Breaking News

বাকপটু প্রধানমন্ত্রীর নীরবতায় স্পষ্ট জালিয়াতরা বিজেপির ঘনিষ্ঠ

70 year 27 Issue, 23 Feb 2018

 

বিজয় মাল্য, ললিত মোদি আর নীরব মোদি– দেশের সব জাতীয়তাবাদী সুসন্তানই বটে! এদের সকলের সাথেই জাতীয়তাবাদের চ্যাম্পিয়ান বিজেপির গভীর সম্পর্ক৷ এই সুসম্পর্কের জেরেই একের পর এক দুর্নীতিতে জড়াচ্ছে বিজেপি সরকার৷ প্রধানমন্ত্রী এবং বিজেপির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হিরে ব্যবসায়ী নীরব মোদি মুম্বইয়ের পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক থেকে হাতিয়ে নেওয়া অঙ্গীকারপত্র (লেটার অফ আন্ডারটেকিং) ব্যবহার করে ভারতীয় ব্যাঙ্কের বিদেশি শাখা থেকে ১১,৪০০ কোটি টাকা জালিয়াতি করে বিদেশে পালিয়ে গেছে৷ পিএনবি ছাড়াও অন্য ব্যাঙ্কগুলি থেকে নীরব মোদি এবং তাঁর আত্মীয়রা সব মিলিয়ে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে৷ যত দিন যাচ্ছে বেরিয়ে আসছে আরও বহু তথ্য৷ জালিয়াতির অসংখ্য ঘটনায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক সম্পর্কে অনাস্থা বাড়ছে সাধারণ মানুষের৷ প্রশ্ন উঠছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের প্রায় ১২ লক্ষ কোটি টাকা অনাদায়ী ঋণের কতটা ব্যবসায়িক কারণে, আর কতটা জালিয়াতি, তছরুপ, মিথ্যে তথ্য, অডিটে ফাঁক, ব্যাঙ্ক ঋণ অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া প্রভৃতি কারণে? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির নীরবতায় স্পষ্ট হচ্ছে সরকার সব জানত৷ একদিকে এফআরডিআই বিল, অন্য দিকে ধনকুবেরদের পক্ষ থেকে ক্রমাগত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির বেসরকারিকরণের দাবি তোলা, দুইয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগের সন্দেহও ক্রমাগত ঘনীভূত হচ্ছে৷

দেশের ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে সব থেকে বড় জালিয়াতির ঘটনা এটি৷ অর্থনীতির সাথে যুক্ত বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করছেন, নীরবের এই দুর্নীতি হিমশৈলের চূড়ামাত্র৷ ঠিক মতো খোঁড়া হলে কেঁচো নয়, কেউটে বের হবেই৷ গত পাঁচ বছরেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে ৮৬৭০টি জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে৷ যার পরিমাণ প্রায় ৬১,২৬০ কোটি টাকা৷ বিজেপি রাজত্বে তা মারাত্মক আকার নিয়েছে৷ পিএনবির এই কেলেঙ্কারি ছাড়াই শুধু ২০১৬–১৭ অর্থবর্ষে তার পরিমাণ ১৭,৬৩৪ কোটি টাকা৷ কিন্তু যেভাবে নীরব এবং তাঁর পরিবার নিশ্চিন্তে দেশ ছাড়ার পরে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়েছে, যেভাবে তারপরও সুইজারল্যান্ডের দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সভায় যোগ দিতে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী তাঁর সাথে বৈঠক করেছেন, যেভাবে প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁর সাথে বৈঠকের খবর প্রকাশিত হয়েছে তাতে এই জালিয়াতির পিছনে একটি সুপরিকল্পনা এবং তাতে বিজেপি নেতাদের যোগসাজশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে৷ ফলে কেঁচো যে আদৌ এই সরকার খুঁড়বে না, তা প্রায় জোর দিয়েই বলা যায়৷

নীরবই তো প্রথম নন, এর আগে আইপিএল কেলেঙ্কারিতে যুক্ত ললিত মোদি, লিকার ব্যারন বিজয় মালিয়াকে একই ভাবে বিপুল পরিমাণ টাকা প্রতারণার পর বিদেশে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন এই বিজেপি সরকারেরই তাবড় নেতা–মন্ত্রীরা৷ আজও তাঁরা বহাল তবিয়তে বিদেশে বাস করছেন৷ তাঁদের টিকি ছোঁয়ারও চেষ্টা করেনি বিজেপি সরকার৷ নীরব মোদির দুর্নীতি বিষয়েও অভিযোগ অনেক দিনের৷ কিন্তু না ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ, না রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, না প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর কেউই তা নিয়ে উচ্চবাচ্য করেনি৷ যখন দুর্নীতির পরিমাণ ব্যাঙ্কটির পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে তখনই বিষয়টি নিয়ে হইচই শুরু হয়েছে৷ যে প্রধানমন্ত্রী হয় কথায় নয় কথায় মতামত দেন, তুচ্ছ ব্যাপারেও টুইট করেন, ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে এটি দেশের সবচেয়ে বড় দুর্নীতি হওয়া সত্ত্বেও সেই প্রধানমন্ত্রী এখনও টুঁ–শব্দ করেননি৷ বলেননি, জনগণের এত বিপুল পরিমাণ টাকা যে বা যারা আত্মসাৎ করেছে, তারা রেহাই পাবে না, তাদের কাউকে ছাড়া হবে না৷ প্রধানমন্ত্রীর এই নীরবতা কি দোষীদের আড়াল করতেই?

দেশের ধনকুবেররা ব্যাঙ্কগুলি থেকে দশ লক্ষ কোটি টাকার বেশি গায়েব করে দিয়েছে৷ প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় বসার আগে আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত কংগ্রেসের দিকে আঙুল তুলে বলেছিলেন, ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’৷ অথচ নরেন্দ্র মোদি তথা বিজেপি সরকারের পাশে ভিড় করে থাকা ধনকুবেররা, সুযোগ সন্ধানীরা দু–হাত ভরে খেয়ে যাচ্ছে, দেশের সম্পত্তি লুঠ করে যাচ্ছে৷ আজ পর্যন্ত একজনও প্রতারক ধনকুবেরকে সরকার গ্রেপ্তার করেনি, বিচার করে শাস্তি দেওয়া তো দূরের কথা৷ বরং এই জালিয়াতির ফলে ধুঁকতে থাকা ব্যাঙ্কগুলিতে সরকার ক্রমাগত জনগণের রক্ত জল করা করের টাকায় পুষ্ট কোষাগার থেকে টাকা ঢেলে সেই ঘাটতি পূরণ করে চলেছে৷ গত বছরই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে বাঁচানোর নাম করে ২ লক্ষ ১২ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত মূলধন জোগানোর কথা ঘোষণা করেছে সরকার৷ অথচ মাত্র কয়েক হাজার টাকা ঋণ নিয়ে শোধ করতে না পেরে হাজার হাজার কৃষক দেশে আত্মহত্যা করে চলেছে৷ একটি ছোট দোকান চালানোর জন্য ঋণ নিয়ে শোধ করতে না পারায় পুলিশ কোমরে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে, এমন ঘটনা দেশে আকছার ঘটে চলেছে৷

একের পর এক এমন আর্থিক দুর্নীতি দেখিয়ে দিচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর নোট বাতিলের উদ্দেশ্য আসলে কালো টাকা উদ্ধার কিংবা দুর্নীতি দূর করা ছিল না৷ আসল উদ্দেশ্য ছিল একদিকে ধনকুবেরদের জমানো বিপুল পরিমাণ কালো টাকাকে সাদা করে ফেলার সুযোগ করে দেওয়া, অন্য দিকে জনসাধারণকে তাদের শেষ কপর্দকটি পর্যন্ত ব্যাঙ্কে জমা করতে বাধ্য করা, যাতে আম্বানি–আদানি–নীরব মোদিরা সেই টাকা অবাধে লুঠ করতে পারে৷ এই যেখানে সরকারের মনোভাব সেখানে এফআরডিআই–এর মতো বিল নিয়ে আসার উদ্দেশ্য যে জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা নয়, বরং জনগণের টাকা লুঠ করে ধনকুবেরদের ভাঁড়ার উপচে তোলা, তাতে সন্দেহ করার কোনও কারণ থাকতে পারে কি?

আসলে এমন অসংখ্য নীরব মোদিই নরেন্দ্র মোদিদের ঘিরে রয়েছে৷ তারাই সরকার, তারাই প্রশাসন৷ তাদের জন্যই সরকারের নীতি ঠিক হয়, তারাই দেশের নীতি ঠিক করে৷ তাই তাদের দুর্নীতির পরিমাণ আকাশ ছুঁলেও সরকার নীরব হয়ে থাকে৷ তা সীমা ছাড়ালে দু–একজন চুনোপুঁটিকে দোষী সাব্যস্ত করে রাঘব বোয়ালদের আড়াল করা হয়৷ তাই গত চার বছরে মোদির ঘনিষ্ঠ আম্বানি–আদানি–নীরব– ভাইদের সম্পত্তির পরিমাণ লাফ দিয়ে বেড়ে চলে৷ এক বেসরকারি সমীক্ষায় প্রকাশিত, গত এক বছরে তাদের সম্পদের পরিমাণ বেড়েছে ২০.৯ লক্ষ কোটি টাকা, যা ২০১৭–১৮ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটের সমান৷

পশ্চিমবঙ্গেও সক্রিয় ব্যাঙ্ক জালিয়াতরা

  •   পার্ক স্ট্রিটে স্টেট ব্যাঙ্কের একটি শাখায় শ্রীমহালক্ষ্মী কর্পোরেশন বিভিন্ন সংস্থার নামে ১৪২ কোটি টাকা লোন নেয়৷ পরে ব্যাঙ্ক জানতে পারে সংস্থাগুলি ভুয়ো৷

 

  • ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে রামস্বরূপ উৎপাদক নামে একটি সংস্থা আরও প্রায় ৯টি সংস্থার নামে ঋণ নিয়ে তা অন্য বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে বাইরে পাচার করেছে৷ ব্যাঙ্ক আসল সংস্থার ঠিকানা খোঁজ নিতে গিয়ে দেখে তা ভুয়ো৷

 

  • একটি স্টিল উৎপাদনকারী সংস্থার নাম করে এলাহাবাদ ব্যাঙ্ক থেকে টার্ম লোন বাবদ নেওয়া হয় ৩৪ কোটি টাকা৷সংস্থাটি ২৪ কোটি টাকা লাভ দেখিয়ে লোন নেয়৷পরে জানা যায় লাভ ২৪ লক্ষ টাকা৷

 

  • স্টেট ব্যাঙ্কের সঙ্গে আরও দুটি সংস্থা প্রতারণা করেছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা৷

 

  • কানাড়া ব্যাঙ্ক থেকে প্রায় ১৫ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে একটি মোটরবাইক কারখানা, যেখানে আদৌ মোটরবাইক তৈরি হয় না৷

 

  • গোয়েন্দাদের হিসাবে গত এক বছরে প্রায় ২০টি ব্যাঙ্কে এইভাবে প্রতারণা হয়েছে৷ এর দায় ব্যাঙ্ক কী করে সামলাবে? সরকার রাজকোষ থেকে ত্রাণ প্যাকেজ দিক বা এফআরডিআই প্রয়োগ করে গ্রাহকদের টাকা ব্যাঙ্কে আটকে রাখুক – যাই ঘটুক না কেন কোপটা পড়ছে দেশবাসীর ঘাড়ে৷

(তথ্যসূত্র : এই সময় ১৮.২.২০১৮)

দেশের কোটি কোটি জনসাধারণ না খেয়ে মরে, বিনা চিকিৎসায় মরে, অশিক্ষার অন্ধকারে, কুসংস্কারে ডুবে থাকে, তার জন্য ব্যয় করতে সরকারের টাকার অভাব হয়, কিন্তু সেই অভুক্ত, রোগজর্জর জনগণের কষ্টার্জিত টাকায় পুঁজিপতিদের পুষ্ট করার জন্য কখনও সরকারের তৎপরতার অভাব হয় না৷ এবং এই জিনিসই দেশে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে৷ তা হলে এই সরকারটা কাদের– দেশের ৯৯ শতাংশ সাধারণ মানুষের, নাকি এক শতাংশ ধনকুবেরের? কারা চালাচ্ছে সরকার– জনসাধারণের প্রতিনিধিরা, না ধনকুবেররা? সরকারের আচরণই প্রমাণ করে দিচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ নয়, মুষ্টিমেয় ধনকুবেরই তার আসল মালিক৷ আর সরকার হল এই পুঁজিপতি ধনকুবেরদের পলিটিক্যাল ম্যানেজার, যার কাজ দেশের মানুষের সর্বস্ব যাতে এই ধনকুবেররা লুঠ করতে পারে তার ব্যবস্থা করে দেওয়া– সরাসরি না পারলে আইন করে, আইনে না পারলে আইন ভেঙে৷

নীরব কেলেঙ্কারিতে জনগণের ক্ষোভ যখন তুঙ্গে উঠেছে, মোদি সরকারের সাথে কেলেঙ্কারিগুলির যোগসাজশ প্রকাশ্যে এসে যাচ্ছে, তখন ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছে কংগ্রেস৷ পুঁজিপতিদের পরিচালিত সংবাদমাধ্যমও কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর হালকা চালে বলা দুর্নীতি বিরোধী চুটকিগুলিকেও গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করছে৷ ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে মাত্র চার বছর আগে এই কংগ্রেস পরিচালিত সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধেই ফুঁসে উঠেছিল দেশের মানুষ এবং কংগ্রেস সরকারের পতন হয়েছিল৷ এই নীরব–দুর্নীতির সূচনাও ২০১১ সালে কংগ্রেস শাসনের সময়েই৷ এলাহাবাদ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন ডিরেক্টর দীনেশ দুবে দাবি করেছেন, তিনি ২০১৩ সালে নীরবের মামা মেহুল চোকসিকে ঋণ না দেওয়ার আর্জি জানিয়ে অর্থসচিবকে চিঠি দিয়েছিলেন৷ অভিযোগ জানান রিজার্ভ ব্যাঙ্ককেও৷ কিন্তু উল্টে তাঁকেই নাকি ইস্তফা দিতে বলা হয়৷ অভিযোগ উঠেছে, ২০১৩ সালে ১৩ সেপ্টেম্বর নীরবের প্রদর্শনীতে গিয়েছিলেন রাহুল৷ তার পরের দিনই নাকি তাঁর ঋণ মঞ্জুর হয়ে যায়৷ রাহুল গান্ধীর দুর্নীতি বিরোধিতা ভোটের স্বার্থে পার্লামেন্টারি বিরোধিতা, যা শুধুমাত্র গদি ফিরে পাওয়ার লক্ষ্য থেকে করা৷ না হলে দুর্নীতির প্রশ্নে কংগ্রেস–বিজেপি একই মুদ্রার এ–পিঠ ও–পিঠ ৷

১৯৯০ এর দশকের শুরুতে কংগ্রেসের নেতৃত্বে উদারিকরণ–বেসরকারিকরণের নীতি গ্রহণের মধ্য দিয়েই এই দুর্নীতির ফ্লাডগেট খুলে দেওয়া হয়েছিল৷ শুরু হয়েছিল সরকারি তথা জনগণের সম্পত্তি লুঠ করার মোচ্ছব৷ পালা করে কংগ্রেস বিজেপি সেই লুঠেরাদের রক্ষা করার কাজ করে চলেছে৷ এই ব্যবস্থাটিকে টিকিয়ে রেখে শুধু সরকার বদলে জনগণের সম্পত্তির এই লুঠতরাজ বন্ধ করা যাবে না৷ চাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রবল গণআন্দোলন, আর সেই আন্দোলনে ব্যাপক সংখ্যক জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ৷