কলকাতায় বাগুইআটি এলাকার দুই মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যু রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনের চূড়ান্ত অপদার্থ চেহারা নগ্ন করে দিয়ে গেল। ২২ আগস্ট দশম শ্রেণির দুই ছাত্র অতনু দে এবং অভিষেক নস্কর নিখোঁজ হন। উদ্বিগ্ন পরিজনরা বাগুইআটি থানায় অভিযোগ জানাতে গেলে পুলিশ বিষয়টিকে এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়েছে। ছেলেদুটিকে খোঁজার কাজ শুরু করার বদলে থানার আধিকারিকরা, ছেলে দিঘায় গিয়ে ফূর্তি করছে কিনা তা খোঁজ করার পরামর্শ দিয়েছেন বাবা-মাকে।
পুলিশের এই চরম অসংবেদনশীল মনোভাব দেখে অসহায় পরিজনরা কলকাতা পুলিশের হেডকোয়ার্টার লালবাজার এবং রাজ্যের গোয়েন্দা বাহিনীর সদর দফতর ভবানী ভবনে দেখা করে সাহায্যের আবেদন জানান। কিন্তু সেখানেও বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি। স্থানীয় কাউন্সিলর থেকে স্থানীয় বিধায়ক, এ দফতর থেকে সে দফতর–পাগলের মতো ছুটে বেড়িয়েছেন নিখোঁজ ছেলেদুটির বাবা-মায়েরা। সন্দেহভাজন অপরাধী, যে তাঁদের প্রতিবেশী, তার নামও জানিয়েছেন। পুলিশ নড়ে বসেনি। মুক্তিপণ চেয়ে ফোন আসার কথা পুলিশকে জানানো হলে অবশেষে অভিযোগ দায়ের হয়েছে। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে খুন হয়ে যাওয়া দুই কিশোরের মৃতদেহ দু’সপ্তাহ ধরে সরকারি হাসপাতালের মর্গে পড়ে থেকেছে। সেগুলি ওই নিখোঁজ কিশোরদেরই দেহ কিনা, তা দেখারওপ্রয়োজন বোধ করেনি পুলিশ। শেষ পর্যন্ত দু’সপ্তাহ আগে খুন হয়ে যাওয়া ছেলেদুটির বিকৃত দেহ শনাক্ত করার সুযোগ পান পরিজনরা।
এই ঘটনায় রাজ্য জুড়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন মানুষ। তাঁদের প্রশ্ন– এই মর্মান্তিক মৃত্যু কি অনিবার্য ছিল? রাজ্য পুলিশ-প্রশাসন যদি কর্তব্য পালনে সামান্য তৎপর হত, তাহলে দুটি কিশোরের তরতাজা প্রাণ এইভাবে ঝরে যেত কি? কাউন্সিলর কিংবা বিধায়ক উদ্যোগী হয়ে পুলিশকে যদি তার কাজ করতে বাধ্য করতেন, তাহলে হয়ত এ ঘটনা এড়ানো যেত। কিন্তু তাঁরা কেউই তা করলেন না! মানুষ প্রশ্ন তুলছে, রাজ্যের মানুষকে জীবনের ন্যূনতম নিরাপত্তাটুকুও যদি পুলিশ-প্রশাসন না দিতে পারে, তাহলে তাদের পিছনে জনগণের কষ্টার্জিত বিপুল টাকা ব্যয় করার যৌক্তিকতা কোথায়? রাজ্যের পুলিশমন্ত্রকের দায়িত্ব রয়েছে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর কাঁধে। এই ঘটনায় তাঁর দায় তিনি অস্বীকার করতে পারেন কি? বাগুইআটির ঘটনায় রাজ্য জুড়ে শোরগোল উঠে যাওয়ায় মুখ্যমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে ওই থানার আইসি-কে সাসপেন্ড করার নিদান দিয়েছেন। মুখ্যসচিব আরও তৎপরতা দেখিয়ে আইসি ছাড়াও তদন্তকারী অফিসারকেও সাসপেন্ড করেছেন। তাঁদের এই তৎপরতা এতদিন কোথায় ছিল? পুলিশ দফতরের এ হেন বেহাল দশার কোনও খবরই কি এতদিন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ছিল না? তা হলে দফতরের মন্ত্রী হয়ে কোন দায়িত্বটা তিনি পালন করছেন!
থানাগুলির সঙ্গে শাসক দলের ঘনিষ্ঠতার বিষয়টি ভুক্তভোগী মানুষ মাত্রেই জানেন। কংগ্রেস আমল থেকে শুরু হয়ে সিপিএম আমল পার করে বর্তমান তৃণমূল জমানাতেও সেই চরিত্রের বদল ঘটেনি। পুলিশ অপরাধীদের গ্রেফতারের ক্ষেত্রে দলীয় রঙ এবং অভিযোগকারীর সামাজিক প্রতিপত্তির ওজন দেখে পা ফেলে। ফলে শাসক দলের অফিস থেকে সঙ্কেত না গেলে বহু ক্ষেত্রেই থানা গুরুতর অভিযোগ পেয়েও নড়ে বসে না। প্রশ্ন উঠছে, বাগুইআটির ঘটনাতেও এ জিনিস ঘটেনি তো!
এ তো গেল প্রশাসনিক দিক। এর চেয়েও গভীর উদ্বেগের দিকটি হল, একজন প্রতিবেশী যুবক দুটি কিশোরকে এমন নৃশংস ভাবে খুন করতে পারল কী করে। সামান্য কিছু টাকার জন্য এভাবে খুন করার মনোবৃত্তি গড়ে উঠল কী করে? খুনি তো অপরাধী হয়ে জন্মায়নি! তার এমন অপরাধপ্রবণ মনটি তৈরি হয়েছে এই সমাজ থেকেই। নৈতিকভাবে অধঃপতিত সংকটগ্রস্ত এই সমাজই আজ মানুষকে অনৈতিক পথে রোজগারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেই কারণেই টাকার জন্য খুন, টাকার জন্য অপহরণ, নারীপাচার, ড্রাগের কারবার অবাধে চলে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ক্ষমতালোভী ভোটবাজ রাজনৈতিক দলগুলির ভূমিকা। ক্ষমতালোভী দলগুলি ভোটের স্বার্থে টাকার বিনিময়ে দরিদ্র যুবকদের দিয়ে ভোট লুঠ করায়, বুথ দখল করে বিরোধীদের উপর হামলা চালায়। এই যুবকদের নৈতিকতার পাঠ কে দেবে? তাদের সামনে নতুন জীবনবোধ তুলে ধরার দায়িত্ব নেবে কারা? নাকি, সমাজটাকে এভাবেই ঘাতকদের লীলাক্ষেত্রে পরিণত হতে দেব আমরা! বাগুইআটির দুই মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যু এই প্রশ্নটি তুলে দিয়ে গেল।