণকে জানাতে বাধ্য৷
দমকলের পরিকাঠামো যে কতটা শোচনীয় তা আবার প্রকট হয়ে উঠল৷ যদিও সেই পরিকাঠামোর কথা বলেই বছর বছর কোটি কোটি টাকা দমকল দপ্তর খরচ করেছে৷ অত্যাধুনিক মই কিনেছে কিন্তু তা ব্যবহার কী করে হবে তার উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়েনি৷ কর্মীদের সুরক্ষা দিতে আগুন ও তাপরোধী পোশাক, গ্যাস মুখোশ, অক্সিজেন সরবরাহের আধুনিক ব্যবস্থা, ধোঁয়ার মধ্যেও দেখার জন্য আধুনিক সরঞ্জাম এ সমস্ত কিছুই অমিল৷ অতীতে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় হাইড্র্যান্টের মাধ্যমে গঙ্গাজল সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল৷ আগুন লাগলে দমকলের কাছে এগুলি ছিল জলের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস৷ এখনও বহু জায়গায় গঙ্গাজলের লাইন থাকলেও পরিকল্পিত ভাবে এর ব্যবহার যেমন আগের সিপিএম ফ্রন্ট সরকারও করেনি, তৃণমূল সরকারও উদাসীন৷
নন্দরাম মার্কেটের অগ্নিকাণ্ডের পর সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সমস্ত বৃহৎ বাজারে আগুন রোধে আধুনিক ব্যবস্থা করতে মালিকদের বাধ্য করা হবে৷ অথচ সাম্প্রতিককালে ফিরপোজ মার্কেট, সিটি মার্ট, হাতিবাগান বাজার, গোরাবাজার সহ নানা বাজার পুড়ে ছাই হয়ে গেছে৷ সরকার অতীতের গাফিলতি থেকে কোনও শিক্ষা যে নেয়নি তা বাগড়ি মার্কেটের আগুনে স্পষ্ট৷
জেনেশুনে, শুধু গড়িমসি করে কতটা বিপদ ডেকে আনা যায় তা রাজ্য সরকার করে দেখিয়েছে মাঝেরহাট ব্রিজের ক্ষেত্রে৷ তাদের পূর্ত দফতর জেনেছিল ব্রিজ দুর্বল হয়েছে৷ মেরামতির জন্য মাত্র ৩ কোটি টাকা দরকার ছিল৷ একটা সরকারি কাজে এই টাকা কি কোনও সমস্যা? মুখ্যমন্ত্রীর পুজোর উৎসাহেই তো এক লহমায় ২৮ কোটি টাকা গলে যায় অথচ এই ৩ কোটি বরাদ্দ হতে হতে বছর ঘুরে গেল৷ ব্রিজও ভেঙে পড়ল৷ বাগড়ি মার্কেটেও ঠিক একই রকমভাবে জেনেশুনে বিপদ ডেকে আনতে সাহায্য করেছে সরকারি দফতর এবং কর্পোরেশন৷ এখন তাঁদের খেয়াল হচ্ছে পঞ্চম এবং ষষ্ঠতলের বিল্ডিং প্ল্যান অনুমোদনের কাগজই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ ব্যবসার ছাড়পত্র দিতে এই কাগজ তো দেখার কথা ছিল দু’মাস আগে সেই ছাড়পত্র তাঁরা দিয়েছেন কী নথি দেখে?
সরকারি কর্তা–মন্ত্রী–সরকার দলের নেতারা বুঝে গেছেন, একটা কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে কিছুদিন তা নিয়ে হইচই চলে৷ তারপর সব থিতিয়ে গেলে মানুষের স্মৃতিতে তা পিছনে চলে যায়৷ এই ভরসাতেই তাঁরা মানুষের জীবন বাজি রেখে মুনাফা লোটার ছাড়পত্র দিয়ে দেন৷ নিজেদের পকেট এবং সরকারি দলের নির্বাচনী তহবিলও এই পথেই ভরে ওঠে৷ নতুন নতুন বাজার নামক জতুগৃহ জ্বলবার অপেক্ষায় থাকে৷ সর্বস্বান্ত মানুষগুলির দীর্ঘশ্বাস আর কান্নার রোল মানুষের বিবেকের দরবারে আবেদন করে যায়, এই কি আমরা চলতে দেব!
(৭১ বর্ষ ৯ সংখ্যা ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮)